অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধে ফেসবুকে চেয়ারম্যানের স্ট্যাটাস
নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের ৭নং মুছাপুর ইউনিয়নে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের যোগসাজশে ৬০০ একর সরকারি খাস জমি দখল এবং ছোট ফেনী নদী, বামনী নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে বিক্রির অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয়দের অভিযোগ এসব বিষয়ে উপজেলা প্রশাসন ও জেলা প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েও মেলেনি কোন প্রতিকার। গত সোমবার (৯ জানুয়ারি) সকাল ৯টার দিকে খোদ কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ.সাহাব উদ্দিন তার নিজের ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে খাস জমি দখল করে বিক্রি ও বালু উত্তোলন নিয়ে দুটি স্ট্যাটাস দেন। এতে পুরো জেলা জুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়।
এতে তিনি লিখেন,বালু উত্তোলনকারী এবং ভূমি দস্যুরা অনেক শক্তিশালী,তাদের হাত নাকি অনেক লম্বা। উপজেলা পরিষদের পক্ষে উপজেলা প্রশাসন কোম্পানীগঞ্জ থানা, কোস্টগার্ড কমপক্ষে বিশবার অভিযান চালিয়েও বালুলুট, ভূমিলুট বন্ধ করতে পারে নাই, পারছে না। বিশেষ সংস্থা বালু উত্তোলনকারী দস্যুদের এবং ভূমিদস্যুদের গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ার পরও ছেড়ে দিয়েছে। কোথায় তাদের এত শক্তি? ভূমিহীনদেরকে বন্ধোবস্ত দেওয়া জমিও দখল বিক্রি করে দিচ্ছে। ভূমিহীনেরা অসহায়,ভয়ে দখলে যেতে পারছে না।
অপর এক স্ট্যাটাসে তিনি লিখেন,ছোট ফেনী নদী থেকে মুছাপুরে বালু উত্তোলনে পাঁচ হাজার কোটি টাকার সুইস গেট যেকোনো মুহুর্তে বিলীন হয়ে যাবে। চরপাবর্তী, চরহাজারী, মুছাপুর ইউনিয়ন বিলীন হবে। কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। এখনই বন্ধ করা প্রয়োজন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের রহস্যজনক ভূমিকায় গত ৮ মাস ধরে মুছাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আইযুব আলী ও ৭নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য (মেম্বার) মো. আলী আজগর জাহাঙ্গীরের যোগসাজশে তার ভাই জালাল উদ্দিন এবং তাদের সহযোগী মাইন উদ্দিন দুটি ড্রেজার দিয়ে রাতদিন ছোট ফেনী নদীর ভিতরের অংশ থেকে বালু উত্তোলন চালিয়ে আসছে।
গত ১ মাস ধরে একই সিন্ডিকেট স্থানীয় মাইন উদ্দিন দয়াল নামে এক ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে মুছাপুর ক্লোজারের ছোট ফেনী নদী ও বামনী নদীর আরো ৩টি স্পট থেকে বালু উত্তোলন করছে। ৬০০ একর খাসজমি বিক্রি করে এই চক্র ৫ কোটি টাকা, ছোট ফেনী নদী এবং বামনী নদী থেকে গত ৮ মাসে অবৈধ ভাবে ৬ কোটি টাকার বালু উত্তোল করে হাতিয়ে নিয়েছে। এতে বিভিন্ন স্থানে নদী ভাঙন সৃষ্টি হচ্ছে।
স্থানীয়রা অভিযোগ করে আরো বলেন, ২০১৫ সালে নির্মিত কোম্পানীগঞ্জের পর্যটন এলাকা হিসেবে খ্যাত ১৭৫ কোটি টাকায় নির্মিত মুছাপুর ক্লোজার বাঁধ ও সুইস গেইট, প্রধান সড়ক নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে। এর ফলে এলাকার ফেনী নদীর পাশে থাকা পাকা সড়কে ভাঙন দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি হাজার হাজার একর ফসলি জমি ভেঙে নদীতে বিলীন হওয়ার উপক্রম হবে।
এর আগেও ছোট ফেনী থেকে বালু উত্তোলনের ফলে পাকা সড়কে ভাঙ্গন দেখা দেয়। আশপাশের কয়েক হাজার একর কৃষিজমি, শতাধিক বসতবাড়ি ও এলাকার জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। এ ছাড়া বালু উত্তোলনের ফলে মাছের আবাস ও প্রজননস্থল বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
গত সোমবার সরেজমিনে দেখা গেছে, মুছাপুর ক্লোজার উত্তর মাথায় আর্দশ গ্রামের শৈবালে, মুছাপুর ক্লোজারের পূর্বে নতুন চরের মাথায়, মুছাপুর ক্লোজারের দক্ষিণে ফরেস্ট বাগানের পাশে ও জেলে বাড়ির একটু আগে ফেনী নদীর ২টি স্পট থেকে অবাধে ড্রেজার মেশিন দিয়ে অবাধে বালু উত্তোলন চলছে। মুছাপুর ক্লোজার সংলগ্ন ছোট ফেনী নদী থেকে ফেনীর সোনাগাজী এলাকার একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে উত্তোলন করা হচ্ছে কোটি টাকার বালু।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত বছরের ৩১ জুলাই কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় বালু উত্তোলনকে কেন্দ্র করে রামপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সিরাজীস সালেকিন রিমন ও মুছাপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আইয়ুব আলী মধ্যে হট্রগোল ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে।
উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় মুছাপুর ক্লোজার সংলগ্ন ছোট ফেনী নদী থেকে চেয়ারম্যান মো.আইয়ুব আলীর যোগসাজশে বালু উত্তোলনের অভিযোগ তুলেন সেতু মন্ত্রীর ভাগনে রামপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সিরাজীস সালেকীন রিমন। তখন দুই ইউপি চেয়ারম্যানের মধ্যে হট্রগোল ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এই ঘটনার একটি ভিডিও চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়ে।
অপরদিকে, গত বছরের ২৬ আগস্ট মুছাপুর ইউনিয়নের চৌধুরী বাজারে সর্বস্তরের জনগণের ব্যানারে খাস জমি দখল ও বালু উত্তোলনের প্রতিবাদে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন, উপজেলা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ও মুছাপুর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম চৌধুরী।
লিখিত বক্তব্যে তিনি অভিযোগ করেন, আইয়ুব আলী জননেত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নাম ভাঙিয়ে লোকজনকে ভূমিহীন সাজিয়ে মুছাপুর ইউনিয়নের মুছাপুর ক্লোজারঘাট পর্যটন এলাকার সরকারি খাসজমি বন্দোবস্ত নেন তিনি। ওই জমি পরে ওইসব লোকের কাছে টাকার বিনিময়ে বিক্রি করেন। একই সাথে ছোট ফেনী নদী থেকে অবৈধ ভাবে বালু উত্তোলন শুরু করেন।
এ বিষয়ে স্থানীয় বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিবাদ শুরু হলে উপজেলা ভূমি প্রশাসনের লোকজন সেখানে অবৈধ দখল উচ্ছেদ করতে গিয়ে উল্টো আইয়ুব আলীর বাহিনীর হাতে হামলার শিকার হন। সেখানে ইউপি চেয়ারম্যান আলীর জলদস্যু বাহিনীর সদস্য জাহাঙ্গীর মেম্বার ও তার ভাই জলদস্যু জালালের ইন্ধনে ওই ঘটনা ঘটে। কিন্তু এ ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তিনি অভিযোগ করে আরও বলেন, বরং পার পেয়ে এই ভূমিদস্যু, বালু খেকো সিন্ডিকেট ড্রেজার মেশিন বসিয়ে তাদের কার্যক্রম আরও দ্রুত গতিতে চালিয়ে যাচ্ছে বীরদর্পে।
স্থানীয় ইউপি সদস্য (মেম্বার) মো. আলী আজগর জাহাঙ্গীর ও তার ভাই জালাল বলেন, তারা খাস জমি দখল ও বালু উত্তোলনের সাথে জড়িত নেই। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মুছাপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়াম্যান আইয়ুব আলী অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দেয়।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মেজবাউল হক ভূঁইয়া বলেন, সেখানে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য কেউ একজন মাটি নেওয়ার চেষ্টা করছে এই রকম খবর আমরা পেয়েছি। সেটা অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ব্যক্তি বা কাউকে দোষারোপ করতে হলে আমার পর্যায় থেকে সুনির্দিষ্ট তদন্ত প্রতিবেদন বা প্রমাণসহ কথা বলতে হবে। যার কারণে এই বিষয়ে আপনাকে সুনির্দিষ্ট কিছু বলার মত আমার কাছে কোন তথ্য নেই। একাধিকবার খাস জায়গায় গড়ে উঠা ঘর গুলো ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে এবং বালু উত্তোলন বন্ধে ২০বার অভিযান চালানো হয়েছে।
খাস জমি দখল ও অবৈধ ভাবে বালু উত্তোলন বন্ধে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার সত্যতা নিশ্চিত করে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চেয়রম্যান মোহাম্মদ সাহাব উদ্দিন বলেন, খাস জমি দখল ও অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধে বৃহস্পতিবার বিকেলের দিকে মুছাপুর ক্লোজারে বৈঠক ডাকা হয়েছে। আমি এই সব অনিয়ম বন্ধে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। দেখা যাক কি হয়। এ বিষয়ে জানতে নোয়াখালী জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমানের মোবাইলফোনে কল করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।
এএজেড