ইভিএমএমে ধারণা নেই রংপুরের ৭০ ভাগ ভোটারের
রংপুর মহানগরীর ৭০ ভাগ ভোটারের এই যন্ত্র নিয়ে ধারনা নেই, এলাকার মানুষই এখনও শোনেন নি এবার ভোট হবে ইভিএমএম। যারাও শুনেছেন তাদের ইভিএম সম্পর্কে কোন ধারণা নেই। তফশিল অনুযায়ী আগামী ২৭ ডিসেম্বর রংপুর সিটি করর্পোরেশন নির্বাচনের প্রতিটি কেন্দ্রে ইভিএম ভোট করার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে নিবার্চন কমিশন। সে কারণে ইভিএম নিয়ে ভোটারেদের পাশাপাশি আস্থাহীনতা-শংকা আছে প্রার্থীদেরও। যদিও নির্বাচন কমিশন বলছে ইভিএম সম্পর্কে ভোটারদের আনুষ্ঠানিকভাবে সচেতন করতে কার্যক্রম শুরু হবে ২৩ ডিসেম্বর থেকে।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ৫৪ কিলোমিটার পৌরসভাকে বর্ধিত করে ২০১২ সালে ২০৫ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের সিটি করর্পোরেশন হয় রংপুর। শিশু এই সিটি করপোরেশনটির অধিকাংশ এলাকাই বর্ধিত হওয়ার কারণে এখনও ৭০ ভাগ এলাকাই আছে প্রন্তিক জনপদ-কৃষি নির্ভর। সেসব স্থানে শতভাগ বিদ্যুৎ থাকলেও ৫০ থেকে ৭০ ভাগ এলাকায় রাস্তাঘাট, রোড লাইট, ড্রেন হলেও সেভাবে গড়ে উঠে নি কোন অবকাঠামো। কৃষি নির্ভরতাই এখনও ৮০ ভাগ মানুষের জীবিকার হাতিয়ার। তরুন প্রজন্ম শিক্ষিত হয়ে উঠলেও পঞ্চাশোর্ধ প্রায় মানুষই শুধুই অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন।
যুগের পর যুগ তারা ব্যালটের ভোটে অভ্যস্ত। হঠাৎ করে এবারের সিটি নির্বাচনে ২২৯ টি ভোট কেন্দ্রেই ইভিএমএ ভোট দেয়ার সিদ্ধান্ত তাই তাদের কাছে একেবারেই অজানা, নতুন। বিষয়টি নিয়ে দোটানায় ভোটাররা। অনেক ভোটারই এখনও শোনেন নি, এবার ইলেকট্রনিক্স ভোটিং মেশিন-ইভিএম দিয়ে ভোট দিতে হবে। যারাও শুনেছেন, তারাও জানেন না ইভিএমএ কিভাবে ভোট দিতে হয়। শংকা আছে ঠিক ভাবে ভোট দেয়ার, ঠিক জায়গায় ভোট যাওয়ার।
নগরীর ৩৩ নং ওয়ার্ডের সাবের আলী বলেন যন্ত্র দিয়া কেমন করি ভোট দেয়া নাকবে মুই জানোনা বাহে। এ্যলাও তো শুনি নাই বোলে মেশিন দিয়া ভোট দ্যাওয়া নাইগবে। কেবল তো আইজ নিয়া তোমরাই আইনেন। হামরা কেমন করি জানি বোলে মেশিন দিয়া ভোট দিবে। আগোত তো হামরা ইয়াও দিসনো সিল, হয়া গেছিল। এখন যে কোনটা হাতে কোন টা হয় কি বুলি। কেমন করি জানি এখন।
রবিবার দুপুরে রংপুর মহানগরীর ৩৩ নং ওয়ার্ডের মেকুড়া এলাকার সাবেরা বেওয়া বলছিলেন কথাগুলো। সিটি করপোরেশনের করা ২০ ফুট রাস্তায় ধান শুকাচ্ছিলেন তিনি। সেখানেই কথা হয় সেকেন্দার আলীর সাথে। তিনিও জানান, একনও তো হামাক কেউ বোলে নাই মেশিন দিয়া ভোট দ্যাওয়া লাইগবে। কেউ তো আসিয়া হামাক দেকায়ও নাই, ক্যামন করি মেশিন দিয়া ভোট দ্যাওয়া লাইগবে না লাইগবে। এ্যালা যদি হামাক শিকায়, তাইলে হামরা ওই সিস্টেমোত ভোট দিমো, না শিকাইলে হামরা ভোট দিবাওে যাবান নই।
নগরীর ১৫ নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর এবং এবারের প্রার্থী শাফিউল ইসলাম শাফী জানান, ভোটারদের কাছে ইভিএম একেবারেই নতুন প্রযুক্তি। যদি ভোটারদেও ট্রেনিং না দেয়া হয়, তাহলে অনেক ভোটার অজানার কারণে ভোট দিতে যাবে না। অনেকেই ভোট দিতে পারবে না। সেকারণে দ্রুততার সাথে নির্বাচন কমিশনের উচিৎ ইভিএম সম্পর্কে মাঠে ধারণা দেয়া শুরু করা। আমরা প্রার্থীরা তাদের সহযোগিতা করবো। যেহেতু এর আগে রংপুর সিটি করর্পোরেশনে ভোট হয় নি। সেকারণে এখন থেকেই ভোটারদের ট্রেনিং দেয়া উচিৎ, তা না হলে ভোটাররা আসবে না। ভোটাররা ইভিএম বোঝে না। তাদের বোঝাতে হবে।
জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগ প্রার্থী বললেন, জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থী মোস্তফার দাবি ইভিএমএ এ জিরো রেটিং নিশ্চিত করতে হবে। এখনই সচেতনতা তৈরি করতে না পারলে বয়স্ক ভোটারদের কেন্দ্রে আনা যাবে না। আর আওয়ামী লীগ প্রার্থী মনে করেন, ইভিএমএ অসুবিধা হবে না। প্রচারণা চালাতে হবে।
মেয়র প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, ইভিএম এ অনেক কিছু কারচুপি করার সুযোগ আছে। ভোট রেগিং করা। আগেই ভোট পোল করে রাখা। অনেক সুযোগ আছে। সরকার যদি সেটা এখানে করে তাহলে সেটা বুমেঢ়াং হয়ে যাবে। আর ইভিএম এর ভোট প্রদানের বিষয়ে রুট লেবেলের মানুষ এখনও সচেতন না।
ব্যালটের বিষয়টি ছির অন্য, যে মার্কা খুঁজে সেখানে সিল মারলো, গুছিয়ে বাক্সে ফেললো। কিন্তু এখানে তা তো না। এখানে নির্ধারিত মার্কা এবং বটম আছে খুব কাছাকাছি। সাদা বাটনগুলো খুব কাছাকাছি। সামান্য ডিফারেন্স। মার্কার সোজা যে বাটম না থাকবে সেই বাটনে পুশ করতে হবে। পুশ করার পর আবার সবুজ বাটন দিয়ে তা কনফার্ম করতে হবে। তখন ভোট প্রদান সম্ভব হবে।
এই বিষয়গুলো যদি নির্বাচন কমিশন এখনই রুট লেবেলে প্রার্থীদের সহযোগিতা নিয়ে, লজিস্টিক সাপোর্ট দিয়ে মাঠ পর্যায়ে প্রশিক্ষন দেয়া যায়, তাহলে এটা সম্ভব হবে। তা নাহলে সম্ভব হবে না। মানুষ ভোট দিতে আসবেও না ,পারবেও না। বিষয়টি খুব জরুরী। আমরা এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন।
আওয়ামীলীগ মনোনিত নৌকা প্রতিকের মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া জানান, আমার বিশ্বাস, গ্রাম কিংবা আরবান এরিয়ার লোকজন ইভিএম পদ্ধতিকে ভয় করে না। সকলেই বিশ্বাস করে আধুনিক বিজ্ঞান এবং আধুনিক প্রযক্তিতে বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশেও এগিয়ে যাবে। আগামী ২৭ ডিসেম্বর যে নির্বাচন হবে সে নির্বাচনও ভোট সকলেই স্বতস্ফুর্তভাবে দিবে।
উদ্ভুত পরিস্থিতিতে ইভিএম সম্পর্কে ভোটারদের জানাতে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পাটির নেতাকর্মীরা প্রতিদিন ডেমো ইভিএম নিয়ে ভোটারদের কাছে যাচ্ছেন। নগরীর ৩৩ টি ওয়ার্ডের হাট বাজার, রাস্তায়, রাস্তায়, দোকান-পাট, বাসা বাড়িতে দলীয় নেতাকর্মীরা ভোটারদের কিভাবে ইভিএমএ ভোট দেয়া যায় তা হাতে কলমে শেখাচ্ছেন। এতে খুব সাড়াও দেখা গেছে মানুষের মাঝে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন- রংপুর মহানগর সভাপতি অধ্যক্ষ ফখরুল আনাম বেঞ্জু বলেন, রংপুর সিটি করপোরেশনের ৭০ ভাগ এলাকাতেই এখন নগর সভ্যতার ছোয়া লাগে নি। এখনও ৮০ ভাগ মানুষ কৃষি নির্ভর। এখানে কোন ইন্ডাস্ট্রিজ গড়ে উঠে নি। প্রতিদিন সকালে হাজার হাজার মানুষ রিকশা চালানো, দোকানে থাকাসহ দিন মজুরির বিভিন্ন কাজে মূল শহরে প্রবেশ করে। ইভিএম সম্পর্কে তাদের ন্যুনতম কোন ধারণা নেই, বরং তারা আস্থাহীন। তাই এ এই নির্বাচনে ইভিএম কে মানুষের আস্থায় আনতে হলে এখনই ইভিএম নিয়ে যেতে হবে মানুষের দোড় গোড়ায়। তা না হলে মানুষের সন্দেহ দুর হবে না। তাহলে সুফল পাওয়া যাবে।
সার্বিক বিষয়ে রংপুর সিটি করর্পোরেশন নির্বাচন এর রিটার্নিং কর্মকর্তা মোঃ আবদুল বাতেন জানান, ইভিএম সম্পর্কে ধারণা দিতে আমরা আগামী ২৩-২৪ ডিসেম্বর প্রতিটি পাড়া মহল্লায় এলাকায় এলাকায় চলে যাবো ইভিএম মেশিন নিয়ে। বিভিন্ন জনাকীর্ণ স্থানে যাবো আমরা। কাউন্সিলর মেয়র প্রার্থীদেরর অনুরোধ করবো। যেখানে আমরা প্রদর্শনী করবো সেখানে যেন ভোটারদের নিয়ে আসে। তখন তাদের আমরা হাতেকলমে শেখাবো। বয়োবৃদ্ধ, অসুস্থ্য, গর্ভবতি মায়েদের জন্য তাদের বাড়িতে গিয়ে আমরা ইভিএম শেখাবো।
এছাড়াও সিটি করর্পোরেশনের ডিজিটাল বিলবোর্ড, নির্বাচন অফিস, ডিসি অফিসে আমরা ইতোমধ্যেই ডিজিটাল ডিসপ্লের মাধ্যমে শেখানো শুরু করেছি। আগামী ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের প্রত্যেকটি স্থানে আমরা ইভিএমএর প্রদর্শনী করবো। যাতে কেউ শেখার বাইরে না থাকে। এবার ভোটার ও কেন্দ্র সংখ্যা বেড়েছে। গতবছর ১৯৩ টি কেন্দ্র থাকলেও ৩৬ টি বেড়ে কেন্দ্র সংখ্যা হয়েছে ২২৯টি।
এছাড়াও এবার স্থায়ী ভোট কক্ষ করা হয়েছে ১ হাজার ৩৪৯ টি এবং অস্থায়ী ভোট কক্ষ আছে ১৯৩ টি। গত ২০১৭ সালের নির্বাচনের ভোটার সংখ্যার তুলনায় এবার ভোটার বেড়েছে ৩২ হাজার ৫৭৫ জন। গত বছর ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৮৯৪ জন ভোটার থাকলেও এবার ভোটার সংখ্যা বেড়ে দাড়িয়েছে ৪ লাখ ২৬ হাজার ৪৬৯ জনে।
এরমধ্যে পুরুষ ২ লাখ ১২ হাজার ৩০২ জন এভং মহিলা ২ লাখ ১৪ হাজার ১৬৭ জন। এরই মধ্যে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে মেয়র পদে ১০, সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৬৯ এবং সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১৯৮ জন মনোনয়ন পত্র দাখিল করেছেন। ৮ ডিসেম্বর প্রার্থীতা প্রত্যাহারের শেষ দিন। ২৭ ডিসেম্বর হবে ভোট।
এএজেড