রসিক নির্বাচনে নৌকার ভরাডুবির নেপথ্যে
রংপুর সিটি করর্পোরেশন নির্বাচনে রংপুর সিটি করর্পোরেশন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নয় বাকি সাত প্রার্থীরও ভরাডুবি হয়েছে। জাতীয় পার্টির (জাপা) মেয়র প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফার কাছে ধরাশায়ী হয়েছেন বাকি সাত প্রার্থীরা। সিটি নির্বাচনের ফলাফলে মোস্তফার ধারের কাছে পৌঁছাতে পারেননি কোনো প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থী।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীর এমন পরাজয়ে শুরু হয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনার ঝড়। ভরাডুবির জন্য তৃণমূল নেতাকর্মীদের নিষ্ক্রিয়তা, যোগ্য প্রার্থী বাছাই না করা, সময় স্বল্পতাসহ নানা কারণকে দায়ী করছেন বিশ্লেষকরা।
এ নির্বাচনে চার লাখ ২৬ হাজার ৪৬৯ ভোটারের মধ্যে দুই লাখ ৮০ হাজার ৯৭২ জন ভোটার তাদের ভোট দিয়েছেন। ১ লাখ ৪৬ হাজার ৭৯৮ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন জাতীয় পার্টির মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের মেয়র প্রার্থী হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া ২২ হাজার ৩০৬ ভোট পেয়ে জামানত হারিয়েছেন।
নির্বাচনে ৯ মেয়র প্রার্থীর মধ্যে চতুর্থ হয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের মেয়র প্রার্থী। এ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের মেয়র প্রার্থীর এমন শোচনীয় পরাজয়ে রংপুরে উঠেছে নানান আলোচনার ঝড়। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা প্রার্থীর গ্রহণ যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। প্রার্থীর সঙ্গে নগর বাসীর জনসম্পৃক্ততা না থাকাসহ একেবারে অপরিচিত বলে অভিযোগ এনেছেন।
প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থীরা বলছেন, নিজ দলের সমর্থকদের ভোটই পাননি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের মেয়র প্রার্থী। ভোট পেলে এমন ভরা ডুবি হতো না ভোটের দিন বিভিন্ন কেন্দ্র ঘুরে জানা গেছে, অনেক কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর পোলিং এজেন্টও ছিল না।
গত মঙ্গলবার রংপুর সিটি নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মোস্তাফিজার রহমান এক লাখ ৪৬ হাজার ৭৯৮ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থী ছিলেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমিরুজ্জামান। তিনি ভোট পেয়েছেন ৪৯ হাজার ৮৯২ ভোট। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী লতিফুর রহমান স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে হাতি প্রতীক ৩৩ হাজার ৮৮৩ ভোট পেয়ে তৃতীয় অবস্থানে আছেন।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের মেয়র প্রার্থী হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া ২২ হাজার ৩০৬ ভোট পেয়ে চতুর্থ হয়েছেন। তিনি পেয়েছেন সাত দশমিক ৯৪ শতাংশ ভোট। নির্বাচনে ২২ হাজার ৪৭৮ ভোট পেলে জামানত ফেরত পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতেন। এ ক্ষেত্রে ১৭২ ভোট কম পেয়ে জামানত হারিয়েছেন তিনি।
রংপুর নগরবাসী বলছেন, আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি ছিলেন। কখনো তাকে জনগণের পাশে তাকে দেখা যায়নি নগরবাসী চেনেন না। নির্বাচনের আগে তার দৃশ্যমান কোনও কর্মকাণ্ড ছিল না তার। এছাড়া দলের নেতাকর্মীরা তাকে ভোট না দেওয়ায় শোচনীয় পরাজয় হয়েছে।
আওয়ামী লীগের মহানগর এবং ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাকর্মী ও ভোটাররা বলছেন, ডালিয়া প্রার্থী হবেন এবং নির্বাচন করবেন- এমন কোনও প্রস্ততি ছিল না। নির্বাচনে আগে তিনি কখনও ২০৫ বর্গ কিলোমিটারের রংপুর সিটি করর্পোরেশনে কোন এলাকায় যাননি। কোনও সামাজিক বা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে কেউ দেখেননি।
অপরদিকে, আওয়ামী লীগের যে নেতারা নির্বাচনের দুই বছর আগে থেকে পুরো সিটি করর্পোরেশন এলাকায় গণসংযোগ করেছেন, দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন, জনগণের কাছাকাছি থাকার জন্য কাজ করেছেন- তাদের কাউকেই মেয়র পদে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। মনোনয়ন পাওয়া ডালিয়া দলের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করে কাজ করার কোনও চেষ্টাই চালাননি।
ক্ষমতাসীন দলটির তৃণমূল নেতাকর্মীদের অভিযোগ, তৃণমূল পর্যায়ের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করার জন্য কোন চেষ্টা তিনি করেননি। ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ সহ অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের নির্বাচনি কাজে নিয়োজিত করার উদ্যোগও নেননি। নির্বাচন পরিচালনার জন্য তিনি প্রধান নির্বাচনি এজেন্ট হিসেবে কাউকে নিয়োগ করেননি।
এ নিয়ে মহানগর আওয়ামী লীগের নেতারা ক্ষুব্ধ বলে জান গেছে। এমনকি নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন করে দলের নেতাকর্মীদের একটা প্ল্যাটফর্মে আনার কাজটি তিনি করেননি। শুধু তাই নয় এই বিশাল সিটি করর্পোরেশনে ওয়ার্ডভিত্তিক কিংবা ভোট কেন্দ্র ভিত্তিক নির্বচনী কোন কমিটি গঠন করা হয়নি।
সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব না থাকা এবং দলের নেতা কর্মীদের ন্যুনতম ব্যয় নির্বাহের কোনও ব্যবস্থা করা হয়নি বলে এমনটা হয়েছে। এমন কারনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিশাল কর্মী বাহিনীকে কাজে লাগানোর বাস্তবমুখী কোন পদক্ষেপ আওয়ামী লীগ প্রার্থী নেননি।
নির্বাচনের দিন সরেজমিনে ভোট কেন্দ্রে ঘুরে দেখা গেছে, ২২৯টি ভোটকেন্দ্রের কমপক্ষে শ'দেড়েক কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ মেয়র প্রার্থীর কোনও পোলিং এজেন্ট ছিল না। যারা ছিলেন, তারা ভোট চলাকালেই চলে গেছেন। এমনকি অনেক কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের মেয়র প্রার্থী ডালিয়ার কোনও পোস্টার দেখা যায়নি।
রংপুর কোতোয়ালি মেট্রো আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি লতিফুর রহমান নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার কিছু দিন আগে থেকে মেয়র পদে নির্বাচন করার জন্য প্রচারণা চালিয়েছেন। সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে ও গোপনে অংশ নেন। দলীয় নির্দেশ না মেনে নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় বহিষ্কার হওয়ার পরও তার সঙ্গে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেতাকর্মীকে প্রচার-প্রচারণায় দেখা গেছে।
নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী লতিফুর রহমান পুরো সিটি করর্পোরেশন এলাকায় ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা করে তার নামটা প্রতি এলাকায় ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হন।সে তুলনায় আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর প্রচারণা ছিল একেবারে নগণ্য। নির্বাচনে এই বিদ্রোহী প্রার্থী যে আবেদন সৃষ্টি করেছেন তার ১০ ভাগও আওয়ামী লীগ প্রার্থী করতে পারেননি বলে তৃণমূল নেতাকর্মীদের অভিযোগ। এর প্রমাণ মিলেছে ভোটে। আওয়ামী লীগ প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হলেও বিদ্রোহী প্রার্থীর জামানত ঠিক আছে।
রংপুর সিটি করর্পোরেশন এলাকার ছয় থানা ও ওয়ার্ড কমিটির একাধিক নেতা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, প্রথমতো আওয়ামী লীগের প্রার্থী প্রচার-প্রচারণা করার সুযোগ পেয়েছেন মাত্র ১৩ দিন। দলের নেতাকর্মীরা ভোট দিলেও দলের সমর্থক সহ অনেকেই ভোট দেননি আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে।
রংপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তুষার কান্তি মন্ডল বলেন, বিগত সিটি করর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী প্রয়াত শরফুদ্দিন আহামেদ ঝন্টু ৬৪ হাজার ভোট পেয়েছিলেন। তার সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা ছিল। এবারের প্রার্থীর জন সম্পৃক্ততা না থাকা, ভোটারদের কাছে যেতে না পারা সহ নানান কারণে শোচনীয় পরাজিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ ও বিদ্রোহী প্রার্থীর ভোট যোগ করলে ভোটের পরিমাণ প্রায় সমান বলে তিনি দাবি করেন।
নির্বাচিত মেয়র মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা বলেন, আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সঙ্গে জনগণের কোনও সম্পর্ক ছিল না তাকে নগরবাসী ঠিকমত চেনেন না। অনেকে নামও জানেন না। দলের নেতাকর্মীরা তাকে ভোট দেননি এবং তার পক্ষে কাজ করেননি। দলের নেতাকর্মীরা ভোট দিলে তার জামানত বাজেয়াপ্ত হতো না। এর দায় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা এড়াতে পারে না।
এব্যাপারে জানতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের পরাজিত মেয়র প্রার্থী হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়াকে বৃহস্পতিবার সন্ধায় মোবাইল নম্বরে একাধিক বার মোবাইল করলেও তিনি রিসিভ করেননি।
এএজেড