রংপুর স্থাপন হচ্ছে আবহাওয়া নিরুপনের নতুন রাডার
রংপুর আবহাওয়া কার্যালয়ে এক যুগ ধরে অকেজো রাডার দিয়ে প্রাকৃতি নিরুপনের পর বসতে যাচ্ছে নতুন রাডার। এ লক্ষ্যে মাটি পরীক্ষা ও প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেছে কর্তৃপক্ষ। রার্ডারটি ৪০০ কিলোমিটারের মধ্যে বৃষ্টিপাতের ধরণ, ঘূর্ণি ঝড়ের পূর্বাভাসসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস দিবে। বজ্রপাতের কারণে আগে স্থাপন করা রাডারটি নষ্ট হয়ে যাওয়ার পরে নতুন একটি রাডার স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দীর্ঘ প্রত্যাশিত এ রাডার স্থাপন হতে যাওয়ায় স্বস্তি ফিরেছে আবহাওয়া দপ্তরে। কৃষি প্রধান উত্তরাঞ্চলের কৃষি অর্থনীতিতে এ রাডার ব্যাপক ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
রংপুর আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা যায়, রংপুর নগরীর কলেজ রোড মাস্টারপাড়া এলাকায় ১৯৭৭-৭৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের অধীনে আবহাওয়া, রাডার ও ভূ-কম্পন পর্যবেক্ষণাগার স্থাপন করা হয়। আড়াই একর জমির ওপর নির্মিত এ আবহাওয়া কেন্দ্রে জাপান সরকারের অর্থায়নে ১৯৯৯ সালে একশ কোটি টাকা ব্যয়ে কনভেনশনাল রাডার স্থাপন করা হয়।
এ রাডারের সাহায্যে ভূমিকম্প পরিমাপ, দুর্যোগের পূর্বাভাস ও প্রতিদিনের আবহাওয়া পরিস্থিতি ঢাকা প্রধান কার্যালয়কে প্রদান করা হতো। রাডারটির আয়ুষ্কাল ছিল ১০ বছর। কিন্তু ২০০৭ সালে রাডারে ক্রুটি ধরা পরে। স্থানীয় প্রকৌশলীদের প্রচেষ্টায় ২০১২ সাল পর্যন্ত রাডারটিকে সক্রিয় রাখা সম্ভব হয়েছিল। এরপর বজ্রপাতের কারনে স্থাপন করা রাডারটি অকেজো অবস্থায় রয়েছে এটি।
বিষয়টি বর্তমান সরকারের নজরে আসলে একনেকে রংপুরের জন্য একটি আধুনিক রাডার স্থাপনের বিল পাস করা হয়। জাপান সরকারের অনুদানে প্রায় ১২০ কোটি টাকা ব্যয়ে আবহাওয়া অফিসে একটি ডপলার রাডার স্থাপনের কথা ছিল। কিন্তু ২০১৫ সালের ৩ অক্টোবর রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার আলুটারীতে জাপানি নাগরিক হোশি কোনিও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ওই সময় নিরাপত্তার অভাব বোধ করায় জাপানের প্রকৌশলীরা রংপুরে রাডার স্থাপনের জন্য আসেননি।
পরে তাদের নিরাপত্তায় আবহাওয়া অফিসে পুলিশ ব্যারাক, ডরমেটরি নির্মাণ, সীমানা প্রাচীর কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়।পরে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা একটি প্রতিনিধি দল তৎকালীন রংপুর আবহাওয়া অফিস পরিদর্শন করে নিরাপত্তা নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন। এরপর প্রকৌশলীরা রংপুরে আসার প্রস্তুতি নিলে করোনার কারণে ফের রাডার স্থাপনের কাজ বাধা গ্রস্থ হয়। এভাবেই প্রায় এক যুগ ধরে রংপুর আবহাওয়া কেন্দ্র থেকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে না। এখন ঢাকা কার্যালয় থেকে তথ্য নিয়ে পূর্বাভাস দেয় রংপুর আবহাওয়া অফিস। এমন পরিস্থিতিতে উত্তরাঞ্চলের মানুষকে আবহাওয়া সম্পর্কে পূর্বাভাস দিতে রাডার স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে।
রংপুর আবহাওয়া অফিসে রাডার স্থাপনের কাজটি তত্বাবধান করছে জাপানের শিমিজু করর্পোরেশন। কর্মকর্তারা আবহাওয়া কার্যালয়ে অবস্থান করছেন এবং মাঠপর্যায়ে কাজের তদারকি করছেন। ইতোমধ্যে রংপুর আবহাওয়া অফিসের প্রশাসনিক ভবনের সামনে ফাঁকা জায়গাটির মাটি পরীক্ষা করা হয়েছে। এ রাডার স্টেশনের সরঞ্জামাদি সরবরাহ করছে মারুবিনি করর্পোরেশন। আগামী ২০২৫ সালের মার্চে রংপুর আবহাওয়া কেন্দ্রে রাডারটি চালুর আশা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
শিমিজু করপোরেশনের সিনিয়র কনসালটেন্ট আব্দুল আজিজ বলেন, এখানে ডপলার রাডার স্থাপন করা হচ্ছে। এ রাডারের মাধ্যমে রংপুর আবহাওয়া কেন্দ্র থেকে চারদিকে ৪০০ কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়, মেঘের গতিবিধি, বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা, বজ্রপাতসহ আবহাওয়ার আগাম নানা তথ্য দেওয়া সম্ভব হবে। দুর্যোগের বেশ কয়েক ঘণ্টা আগে তথ্য পাওয়ায় সংশ্লিষ্টদের সঠিকভাবে পূর্বাভাস দেওয়া যাবে। কালবৈশাখী মেঘের অস্থিত্ব, টর্নেডোর মেঘ, বজ্রপাতের ধরন বলে দিতে পারবে । রাডার স্থাপনের কার্যক্রম শুরুর দেড় মাস আগেই আগাম কাজ শুরু করেছি। আশা করছি ২০২৫ সালের মার্চে এ ডপলার রাডার স্টেশনটি চালু করা সম্ভব হবে।
রংপুর আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তা মোস্তাফিজার রহমান বলেন, দেশের উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতি কৃষির সঙ্গে জড়িত। প্রতিবছর খরা, বন্যা, অতিবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে আমাদের কোটি কোটি টাকার ফসলহানি হয়। বজ্রপাতের কারণে দিন দিন মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে চলছে। আবহাওয়ার পূর্বাভাস না থাকায় মৌসুমি রোগব্যাধি বাড়ছে। তাই এখানে ডপলার রাডার স্থাপন করা অত্যন্ত জরুরী ছিল। এই রাডার স্টেশন চালু হলে মেঘের অবস্থান, গতি, দিক, তাপমাত্রা জানতে পারব।
বজ্রপাতের পূর্বাভাস দেওয়ার মাধ্যমে মৃত্যুর হার কমানো সম্ভব হবে। রেডজোনে অবস্থিত রংপুরে ভূমিকম্প ও বড় ধরনের বন্যার তথ্য দেওয়া যাবে। আগাম বৃষ্টিপাতের তথ্য দেওয়ার মাধ্যমে কৃষকদের ফসলের ক্ষতি থেকে রক্ষা করা যাবে। সেই সঙ্গে রংপুরের আবহাওয়ার অবস্থা ও পরিবর্তনজনিত কারণগুলো গবেষণা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা যাবে।
তিনি আরো বলেন,আবহাওয়াবিদদের তথ্য অনুযায়ী জলবাযুর পরিবর্তনের ফলে উত্তরাঞ্চলের প্রকৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। জীব বৈচিত্রও হুমকির মুখে পড়েছে। শীতকালে প্রচন্ড শীত এবং শৈত্য প্রবাহ বয়ে যায় এ অঞ্চলে। গ্রীষ্মকালে ঝড়, টর্নেডো, অবিরাম বর্ষণ, বন্যাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই আছে। বলা চলে প্রায় বারো মাসই উত্তরাঞ্চলের মানুষ প্রাকৃতির নানা প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করে চলছে জীবন যাপন।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় এ অঞ্চলের আবহাওয়া অফিস গুলোকে কার্যকরভাবে গড়ে তোলা হয়নি। উত্তরাঞ্চলের আবহাওয়া অফিস গুলোর মধ্যে একমাত্র রংপুরে ছিল রাডার এবং ভূমিকম্প পরিমাপক যন্ত্র। রাডারটি নষ্ট হওয়ায় আবহাওয়ার অনেক তথ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল এই অঞ্চলের মানুষ। রাডারটি স্থাপন হলে দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার মানুষ সঠিক সময়ে আবহাওয়ার সঠিক তথ্য পাবে।
এএজেড