রাঙ্গুনিয়ায় স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ১৫ হাজার ইটভাটা শ্রমিক
মাটি কেটে ইটভাটায় নেওয়া, পানি দিয়ে মাটি নরম করা, গর্তের মধ্যে মাটি কর্দমাক্ত করা, বালি মিশ্রিত কাঁদামাটি দিয়ে ইট তৈরি করা, রোদে শুকিয়ে ইট পোড়ানো আবার মাথায় করে তৈরি করা ইট ভাটি থেকে উঠিয়ে সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে রাখা-প্রতিদিন এসব ধুলাবালির কাজ করতে হচ্ছে ইটভাটার শ্রমিকদের। অথচ নেই কোনো ধোঁয়া রোধক মাস্ক (মুখোশ)। ফলে ধুলাবালি অবাধে শরীরে প্রবেশ করার কারণে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রাঙ্গুনিয়ার প্রায় ১২-১৫ হাজার ইটভাটার শ্রমিক। পান না চিকিৎসা ও ওষুধ। ন্যায্য মজুরির অভাবে ইটভাটার এসব শ্রমিকরা মানবেতর জীবনযাপন করলেও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে মালিক পক্ষের রয়েছে উদাসীনতা। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকার ইটভাটা ঘুরে দেখা গেছে শ্রমিকদের এই দুরাবস্থা।
উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের এবিএম ইটভাটায় গিয়ে দেখা যায়, মো, শরীফ মিয়া (৪০), মঞ্জু মিয়া (৩৯), সৈয়দুল হক ( ৫২) আজাহারুল ইসলাম (৫০) ধূলাবালি রোধক মাস্ক (মুখোশ) ছাড়া ইট ফাইলিংয়ের কাজ করছে। তাদের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, এই ইটভাটায় ১৭০ থেকে ১৮০ জন শ্রমিক কাজ করছে। ২০ থেকে ২১ জন শ্রমিক ইট পোড়ানোর কাজে নিয়োজিত রয়েছে। যারা একনাগাড়ে ২৭-২৮দিন নির্ঘুম রাত কাটিয়ে ভাটায় আগুন দেওয়ার কাজ করছে। কারণ আগুনের তেজ কম হলে ইটের মান কমে যায়।
একটু দূরে ভাটার পাশে ২০-৩০ জন শ্রমিক বালি মিশ্রিত কাঁদামাটি দিয়ে ইট তৈরি করছে। যাদের ১৭-১৮ দিনের মধ্যে এক লাখ থেকে দেড় লাখ ইট তৈরি করতে হবে। এরপর ৮-১০ দিন রোদে শুকাতে হয়।
জানা গেছে, প্রতি বছর বৈশাখ মাস পর্যন্ত প্রতিটি ইটভাটায় এভাবে ৭০-৮০ লাখ ইট তৈরি করতে হয়। যার বাজার মূল্য প্রায় ৩-৪ কোটি টাকারও বেশি।
একই ইউনিয়নের বিএসবি ও বিএনবি ইটভাটার শ্রমিক সালাউদ্দিন (৩৫), বাহারউদ্দিন(৩২) ও রিদম হোসেন (৩০) বলেন, 'ইট পোড়ানো ও তৈরির আগে উপকরণ যোগাতে শ্রমিকদের বেশি ঘাম ঝড়াতে হয়। মাটি সংগ্রহ, মাটি সংরক্ষণ, পানি দিয়ে মাটি নরম করা, গর্তের মধ্যে মাটি কর্দমাক্ত করার কাজে বেশি শ্রম দিতে হয়। শতাধিক শ্রমিক এসব কাজে সারাক্ষণ শ্রম দেয়।'
তারা আরও জানান, 'ইট তৈরির কাজে বলদের মতো শ্রম দিয়েও ন্যায্য মজুরি পায় না শ্রমিকরা। শুধুমাত্র খোরাকি (খাবার খরচ) নিয়ে ভাটায় কাজ করতে হয়।'
চিকিৎসার জন্য কোনো ব্যবস্থা আছে কি না জানতে চাইলে তারা বলেন, 'টাকাই দিতে চায় না আবার চিকিৎসা। অসুস্থ কিংবা দুর্ঘটনায় হাত-পা কাটা ও শরীরের অঙ্গহানি হলে তারও চিকিৎসা মেলে না। দুই- এক দিনে সুস্থ না হলে মৃত্যুর প্রহর গুনতে হয়। সুখে-অসুখে ইটভাটার শ্রমিকদের ছুটির কোনো নিয়ম নেই।'
অথচ শ্রম আইনে আছে কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবা ও নিরাপত্তা সুবিধা প্রতিটি শ্রমিকের বৈধ এবং আইনগত অধিকার। শ্রম আইন ২০০৬ এর অধীনে অন্তর্ভুক্ত পেশাগত স্বাস্থ্যসেবা এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়গুলো হলো পরিচ্ছন্নতা, পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল এবং তাপমাত্রার ব্যবস্থা, আলোর ব্যবস্থা, অগ্নি সংক্রান্ত ঘটনা, কৃত্রিম আদ্রকরণ, জনবহুলতা, অতিরিক্ত ওজন, ব্লিডিং যন্ত্রপাতির সুরক্ষা, যন্ত্রপাতিকে ঘেরাওকরণ, বিস্ফোরক বা দাহ্য গ্যাস, বিপজ্জনক ধোঁয়ার বিষয়ে সতর্কতা, ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহার এবং ঝুঁকি মূল্যায়ন ও প্রতিরোধ ব্যবস্থার বিধান থাকলেও রাঙ্গুনিয়ার কোনো ইটভাটায় তার প্রয়োগ নেই।
এদিকে রাজানগর ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডে স্থাপিত বিএনবি ও এমবিএম ভাটার শ্রমিকরা জানান, ইটভাটায় যে সমস্ত শ্রমিক কাজ করে তাদের সবাই রাজশাহী, খুলনা, নোয়াখালি, গাইবান্ধা, রংপুর ও বরিশাল অঞ্চলের। এসব এলাকায় যখন কাজের অভাব দেখা দেয় তখন অগ্রিম মজুরি নিয়ে শ্রম বিক্রি করে শ্রমিকরা। এ সুবাধে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়াসহ বিভিন্ন উপজেলার ইটভাটাগুলোতে শ্রমিকরা কম মূল্যে শ্রম দিতে বাধ্য হয়। বলদের মতো খাটুনি খেটেও ন্যায্য মজুরীর অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করতে হয় শ্রমিকদের। উপজেলায় গড়ে ওঠা প্রায় সব ইটভাটার চিত্র এ রকম বলে ইটভাটায় নিয়োজিত শ্রমিকরা জানান।
এ বিষয়ে এবিএম ভাটার মালিক মো. ইউনুছ কোং বলেন, 'শ্রমিকরা ইটভাটায় কাজ করলেও আমার সঙ্গে তেমন যোগাযোগ নেই। কারণ শ্রমিকরা কাজ করে মাঝির অধীনে। মাঝির মাধ্যমে শ্রমিকদের মজুরি অগ্রীম দেওয়া হয়েছে। কাজ চলাকালীন সময়ে খোরাকীর টাকাও মাঝির মাধ্যমে দেওয়া হয়। অতএব শ্রমিকদের ভালো-মন্দ দেখার দায়িত্ব মাঝির। শ্রমিকদের থাকা ও চিকিৎসার বিষয়টিও মাঝি দেখেন।
এবিএম ভাটার মাঝি সৈয়দুল হক বলেন, 'শ্রমিক দিয়ে ইটভাটায় কাজ করানো আমার ব্যবসা। গত ১৫ বছর ধরে আমি এ ব্যবসায় জড়িত। আমার এলাকার শ্রমিকদের অগ্রিম বেতন দিয়ে আমি ইটভাটায় কাজ করাই। অগ্রিম মজুরি দিয়ে কাজ করাই। অনেক সময় শ্রমিকরা ইটভাটা থেকে পালিয়ে যায়। এতে মালিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। ক্ষতিগ্রস্ত হয় মাঝি। এ ছাড়া কেউ কাজ করতে গিয়ে আঘাতপ্রাপ্ত হলে তাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা করা হয়।
কোন ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা করানো হয় এবং কোন শ্রমিকের চিকিৎসা করানো হয়েছে? এমন প্রশ্ন করা হলে চুপষে যান তিনি। কোনো প্রতিত্তর দিতে পারেননি।
এ ব্যাপারে রাঙ্গুনিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. দেবপ্রসাদ ভট্টাচার্য বলেন, 'ইটভাটার শ্রমিকরাই বেশি স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে থাকে। এসব কারখানায় ধুলাবালি উড়ে বেশি। যার কারণে এখানকার নিয়োজিত শ্রমিকরা ফুসফুস সংক্রমণ এ্যাজমা, ফিওপিডি রোগে আক্রান্ত হন বেশি।
তিনি আরও বলেন, কর্মপরিবেশের দূষণ, কায়িক শ্রম, নিরাপত্তা যন্ত্রপাতি সঠিকভাবে ব্যবহার না করা, অধিক সময় বিরতিহীন ভাবে কাজ করা ও একই কাজ বারবার করায় শ্রমিকরা নানা রোগ ও শারীরিক জটিলতায় ভুগতে পারেন।
এসআইএইচ