কুড়িগ্রামে ৯০ অবৈধ ইটভাটা, স্বাস্থ্যঝুঁকিতে শতশত পরিবার
সরকারি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ক্ষমতার দাপটে কুড়িগ্রামে কৃষিজমিতে অবৈধভাবে গড়ে তোলা হয়েছে ৯০টি ইটভাটা। ১১১টি ইটভাটার মধ্যে মাত্র ২১টির হালনাগাদ কাগজপত্র রয়েছে। ফলে কৃষিজমির ক্ষতি সাধন হচ্ছে। একই সঙ্গে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে শতশত পরিবার।
পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র, ইট পোড়ানো লাইসেন্স, ফায়ার সার্ভিসের সার্টিফিকেট এমনকি ভ্যাট-আয়কর প্রদানের কাগজপত্র ছাড়াই ইটভাটার মালিকরা আবাদি জমি, জনবসতি এলাকাসহ স্কুল-কলেজের পাশে রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা ইট পোড়ানোর কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে এসব ইটভাটার বিষাক্ত ছাঁই ও কালো ধোঁয়ায় ফলন হ্রাসের আশঙ্কায় পড়েছে কৃষকদের শতশত একর আমন ও বোরো আবাদ, রবিশস্য, সুপারি, নারিকেল, আম-জামসহ বিভিন্ন প্রজাতির ফল। সেই সঙ্গে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে ইটভাটার পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষজন।
কুড়িগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার কাশিপুর ইউনিয়নের আজোয়াটারী গ্রামের বিস্তীর্ণ কৃষিজমিতে মেসার্স ডব্লিউ এ এইস ব্রিকস ফিল্ড, এ বি ব্রিকস, মেসার্স এম এস এইচ ব্রিকস, বড়ভিটা ইউনিয়নের নওদাবশ এলাকায় সাইফুর রহমান সরকারি কলেজের পাশে মেসার্স এএমবি, ফুলবাড়ী সদর ইউনিয়নের খামারের বাজার এলাকায় মেসার্স কেএমবি এবং শিমুলবাড়ী ইউনিয়নের জকুরটল এলাকায় মেসার্স জেএমএস নামে ৬টি ইটভাটা গড়ে উঠেছে। এসব ইটভাটার একটিরও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নাই।
পরিবেশ অধিদপ্তরে নামমাত্র আবেদন করে, সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে চলছে ইট পোড়ানোর কাজ। ইটভাটার আয়তন দুই একরের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার নিয়ম থাকলেও বিস্তৃত এলাকা দখলে নিয়েছে তারা। ভরাট করেছে পানি নিষ্কাশনের পথ। একই চিত্র জেলার ভুরুঙ্গামারী, নাগেশ্বরী, কুড়িগ্রাম সদর, রাজারহাট, উলিপুর, চিলমারীসহ রৌমারী ও রাজীবপুর উপজেলার ইটভাটাগুলোর। ওই সব ইটভাটা সংলগ্ন স্থানীয়দের অভিযোগ, ইটভাটার মালিকরা প্রভাবশালী হওয়ায় সরকারি নিময়নীতির তোয়াক্কা করছে না।
ফুলবাড়ী উপজেলার কৃষক রফিকুল ইসলাম (৩৮), হজরত আলী (৬২) ও নাগেশ্বরী উপজেলার এগার মাথা এলাকার বিমল চন্দ্র (৪২), জামাল উদ্দিন (৪৫) জানান, ভাটার মালিকরা জমি ভাড়া নিয়ে ইট পোড়ানোর কাজ করছে। এসব ইটভাটার কালো ধোঁয়ায় গত ৫ বছর ধরে বোরো এবং আমন আবাদের ফলন বিঘাপ্রতি ৬-৭ মণ কমে এসেছে।
তারা আরও জানান, ভাটার কালো ধোঁয়া সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে সুপারি বাগানের। ধোঁয়ার বিষক্রিয়ায় কয়েক বছর ধরে এই এলাকায় সুপারির ফলন কমে এসেছে। তা ছাড়া আম, কাঁঠাল, নারিকেলসহ বিভিন্ন ফলের ফলনও কমে গেছে। ভাটার মালিকরা ইট পরিবহনের জন্য উঁচু রাস্তা তৈরি ও সেতুর মুখ বন্ধ করায় প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে এই এলাকার শতশত বিঘা আমন খেত পানিতে তলিয়ে নষ্ট হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে ফুলবাড়ী উপজেলার মেসার্স ডব্লিউ এ এইচ ব্রিকস ফিল্ডের মালিক মোশারফ হোসেন বলেন, শুধু আমার ভাটার না জেলার কোনো ইটভাটারই পরিবেশ অধিদপ্তরসহ আনুষঙ্গিক কাগজপত্র নেই। প্রতিবছর মালিক সমিতির লোকজনসহ ডিসি অফিসে কথা বলে ভাটা চালানোর মৌখিক অনুমতি দেওয়ায় ভাটায় ইট পোড়ানোর কাজ চলছে।
কুড়িগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক রেজাউল করিম বলেন, জেলায় মোট ১১১টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে ৯০টি ইটভাটাই অবৈধভাবে কৃষি জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে। মাত্র ২১টি ইটভাটার কাগজপত্র হালনাগাদ আছে। এর মধ্যে ২০-২৫টি ইটভাটার মালিক আবেদন করেছেন। তবে ৫১টি ইটভাটার কোনো ধরনের বৈধ কাগজ নেই। আমরা বিষয়টি জেলা প্রশাসকসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, যেসব ইটভাটার মালিকদের বৈধ কাজগপত্র নেই তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে ফুলবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ৩টি ইটভাটায় গিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছেন। অবৈধ ইটভাটাগুলোতে প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা অব্যাহত থাকবে বলে
জানান তিনি।
ফুলবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুমন দাস বলেন, গত ৮ ডিসেম্বর ৩টি ভাটায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়েছে। ওই তিন ভাটার কর্তৃপক্ষ উপযুক্ত কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেনি। তাই তাদেরকে আগামী ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে। ২২ ডিসেম্বরের মধ্যে কাগজ দেখাতে না পারলে অবৈধ ইটভাটাগুলোর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আজকালের মধ্যে বাকি ৩ ইটভাটায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে।
এসজি