রাঙ্গুনিয়ায় প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করে চলছে অবৈধ ইটভাটা
ইটভাটার নগরীতে পরিণত হয়েছে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলা। এ উপজেলায় গড়ে উঠেছে প্রায় শতাধিক অবৈধ ইটভাটা। যার নেই কোনো বৈধ কাগজপত্র। জেলা ও উপজেলা, বন বিভাগ, থানা, পুলিশ ফাঁড়ি, রেঞ্জ, বনবিট অফিস, জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক দলের স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাসহ বিভিন্ন দপ্তরকে ম্যানেজ করে এসব ইটভাটা পরিচালিত হচ্ছে বলে জানান উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের আবদুল মোতালিব নামে এক ইটভাটার মালিক।
চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় ইটভাটা আছে ৬৯টি। এর মধ্যে ৬৬টি ইটভাটা অবৈধ। আবার যেসব ইটভাটা বৈধ হিসেবে অনুমোদন পেয়েছে সেগুলোতেও আছে নানা শুভংকরের ফাঁকি।
স্থানীয়রা জানান, উপজেলার ১৫ ইউনিয়নের মধ্যে ১২ ইউনিয়নজুড়েই রয়েছে শতাধিক ইটভাটা। কেবলমাত্র ইসলামপুর, দক্ষিণ রাজানগর এবং ১নং রাজানগর তিন ইউনিয়নেই রয়েছে প্রায় সত্তরোর্ধ্ব ইটাভাটা। অন্যান্য ইউনিয়নসহ এখানে প্রায় ১৩০টির মতো ইটভাটা রয়েছে, যার অধিকাংশ ভাটার নেই কোনো বৈধ কাগজপত্র। আবার এসব ইটভাটার বেশিরভাগ গড়ে উঠেছে পাহাড়ের পাদদেশে ও ফসলি জমিতে। এসব ভাটায় সংরক্ষিত ও অশ্রেণিভুক্ত বন থেকে শতকোটি টাকার কাঠ কেটে পুড়ানো হচ্ছে জ্বালানি হিসেবে। একই সঙ্গে ইট তৈরির কাজে ব্যবহারের জন্য যত্রতত্রভাবে মাটি কাটায় বিরানভূমিতে পরিণত হচ্ছে রাঙ্গুনিয়ার সংরক্ষিত বন ও পাহাড়। অনেক ইটভাটা রয়েছে জনবসতিপূর্ণ এলাকায় এবং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশে। এ ছাড়া কর্ণফুলী নদীর পাড় ঘেঁষেও অনেক ইটভাটা গড়ে উঠেছে। ফলে প্রাকৃতিক বনজ সম্পদ ধ্বংসের পাশাপাশি ক্রমশ ভারসাম্য হারাচ্ছে পরিবেশের।
উপজেলার বিভিন্ন ভাটা ঘুরে দেখা গেছে, শতাধিক ইটভাটায় ইট পোড়ানোর কার্যক্রম শুরু হয়েছে। প্রায় সব ইটভাটায় কয়লার পরিবর্তে অবৈধ জ্বালানি কাঠের ব্যবহার চলছে অবাধে। প্রত্যেক ভাটায় মজুদ রাখা আছে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি কাঠ। আর এসব জ্বালানি কাঠের যোগানকে কেন্দ্র করে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে পাচারকারীরা। সংরক্ষিত বনাঞ্চল এবং সামাজিক বনায়নের বাগান উজাড় করে তৈরি করা হচ্ছে জ্বালানি কাঠ। অসাধু বন কর্মকর্তদের যোগসাজশে বিভিন্নস্থানে ডিপোতে মজুদ করে সেখান থেকে কাঠ যাচ্ছে ইটের ভাটায়। বিশেষ করে কাপ্তাইয়ের কর্ণফুলী রেঞ্জের আড়াছড়ি, চিৎমরম, রামপাহাড়, সীতাপাহাড় এবং কাপ্তাই পাল্পউড বন বিভাগের রাজস্থলী, বান্দরবান, বনাঞ্চলের বাগানের বৃক্ষ জ্বালানি কাঠ করে সরফভাটার মিরেরখীল, ভুমিরখীল, রাইখালী, কোদালা, পুর্ব কোদালা, শিলক থেকে কাঠ এসে কর্ণফুলী নদীর তীরে এবং চন্দ্রঘোনা দেওয়ানজীরহাট খেয়াঘাটের কাছে প্রকাশ্যে মজুদ করে গড়ে তোলা হয়েছে চোরাই জ্বালানি কাঠের বড় বড় ডিপো। এই ডিপোগুলো থেকে চাঁদের গাড়িযোগে চোরাই জ্বালানি কাঠ পাচার করা হচ্ছে উপজেলার বিভিন্ন ইটভাটায়। নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের জনবসতিপূর্ণ এলাকায় অবৈধভাবে গড়ে উঠা এসব ভাটার কালো বিষাক্ত ধোয়ায় স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ। এমনকি এসব ইটভাটার কারণে অনেকে বসতবাড়ি ছেড়ে অন্যত্রে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছেন।
সম্প্রতি হাইকোর্ট থেকে দেওয়া এক নির্দেশনায় বলা হয়, গত ১৩ নভেম্বর দেশের সব জেলার অবৈধ ইটভাটা ৭ দিনের মধ্যে বন্ধ করতে হবে। এমন নির্দেশনা পেয়েও পর্যাপ্ত জনবল এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম না থাকার অজুহাতে ইটভাটা বন্ধে অভিযান পরিচালনা করা যাচ্ছে না বলে দাবি পরিবেশ অধিদপ্তর কর্মকর্তাদের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইটভাটার এক মালিক বলেন, ‘প্রশাসন, বন বিভাগ, পুলিশ ফাঁড়ি, বিট অফিস, সাংবাদিক, জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক দলের নেতাসহ সব দপ্তরে ক্যাটাগরিনুযায়ী স্তরে স্তরে ম্যানেজ করে ইটভাটা পরিচালনা করছি। পত্রিকায় এসব নিয়ে লেখালেখি করলে প্রশাসন ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে কিছু জরিমানা আদায় করবে। এ ছাড়া কোনো ইটভাটা বন্ধ করে দেওয়ার নজির নেই।’
রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আতাউল গণি ওসমানী জানান, ইটভাটার সংখ্যা ও সঠিক তথ্য তার অফিসে নেই। ইটভাটার অনুমতি ও ছাড়পত্র দেওয়া জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের এখতিয়ার। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য ইটভাটায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান অব্যাহত আছে।’
চট্টগ্রাম জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মো.মুফিদুল আলম বলেন, ‘অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত আছে। তবে জনবল সংকটের কারণে যতটুকু অভিযান পরিচালনার প্রয়োজন ততটুকু করা হচ্ছে না।’
এসজি