২১ লঞ্চ কর্তৃপক্ষের মামলা বিচারাধীন, তবুও নৌপথে বিশৃঙ্খলা
ঢাকা-বরিশাল নৌপথে চলাচলকারী ২১টি লঞ্চ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা বিচারাধীন। তারপরও প্রতি বছর লঞ্চ কর্তৃপক্ষের নিয়ম ভাঙা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। অতিরিক্ত ভাড়া, পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাব, যাত্রীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার এসব নিত্য দিনের ঘটনা। লঞ্চগুলোর দেখাদেখি যাত্রীবাহী অন্য নৌ পরিবহনগুলোতেও এমন ঘটনার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মামলার ভয় বা যাত্রীদের জীবনের ঝুঁকি কোনো কিছুই থামাতে পারছে না যাত্রীবাহী নৌ পরিবহনগুলোর কতৃপক্ষের দৌরাত্ম্য। শুধু আইনের প্রয়োগ নয় সবার সচেতনতা ও দায়িত্ববোধই শৃঙ্খলা ফেরাতে পারে নৌপথে।
বরিশাল অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বরিশাল-ঢাকা নৌ রুটে ২২টি লঞ্চের কাগজপত্র থাকলেও বর্তমানে ১৮টি লঞ্চ চলাচল করছে। এর মধ্যে ৪টি লঞ্চ বর্তমানে চলাচল বন্ধ রেখেছে। এ ছাড়া ১০টি ভায়া লঞ্চ এ রুটে চলাচল করে।
বরিশাল অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কতৃপক্ষের টিআই শামসুদ্দিন খান জানান, 'বরিশাল ঢাকা রুটে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে আমরা সব সময় কাজ করে যাচ্ছি। বর্তমানে বরিশাল ঢাকা রুটে ১৮টি ও ভায়া ১০টি লঞ্চ চলাচল করে। আমরা নিয়মিত লঞ্চগুলোর তদারকি করি। শৃঙ্খলা না মানলে মামলা দিয়ে থাকি। বর্তমানে বরিশাল অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নৌ আদালতে যাত্রীবাহী কিছু নৌ পরিবহনের বিরুদ্ধে ২১টি মামলা চলমান আছে। এ সকল মামলার বেশিরভাগ আসামি চালক, মালিক, মাস্টার, সুপার ভাইজার। শুধু যাত্রীবাহী লঞ্চ নয় স্পিডবোট, বাল্কহেড, ট্রলারসহ অন্যান্য নৌযানের বিরুদ্ধেও আমরা মামালা দিয়ে থাকি।'
তিনি আরও জানান, ঢাকা-বরিশাল রুটের লঞ্চ এমভি পারাবত-১০ লঞ্চে ৩টি, এমভি পারাবত-১১ লঞ্চে ১টি, এমভি সুন্দরবন-১১ লঞ্চে ১টি, এমভি ফারহান-৮ লঞ্চে ১টি, এমভি মানামী লঞ্চে ১টি, এমভি কুয়াকাটা-২ লঞ্চে ২টি, এমভি অ্যাডভেঞ্চার-১ লঞ্চে ১টি, এমভি পরাবত-১২ লঞ্চে ১টি, এমভি টিপু-১২ লঞ্চে ১টি মামলা চলমান আছে। এ ছাড়া বানারীপাড়া-তরুরবাজার রুটের লঞ্চ এমএল রানা ১টি, ঢাকা-ভান্ডারিয়া রুটের এমভি মনিং সান লঞ্চে ১টি, এমভি বিউটি অব লইনছরি লঞ্চে ১টি, ঢাকা-চরমোনাই রুটের এমভি কাজল-৭ লঞ্চে ১টি, ঢাকা-বরগুনা ভায়া বরিশাল রুটের এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে ১টি মামলা চলমান আছে। এ ছাড়া যাত্রীবাহী ট্রলার নওরীন, মিরাজ এক্সপ্রেস, আল আরাফাত ও আল্লাহ ভরসার নামে একটি করে মামলা চলমান।
সচেতন নাগরিক কমিটি বরিশাল জেলা কমিটির সভাপতি অধ্যাপক শাহ সাজেদা বলেন, 'ঢাকা-বরিশাল রুটের নৌযানে কেন এত মামলা দিতে হবে অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কতৃপক্ষকে? কেন মালিক পক্ষ সচেতন হবে না? একের পর এক দুর্ঘটনা তো ঘটেই চলছে। কতৃপক্ষ আইন অনুসারে মামলা করলেও গা ছাড়া ভাব নৌ পরিবহন মালিক ও কর্মচারীদের। দুর্ঘটনা তো ঘটবেই কিন্তু যাতে সংখ্যা কমিয়ে আনা যায় সে বিষয়ে আমাদের সচেতনতা বাড়াতে হবে। চালক, মাস্টার, সুপার ভাইজারদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়া নিয়মিত নজরদারি প্রয়োজন অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কতৃপক্ষের।'
অভ্যন্তরীণ লঞ্চ মালিক সমিতির সহসভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু জানান, আমারা সব সময় স্বচ্ছ থাকার চেষ্টা করি। কিন্তু সম্প্রতি সাংবাদিকদের উপর যে হামলার ঘটনা ঘটেছে আমি সে ঘটানার নিন্দা জানাই। এ ছাড়া যে সকল মামালা লঞ্চে দেওয়া হয়েছে সেগুলো মেরিন কোর্টে বিচারাধীন আছে। অনেক সময় কোনো কারণ ছাড়াও লঞ্চে মামলা দেওয়া হয়। আমারা যারা ব্যবসা করি সব সময় যাত্রীদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করি। এ ছাড়া নিজেরা স্বচ্ছ থাকার চেষ্টা করি।
বরিশাল অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কতৃপক্ষের যুগ্ম পরিচালক ও বরিশালের নৌবন্দর কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'আমারা স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করছি। নৌ পথে বিশৃঙ্খলা পেলে আমরা মামালা দেওয়াসহ তাৎক্ষণিক যে ব্যবস্থা প্রয়োজন তা গ্রহণ করি। আমরা চাই নৌ পথে শৃঙ্খলা ফিরে আসুক। বর্তমানে যে মামলাগুলো মেরিন কোর্টে বিচারাধীন আছে সেই মামলাগুলোর বিষয়ে কোর্ট সিদ্ধান্ত নেবে। আমরা চাই ঢাকা-বরিশাল রুট একটি সুন্দর ও সুশৃঙ্খল রুটে পরিণত হোক।'
প্রসঙ্গত, গত বছর ঝালকাঠির অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় লঞ্চ কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসন নড়েচড়ে বসলেও লঞ্চে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব হয়নি। বছরের প্রথম মাসের ৯ তারিখ ঢাকা থেকে বরিশাল ফেরার পথে সুরভী-৯ লঞ্চের সাইলেন্সার পাইপ থেকে ধোঁয়া বের হওয়ার ঘটনায় যাত্রীরা আতঙ্কিত হয়ে পরে। এ সময় যেসব যাত্রীরা ঘটনাটি মোবাইলে ধারণ করে ফেসবুকে দিয়েছিলেন সেই সব যাত্রীদের খুঁজে মারধর করে লঞ্চ কর্তৃপক্ষ। মারধরের ঘটনায় ছবি তুলতে গেলে দুই টেলিভিশনের চিত্র সাংবাদিকও মারধরের শিকার হন। এ ঘটনায় আহত ২ সাংবাদিক ও নৌবন্দর কর্মকর্তা থানায় লিখিত অভিযোগ দিলেও কোনো আইনি পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। যদিও এরপর লঞ্চ মালিক লিখিতভাবে সাংবাদিকদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং অভিযুক্তদের চাকরিচ্যুত করেছেন বলে জানান কর্তৃপক্ষ।
এসএম/টিটি