বিজয়ের ৫১ বছরেও নওগাঁর বধ্যভূমি অরক্ষিত
একাত্তর সালের ১৩ ডিসেম্বর নওগাঁর মান্দায় পাকহানাদার বাহিনীর ব্রাশফায়ারে নিহত ১৬ শহীদের স্মৃতিবিজড়িত মনোহরপুর বধ্যভূমি অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। বিজয়ের ৫১ বছরেও বধ্যভূমি অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে থাকায় শহীদ পরিবার ও স্থানীয়দের মাঝে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। তবে স্থানীয় প্রশাসন বলছেন, বধ্যভূমিতে প্রাচীর নির্মাণ কাজ শুরু করা হলেও ভূমি জটিলতায় তা বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে ভূমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে। এটি বাস্তবায়ন হলেই প্রাচীর নির্মাণসহ অন্যান্য কাজ বাস্তবায়ন করা হবে।
সেদিন পাক বাহিনীর গুলিতে শহীদ হন মনোহর গ্রামের ফইমালী বেওয়ার (৭৫) স্বামী আছির উদ্দিন ও বাবা লাল মোহাম্মদ। স্বাধীনতা যুদ্ধের নিরব সাক্ষী ফইমালী বেওয়া বলেন, একাত্তরের যুদ্ধে শেষ হওয়ার তিন দিন আগে বিকাল বেলা পাক বাহিনী ও রাজাকাররা আমাদের পুরা গ্রাম ঘিরে ফেলে।
সেদিন ওরা গ্রামের ১৫-২০টা বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। ওদের হাতে আমার স্বামী ও বাবাসহ ১৮ জন ধরা পড়েছিল। পরে গ্রামের পাশে ভালাইন বিলের ধারে নিয়ে গিয়ে ওদেরকে লাইন করে দাঁড় করে গুলি করে হত্যা করে। ভাগ্যচক্রে দুজন বেঁচে গেলেও আমার স্বামী ও বাবাসহ ১৬ জন মানুষ সেদিন মারা যায়।
শহীদ পরিবারের সদস্য মনোহরপুর গ্রামের বাসিন্দা জিল্লুর রহমান আক্ষেপ করে বলেন, এই কবরগুলাতে এখন গরু-ছাগল চড়ে বেড়ায়। কয়েক বছর আগে শুনেছি কবরস্থানটার চারপাশে নাকি প্রাচীর হবে। পরে তো আর হলো না। একটা স্মৃতি ফলক আছে, সেটাও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
২০১৬ সালে সরকারি উদ্যোগে ওই স্থানে শহীদ ব্যক্তিদের স্মরণে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়। সেই বছরই বধ্যভূমির স্থানটিতে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণের কাজ উদ্বোধন করা হয়। কিন্তু জমি নিয়ে বিরোধের কারণে পরবর্তীতে প্রাচীন নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যায়। সেখানে এখনও সীমানা প্রাচীর নির্মাণ হয়নি। সীমানা প্রাচীর না থাকায় বধ্যভূমিটি সারা বছর অযন্ত-অবহেলায় পড়ে থাকে।
সম্প্রতি মনোহর বধ্যভূমিতে গিয়ে দেখা যায়, বধ্যভূমির যে স্থানটিতে স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে সেখানে গরুর গোবর শুকাতে দেওয়া হয়েছে। গণকবরের স্থানটিতে সীমানাপ্রাচীর নেই। ঝোপ-ঝাড়ে ছেয়ে যাওয়া গণকবরের জায়গায় চড়ে বেড়াচ্ছে কয়েকটি গরু।
বিজয়ের ৫১ বছরেও মনোহরের মতো নওগাঁর অন্য অধিকাংশ বধ্যভূমি এখনও অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। অরক্ষিত থাকার কারণে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন এই স্থানগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে।
২০১৭ সালে প্রকাশিত 'মুক্তিযুদ্ধের কিশোর ইতিহাস নওগাঁ জেলা' বইয়ের লেখক আইয়ুব হোসেন নওগাঁয় ৩০টি বধ্যভূমির কথা উল্লেখ করেছেন। তবে ২০১৯ সালে স্থানীয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন একুশে পরিষদ নওগাঁ প্রকাশিত ও তরুণ গবেষক মোস্তফা-আল-মেহমুদ সম্পাদিত গণহত্যা ১৯৭১ নওগাঁ ৬৭টি বধ্যভূমির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সংগঠনটি প্রায় দুই যুগ ধরে ১৯৭১ সালে নওগাঁ জেলার বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত গণহত্যার ইতিহাস সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নওগাঁয় চিহ্নিত ৬৭ বধ্যভূমির মধ্যে ১২টি বধ্যভূমিতে শহীদ স্মৃতিফলক রয়েছে। এগুলো হলো সদর উপজেলার দোগাছি ও ফতেপুর; আত্রাইয়ের বান্দাইখাড়া ও শিংসাড়া; রাণীনগরের আতাইকুলা, মান্দার পাকুড়িয়া ও মনোহরপুর; মহাদেবপুরের বাজিতপুর-চকদৌলত; পত্নীতলার হালিমনগর; ধামইরহাটের কুলফতপুর; বদলগাছীর গয়েশপুর ও পাহাড়পুর। এগুলোর মধ্যে নওগাঁর পার-বোয়ালিয়া, মান্দার পাকুড়িয়া, আত্রাইয়ের বান্দাইখাড়া, বদলগাছীর গয়েশপুর ও পাহাড়পুর বধ্যভূমিতে সীমানাপ্রাচীর রয়েছে। উল্লিখিত এই পাঁচটি বধ্যভূমি ছাড়া বাকি ৬২টি বধ্যভূমিই অরক্ষিত।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক তরুণ গবেষক ও একুশে পরিষদ নওগাঁর সহ-সভাপতি মোস্তফা আল মেহমুদ বলেন, নওগাঁতে সংখ্যালঘু মানুষের সংখ্যা বেশি হওয়ায় এই অঞ্চলে পাক বাহিনী ও রাজাকাররা বেশি হত্যাযজ্ঞ চালায়। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময় সীমান্তবর্তী এই জেলার ওপর দিয়ে সীমান্ত পার হয়ে উত্তরাঞ্চলের অন্যান্য জেলার মানুষ ভারতে পাড়ি জমিয়েছিল।
প্রাণভয়ে পালিয়ে যেতে থাকা এসব মানুষকে হত্যা করা হয়। ২০১৯ সালে প্রকাশিত গণহত্যা ১৯৭১ নওগাঁ বইটির প্রথম সংস্করণে নওগাঁয় ৬৭টি বধ্যভূমির কথা উল্লেখ করা হলেও এখন পর্যন্ত ১০০টিরও অধিক বধ্যভূমির সন্ধ্যান পাওয়া গেছে। বইটির পরবর্তী সংস্করণে বাকিগুলোর কথা উল্লেখ করা হবে।
বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, বধ্যভূমি ও গণকবরগুলো আমাদের স্বাধীনতা ও বিজয়ের সাক্ষী। এই স্মৃতি চিহ্নগুলো দেখে আমাদের তরুণ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের সময় পূর্বপ্রজন্মের ত্যাগের কথা স্মরণ করবে এবং দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হবে। তাই রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সকল বধ্যভূমি সংরক্ষণ্রে উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নওগাঁ জেলা ইউনিটের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার আফজাল হোসেন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। প্রায় অর্ধশত গণকবর রয়েছে নওগাঁয়। অথচ স্বাধীনতার ৫১ বছরেও অনেক গণকবরই সংরক্ষণে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এটা দুঃখজনক। এগুলো সংরক্ষণ করা প্রশাসনের দায়িত্ব।
এএজেড