বাইরে দালালচক্র, ভেতরে কাজ করে আনসার
দালালচক্র এবং অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজসে মানিকগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসে অনিয়মের এক বেড়াজাল সৃষ্টি হয়েছে এমন অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। নিরাপত্তা এবং অফিস সরঞ্জাম দেখভালের দায়িত্বে থাকা আসনার সদস্যরাও জড়িয়ে পড়ছে এমন অনিয়মে। অফিসকক্ষে যে কাজ কর্মকর্তাদের করার কথা সেগুলোতেও বসে পড়েছেন আনসার সদস্যরা।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ এবং মালামাল হেফাজত করা ছাড়া পাসপোর্ট অফিসে কোনো কাজ নেই আনসার সদস্যদের। এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে অতি উৎসাহী হয়ে যদি কেউ অফিশিয়াল কোনো কাজ করে তবে তা ঠিক নয় বলে জানিয়েছেন জেলা আনসার কমান্ডার মো. এফতেখারুল ইসলাম।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পাসপোর্ট অফিসের একটি কক্ষে মেহেদী হাসান নামের এক আনসার সদস্য কম্পিউটারে দপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ নথি আপডেট করছেন। স্ক্যান করছে পাসপোর্ট সংক্রান্ত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাগজ। এ বিষয়টি নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, আমি নতুন এসেছি। দেখছিলাম কাজগুলো পারি কি না। এগুলো কি আপনার কাজ- জানতে চাইলে তিনি কোনো সদ্যুত্তর দিতে পারেননি।
দালালদের মারফত পাওয়া এই কাজগুলোই সমাধানের চেষ্টা করছিলেন তিনি। অনিয়মের এই বেড়াজালে সেবাগ্রহীতারা ভোগান্তির শিকার হচ্ছে শক্তিশালী সিন্ডিকেটের হাতে। পাসপোর্ট পরিচালকের দায়সারা জবাব কোনো সময়ই কমাতে পারেনি ভোগান্তি। এখানে কপ্লেক্সের ভেতর-বাইরে প্রকাশ্যে চলে অনিয়ম।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে অভিযানে গ্রেপ্তার হয় অনেকেই। জামিনে এসে পুনরায় শুরু করে পাসপোর্ট বাণিজ্য। পাসপোর্ট অফিসের সামনে কম্পিউটার, প্রিন্টার আর ফটোকপি নিয়ে বসেছে ১০টির মতো দোকান। এসব দোকান থেকেই চলে সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ।
অভিযোগ রয়েছে, নতুন পাসপোর্টের জন্য সব কাগজপত্র ঠিকঠাক দিলেও কর্মকর্তারা নাম কিংবা ঠিকানার জায়গায় সজ্ঞানেই ভুল করে। সেই ভুলগুলো নিয়ে আবার অফিসে আসলে করা হয় নানা তালবাহানা। তখন সেবাগ্রহীতারা বাধ্য হয়েই যেতে হয় দালালদের কাছে। দালালরা অতিরিক্ত টাকার বিনিময়ে কাজ করে দেওয়ার চুক্তি নেয়। কারও কারও পাসপোর্ট জরুরি প্রয়োজন থাকলে দালালরা তার সমস্যা বুঝে দ্রুত সময়ে কাজ করে দেওয়ার জন্য অতিরিক্ত আরও দ্বিগুণ-তিনগুণ টাকা দাবি করে। বাধ্য হয়েই সে পথে হাঁটতে হয় সেবাগ্রহীতাদের।
প্রবাসীদের অনেকের পাসপোর্ট কার্যক্রম সহজীকরণ না করার ফলে ভিসার মেয়াদ চলে যায়। এমন সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পাসপোর্ট অফিসের দায়িত্বরতরা সেবাগ্রহীতাদের ঘুরাতে থাকে। একদিন-দুইদিন ঘুরতে ঘুরতে সেবাগ্রহীতারা বাধ্য হয়েই দালালদের শরণাপন্ন হয়। দালালদের এই কাজগুলো অফিসে থাকা কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজসে উৎকোচের বিনিময়ে সমাধান হয়ে যায়।
জানা গেছে, সারা পাসপোর্ট অফিস সিসি ক্যামেরার আওতাভুক্ত। তাই কর্মকর্তারা সরাসরি সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে উৎকোচ নিতে পারে না। সার্ভারে সমস্যা, সময় লাগবে, এখন না তখন এমন নানা অজুহাতে ঘুরাতে থাকে সেবাগ্রহীতাদের। একপর্যায়ে বাধ্য হয়েই দালালদের শরণাপন্ন হতে হয় সেবা নিতে আসা ব্যক্তিদের।
আনোয়ার নামের এক ভুক্তভোগী বলেন, সরকারি সব অফিসেই এখন লেখা থাকে ‘আমি ও আমার অফিস দুর্নীতিমুক্ত’ কিন্তু এই পাসপোর্ট অফিসই একমাত্র এই বাক্যটা দেয়ালে লিখতে পারে না। কারণ তারা জানে তারা দুর্নীতি করছে। গুটিকয়েক অসৎ লোকের জন্য সারা জেলার দুর্নাম। জেলাবাসী ভোগান্তির শিকার।
তার সঙ্গে আসা আরও কয়েকজন পাসপোর্ট এলাকায় দালালদের এমন বাণিজ্য রুখতে প্রশাসনের সার্বক্ষণিক মনিটরিং চায়।
জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, জনশক্তি রপ্তানিতে সারা দেশে মানিকগঞ্জের অবস্থান প্রথম সারিতে। সেই জেলা হিসেবে পাসপোর্ট করতে গিয়ে যেই ভোগান্তি সেটা আসলেই দুঃখজনক। যেকোনো উপায়ে ভোগান্তি কমিয়ে আনা দরকার।
মানিকগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক নাহিদ নেওয়াজ বলেন, বিদেশগামীরা স্বল্প শিক্ষিত হওয়ায় বিভিন্ন দোকানে গিয়ে আবেদন পূরণে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করছে। বিদেশগামীরা কোন কোন ক্ষেত্রে দালালদের অতিরিক্ত টাকা দিলেও এর সঙ্গে আমি ও আমার অফিসের কেউ জড়িত নয়।
অফিসকক্ষে আনসার সদস্যরা দাপ্তরিক কাজ করছে এ বিষয়টি স্বীকার করে নাহিদ নেওয়াজ বলেন, জনবল সংকটের কারণে আগে আনসার সদস্যদের দিয়ে স্ক্যানের কাজগুলো করানো হতো। এখন থেকে আর করতে দিচ্ছি না বন্ধ হচ্ছে।
এসজি