কিশোরগঞ্জে চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম
কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে ছোট বড় অনেক চিকিৎসা সেবা কেন্দ্র। এসব হাসপাতাল ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের চিকিৎসা বর্জ্য সাধারণ বর্জ্যের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলা হচ্ছে। সাধারণ বর্জ্যের চেয়ে চিকিৎসা বর্জ্য মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এ ছাড়া হাসপাতালের চিকিৎসা বর্জ্য দুই-তিন দিন কিংবা সপ্তাহ ধরে পড়ে থাকতে দেখা যায়। এসব ময়লা-আবর্জনা পচে দুর্গন্ধও ছড়ায়। চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় দক্ষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পরিচ্ছন্নতা কর্মীর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তা ছাড়া চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আলাদা ডাম্পিং গ্রাউন্ডেরও প্রয়োজন আছে।
বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে দেখা গেছে, জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ চিকিৎসা বর্জ্য আলাদাভাবে সংরক্ষণ ও বিনষ্ট করার কথা থাকলেও সেটি মানা হচ্ছে না। চিকিৎসা বর্জ্যের সঙ্গে সাধারণ বর্জ্য রাখার পর এগুলো লোহার ভ্যান, ট্রলি ও ট্রাকের মাধ্যমে পৌরসভার সীমান্তবর্তী নতুন জেলখানার কাছে খিলপাড়া এলাকায় ডাম্পিং গ্রাউন্ডে ফেলা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সরকারি হাসপাতালগুলোর বর্জ্য পৌরসভার তত্ত্বাবধানে সরানো হয়। বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের বর্জ্য মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের তত্ত্বাবধানে অপসারণ করা হয়। সাধারণ বর্জ্যের সঙ্গে হাসপাতালের বর্জ্য তোলা হচ্ছে লোহার ট্রলিতে। চিকিৎসা বর্জ্য বহনের কাজে নিয়েজিত পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের নেই হ্যান্ড গ্লাভস, অ্যাপ্রোন। চিকিৎসা বর্জ্য পৃথক করে চারটি আলাদা রঙের কন্টেইনার এ সংরক্ষণ করার নিয়মও রয়েছে। তবে সাধারণ বর্জ্য ও চিকিৎসা বর্জ্য আলাদাভাবে রাখার নিয়ম থাকলেও সেই নিয়ম শুধু নীতিমালার ভেতরেই সীমাবদ্ধ।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নীতিমালা অনুসারে, বর্জ্য সংরক্ষণের কনটেইনার ঢাকনা দিয়ে আটকে রাখতে হবে। তবে স্থানীয় হাসপাতালের অধিকাংশ কনটেইনারই খোলা থাকে। বর্জ্যের খোলা কনটেইনারে সাধারণ বর্জ্য, মাস্ক, সিরিঞ্জ, রক্তমাখা তুলা, রক্তমাখা ব্যান্ডেজ, ওষুধের বোতলসহ অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্যও ফেলা হয়।
সাধারণত হলুদ কনটেইনারে ক্ষতিকারক, লাল কনটেইনারে ধারালো, নীল কনটেইনারে তরল, সিলভার কনটেইনারে তেজস্ক্রিয়, সবুজ কনটেইনারে পুনঃব্যবহারযোগ্য সাধারণ বর্জ্য এবং কালো কনটেইনারে সাধারণ বর্জ্য রাখার নির্দেশনা থাকলেও নীল রঙের ড্রামে, কন্টেইনারে সব বর্জ্য রাখা হচ্ছে একসঙ্গেই রাখা হচ্ছে। মানা হচ্ছে না বর্জ্য রাখার নিয়ম।
কনটেইনারে নেই বর্জ্যের নাম ও সাংকেতিক চিহ্ন বা বর্জ্য রাখার নির্দেশনাও। শুধু সরকারি-বেসকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকই নয়, ঝুঁকিপূর্ণ চিকিৎসা বর্জ্যের যথাযথ ব্যবস্থাপনা ছাড়াই চলছে এখানকার স্থানীয় সব হাসপাতাল। তা ছাড়া পচনশীল ও অপচনশীল বর্জ্য একসঙ্গে মিশিয়ে ফেলার কারণে ঠিকমতো বর্জ্য ধংসও হচ্ছে না। হাসপাতালের খোলা ড্রামে রাখা বর্জ্যের মধ্যে মশা-মাছিরা রোগ বিস্তার করছে। যার ফলে মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে সহজেই।
বিভিন্ন হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চিকিৎসা বর্জ্য পরিশোধনের সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকার কারণে হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি, যক্ষ্মা, ডিপথেরিয়া, বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ, এমনকি এইডসের মতো মরণব্যাধির ঝুঁকি বাড়ছে। মেডিকেল বর্জ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকায় পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি বাড়ছে।
কিশোরগঞ্জ সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের উপপরিচালক ড. হেলাল উদ্দিন বলেন, প্রতিদিন সদর হাসপাতাল ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেলে যে বর্জ্যগুলো জমা হয়, সেগুলো একটা শেডের মধ্যে জমা রাখা হয়। হাসপাতাল থেকে বর্জ্য বের হওয়ার আগে যেগুলো ক্ষতিকারক ধারালো বর্জ্য সুঁই, ব্লেড, তেজস্ক্রিয় বর্জ্য, তরল বর্জ্য শেডের সঙ্গে সংযুক্ত গর্ততে ফেলা হয় এবং ধ্বংস করা হয়।
তিনি আরও বলেন, হাসপাতালের সাধারণ বর্জ্য ও চিকিৎসা বর্জ্য পৌরসভার গাড়িতে নিয়ে যায়। সপ্তাহে দুই দিন বা একদিন পৌরসভার গাড়িতে করে হাসপাতালের বর্জ্য নিয়ে যায়। কিন্তু শেডে বর্জ্য জমা থাকার কারণে বর্জ্য পচে দুর্গন্ধ ছড়ায়। হাসপাতালের বর্জ্য ধ্বংস করার জন্য আলাদা ডাম্পিং গ্রাউন্ড না থাকার কারণে সাধারণ বর্জ্যের সঙ্গে মিশ্রিত চিকিৎসা বর্জ্য ঠিকভাবে ধ্বংস হচ্ছে কি না সেগুলো খেয়াল রাখা অত্যন্ত জরুরি।
ড. হেলাল বলেন, জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য চিকিৎসা বর্জ্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে স্বাস্থ্য বিভাগ ও স্থানীয় সরকার বিভাগের সমন্বয়ে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নীতিমালা তৈরি করা উচিৎ; যেখানে সকল হাসপাতালের বর্জ্য যাবে এবং একটি নির্দিষ্ট জায়গায় ডাম্পিং হবে।
কিশোরগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের সিনিয়র কেমিস্ট রুবাইয়াত তাহরীম সৌরভ বলেন, চিকিৎসা বর্জ্য সঠিকভাবে জীবাণুমুক্ত না করে সাধারণ বর্জ্যের সঙ্গে চিকিৎসা বর্জ্য মেশানো যাবে না। কিশোরগঞ্জে যতগুলো হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে তাদের নিজস্ব চিকিৎসা বর্জ্য স্ব-উদ্যোগে ব্যবস্থাপনার জন্য নির্দেশনা রয়েছে। আমরা সেক্ষেত্রে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার চুক্তিপত্র রয়েছে কি না সেটি দেখি। রক্ত ও পুঁজ মাখা তুলা, ব্যান্ডেজ, গজ ও অন্যান্য চিকিৎসা বর্জ্য সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইট দিয়ে কংক্রিটের পিট তৈরি করে কিংবা নিজস্ব বেসিনে আনুমানিক ২৫-৩০ মিনিট পর্যন্ত জীবাণুমুক্ত করে পৌরসভা বা মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের কাছে সরবারাহ করার পরামর্শ থাকে। যদি বিধিমালা অনুযায়ী চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না করে তাহলে প্রশাসনের সহযোগীতায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনাসহ প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এসএন