তৃণমূলের রাজনীতি: ঠাকুরগাঁও-৩
দলীয় কার্যালয়ে তালা, নেই সন্ধ্যা বাতি দেওয়ার কেউ
ঠাকুরগাঁওয়ে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে তৃণমূলের রাজনীতিতে নিজ নিজ ঘর গোছাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন রাজনৈতিক দলগুলো। জেলা আওয়ামী লীগ ওয়ার্ড থেকে শুরু করে ইউনিয়ন, উপজেলা সম্মেলন প্রায় শেষের দিকে। জেলার তিনটি আসনেই এবার দখলে রাখতে চায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ।
পাশাপাশি দেড়যুগ ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপিও তাদের শক্তির মহড়া দিতে ওয়ার্ড, উপজেলা ও জেলা সম্মেলন করছে। হামলা-মামলা যতই হোক নেতা-কর্মীরা রাজপথে নতুন উদ্যমে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। তৃতীয় শক্তি হিসেবে জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি) ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও তাদের শক্তির জানান দিতে সাংগঠনিক কাঠামো শক্তিশালী করতে আটঘাট বেঁধে মাঠে নেমেছে।
তৃতীয় পর্ব
ঢাকাপ্রকাশ-এর সঙ্গে আলাপচারিতায় ঠাকুরগাঁও জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক রাজিউর রেজা স্বপন চৌধুরী বলেছেন, আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে জাতীয় পার্টি জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে সম্মেলন শুরু করেছি। দলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মানুষের কল্যাণ ও ভাগ্য উন্নয়ন এবং আধুনিক বাংলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করেছেন। এজন্য দেশের মানুষ জাতীয় পার্টির সঙ্গে রয়েছে। আগের চেয়ে দলের নেতা-কর্মীরা এখন আরও সুসংগঠিত।
স্বপন চৌধুরী বলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে যে হানাহানি এবং তাদের উগ্রতার ভিত্তিতে মানুষ চায় একটি সুষ্ঠু সুন্দর পরিবেশ, রাজনীতি, সমাজ ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা-চিকিৎসা ব্যবস্থা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা। যেটি সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের ৯ বছরের শাসনামলে নিশ্চিত করেছিলেন। নয় বছর যে তিনি রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন সেটি একটি স্বর্ণযুগ ছিল, মানুষ আজও সেটা মনে রেখেছেন বিধায় জাতীয় পার্টির সঙ্গে থাকতে চান।
মহাজোটের কারণে জাতীয় পার্টি সাংগঠনিকভাবে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে স্বীকার করে তিনি বলেন, ঠাকুরগাঁও সদরে মহাজোটের প্রার্থীকে ভোটে নির্বাচিত ও দলীয়ভাবে নির্বাচন না করার কারণে আমরা কিছু কিছু অঞ্চলে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে পিছিয়ে রয়েছি। তবে আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি যদি মহাজোটভিত্তিক নির্বাচনে অংশ না নেয় তাহলে পল্লীবন্ধুর লাঙ্গল মার্কার প্রার্থী হিসেবে আমাকেই ঘোষণা করেছেন।
আর দল যদি এককভাবে নির্বাচনে অংশ নেন তাহলে আমিই ঠাকুরগাঁও-১ আসনে লড়ব। এর আগেও দল থেকে আমাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল কিন্তু মহাজোটের কারণে সেসময় আমি মনোনয়ন প্রত্যাহার করেছিলাম। সেই লক্ষ্যে সাংগঠনিক কাঠামো মাথায় রেখে আমি মাঠে কাজ করছি।
তিনি আরও বলেন, ঠাকুরগাঁও জেলাকে রূপান্তারিত করতে গিয়ে ডিসি অফিস, জজ কোর্ট, উপজেলা ব্যবস্থা, জেলা পরিষদ ব্যবস্থা, আধুনিক হাসপাতাল, এবং রেডিও সেন্টার, টিভি সেন্টার, সার্কিট হাউজ, এলজিইডি, সরকারি কলেজ, পীরগঞ্জ সরকারি কলেজসহ হাজারো লক্ষ্য উন্নয়ন তিনি ঠাকুরগাঁওয়ে করেছেন। বাংলাদেশের সর্বত্রই তিনি যে উন্নয়ন করেছেন ঠাকুরগাঁও জেলায় সেভাবেই উন্নয়ন করেছেন পল্লীবন্ধু।
এ দেশে একমাত্র জাতীয় পার্টিই উন্নয়ন করেছে। অন্য কোনো দল এ দেশে মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারেনি। তাই আজও মানুষ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টির লাঙ্গল মার্কার কথাই বলেন। নির্বাচনে লাঙ্গল মার্কার কোনো বিকল্প থাকবে না।
জাতীয় পার্টির এই নেতা বলেন, ঠাকুরগাঁওয়ে যা দেখছেন সবই কিন্তু তার আমলেই হয়েছে। সেই জন্য দেশের মানুষ জাতীয় পার্টির দিকে এখনো তাকিয়ে আছে। লাঙ্গলকে ভোট দিতে চাই। আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মহাজোটভিত্তিক নির্বাচন হোক, এককভাবেই হোক, যেভাবেই হোক জাতীয় পার্টির লাঙ্গল মার্কার ভোট এবার করবেই। তবে আমার দল যদি এককভাবে নির্বাচন করে তাহলে তিন আসনেই আমাদের প্রার্থী রয়েছে। আর যদি আমরা জোট-মহাজোটভিত্তিক হই তাহলে সেক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত মোতাবেক যেখানেই যাকে দিবে আমরা সেভাবেই কাজ করব।
অন্যদিকে ঠাকুরগাঁও জাতীয় পার্টির সভাপতি আজিজুল ইসলাম বলেন, আসছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যদি নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হয় তাহলে জেলার প্রায় সব আসনেই চমক দেখাবে জাতীয় পার্টি। ঠাকুরগাঁওয়ে আমরা দল গোছানোর কাজ করে যাচ্ছি। ইউনিয়নগুলোতে সমাবেশ করছি। কমিটিগুলো করে যাচ্ছি। আমাদের দল আগের চেয়ে অনেক শক্তিশালী। আশা করি আগামী নির্বাচনের আগে আমাদের দল পুরো প্রস্তুত থাকবে।
তিনি বলেন, দলে কোনো কোন্দল নেই। জেলায় সব নেতা-কর্মী নেতৃত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে জাতীয় পার্টি তিনটি আসনেই বিজয়ী হবে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটগত নির্বাচন করলেও তারা সঠিক মূল্যায়ন করেনি। তাই দল প্রস্তুতি নিচ্ছে এককভাবে নির্বাচন করার। এই মুহূর্তে ঠাকুরগাঁওয়ের তিনটি আসনেই নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে জাতীয় পার্টি।
ঠাকুরগাঁও জাতীয় পার্টির সহ-সভাপতি হাবিবুর রহমান বলেন, তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা চায় না জাতীয় পার্টি কারও ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হোক। সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তার পরিকল্পিত ও সুষম উন্নয়নের কারণে অমর হয়ে আছেন। দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন জাতীয় পার্টির আমলেই হয়েছে। ওই আমলই উন্নয়নের স্বর্ণযুগ। জাতীয় পার্টি মানেই উন্নয়ন আর সমৃদ্ধি।
এই নেতা বলেন, দুটি দলের দুর্নীতিসহ নানা অনিয়মের কারণে দেশের মানুষ আবার জাতীয় পার্টিকে ক্ষমতায় আনতে চাইছে। জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় এলেই দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। সরকার সমস্যায় পড়লেই জাতীয় পার্টির সহযোগিতা নিয়ে নানা সুযোগ নিয়েছে। ভেতরে ভেতরে পার্টিকে শেষ করার গভীর ষড়যন্ত্র করে চলেছে। ঠাকুরগাঁও জাতীয় পার্টির প্রতিটি ইউনিট অত্যন্ত সুসংগঠিত। আগামী নির্বাচনে সঠিকভাবে ভোট হলে জাতীয় পার্টি জয়ী হবে।
জাতীয় পার্টির তৃণমূলের রাজনীতি নিয়ে সুশীল সমাজের কয়েকজন প্রতিনিধির সঙ্গে কথা হয়। তারা (নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক) ঢাকাপ্রকাশ-কে জানান, এরশাদপত্নী রওশন এরশাদকে ঘিরে নতুন করে ধোঁয়াশা তৈরি হচ্ছে দলে। জি এম কাদেরের সঙ্গে তার দ্বৈরথ বাড়ছে দিন দিন। এর মধ্য দিয়ে দলের টানাপোড়েন দৃশ্যমান হচ্ছে নানাভাবে। মহাজোটের সঙ্গে জাতীয় পার্টির থাকা না থাকা নিয়েও নতুন আলোচনা শোনা যাচ্ছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়েও নেতারা চুপ। চার বছরে বিরোধীদলের ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হলেও গৃহপালিত বিরোধীদল হিসেবে সফল হয়েছেন তারা।
তারা বলেন, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি আর আগের মতো নেই। দেবর-ভাবির চেয়ারের দ্বন্দ্বে দলটি থেকে সাধারণ মানুষ মুখ ফিরে নিচ্ছে। বিগত চার বছরে সংসদে বিরোধীদলের আসনে বসে জনগণের চাহিদা ও সমস্যার কথা বলতে ব্যর্থ হয়েছে। শুধু ঠাকুরগাঁও নয়, সারা দেশে জাতীয় পার্টির তৃণমূলের রাজনীতির অবস্থা বেহাল।
তারা আরও বলেন, জেলা চেয়ারম্যান-সেক্রেটারি ছাড়া তেমন কাউকে পাওয়া যায় না। তাদের দলীয় কার্যালয়ের অবস্থা দেখলে মনে হবে দরজায় ঝুলানো তালার চাবিটা মনে হারায় ফেলছে। সামনে ভোট তাই কিছু নেতাকে মাঠে দেখা যাচ্ছে। আমাদের মতে জাতীয় পার্টিকে সব ভেদাভেদ ভুলে রাজনীতির মাঠ গোছানোর দরকার।
আর পেশাজীবী সংগঠনের নেতারা বলছেন, জাতীয় পার্টি সরকারি দল না বিরোধীদল সেটা চার বছরেও দেশের মানুষ পরিষ্কার নন। তারা নিজেদের বিরোধীদল দাবি করলেও গ্যাস বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেলসহ দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধির দাবিতে কোনো প্রতিবাদ বা মিছিল-মিটিং করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দলের ভূমিকা অনেক। যদিও এই দলকে সবাই সরকারের ঘর-জামাই বলে আখ্যায়িত করছেন। কিন্তু বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে দশম সংসদে জাতীয় পার্টি দেখিয়েছে, কীভাবে 'সরকারি-বিরোধী দল' হতে হয়। দলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এরশাদের মৃত্যুর পরে মূল দলের নেতৃত্ব নিয়েই এখন দেবর-ভাবির লড়াই চলছে....।
তৃণমূলের রাজনীতিতে জাতীয় পার্টি অন্যান্য দলের চেয়ে অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে। তাদের কার্যক্রম বিগত চার বছরে চোখে পড়েনি। এ দলের নেতা-কর্মীদের মাঠে তেমন দেখা যায় না। দলীয় কার্যালয়ে ঝুলছে তালা। সন্ধ্যা বাতি দেওয়ারও কেউ নেই। একমাত্র স্বপন চৌধুরীকেই মাঠে-ঘাটে দেখা যায়। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নির্বাচনকে সামনে রেখে নেতা-কর্মীরা ঘর গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
এএজেড