১৫ দিনেও বাংলাদেশির মরদেহ ফেরত দেয়নি বিএসএফ
বাংলাদেশি কৃষক মোহাম্মদ মেজবাহারের মরদেহ পাওয়ার আশায় দিন গুণছেন পরিবার। এখন বিজিবিসহ প্রশাসনের কাছে পরিবারের একটাই দাবি, তার মরদেহ ফেরত এনে দেন।
গত ১৩ নভেম্বর বিকেলে কৃষক মেজবাহারকে (৪৭) সীমান্ত এলাকা থেকে জোর করে ধরে নিয়ে যায় বিএসএফ সদস্যরা। তিনি ফেনীর পরশুরামের উত্তর গুথুমা গ্রামের মৃত মফিজুর রহমানের ছেলে। কৃষি কাজের পাশাপাশি তিনি স্থানীয়ভাবে গরু ব্যবসা করতেন।
তিন দিন পর ১৬ নভেম্বর সকালে সীমান্তের কাঁটাতারের পাশে শূন্যরেখার ভারতীয় অংশে ঝোপের মধ্যে মেজবাহারের মরদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। ১৭ নভেম্বর ভোরে বিএসএফ তার মরদেহ উদ্ধার করে তাদের দেশের আইন অনুযায়ী সব নিয়ম পালন শেষে মরদেহ ফেরত দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে নিয়ে যায়। তবে মরদেহ এখনো ফেরত দেয়নি বা হস্তান্তর করেনি বিএসএফ।
রবিবার (২৭ নভেম্বর) দুপুরে মেজবাহারের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পরিবারের সবাই শোকাবহ। বাড়িতে ছোট একটা চৌচালা টিনের ঘর। উঠানে খেতের পাকা ধান পড়ে রয়েছে। মেজবাহারের স্ত্রী মরিয়ম বেগম কারো সঙ্গে দেখা করেন না। ঘরের ভেতর থেকে কথা বলেন।
তিনি জানান, গত ১৩ নভেম্বর বিকেলে উপজেলার উত্তর বাঁশপদুয়া গ্রামের ভারতীয় সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় ধান কাটতে যান। তখনই বিএসএফ তাকে ধরে নিয়ে যায়। তাদের চার মেয়ে, ছেলে নেই। বড় মেয়ে মর্জিনা আক্তারের (১৮) বিয়ে হয়েছে। তার স্বামী বেকার। দ্বিতীয় মেয়ে তাজনাহার বেগম (১৩) স্থানীয় স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। সে হৃদরোগে আক্রান্ত। তৃতীয় মেয়ে বিবি হাজেরা (১১) পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে এবং চতুর্থ মেয়ে বিবি জান্নাতুল নাঈমা স্থানীয় নুরানী মাদ্রাসায় পড়ে।
মরিয়ম জানান, নিজেদের বাড়ি ছাড়া কোনো জমিজমা নেই। অন্যের জমিতে বর্গা চাষ করেন। চলতি বছর এক একর জমিতে আমনের চাষ করেছেন। জমি সীমান্ত এলাকায়, পাকা ধান কাটতে গেলে বিএসএফ ধরে নিয়ে যায়। তার স্বামী কোনো অন্যায় করেনি। এখন মরদেহ ফেরত চান। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও হত্যার বিচার দাবি করেন।
তিনি বলেন, পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম লোকটাকে হারিয়ে এখন চোখে অন্ধকার দেখছেন। ছোট ছোট মেয়েদের খাওয়া কেমনে হবে। লেখাপড়া কেমনে চলবে। চিকিৎসার খরচ কে দেবেন? ছোট মেয়েটা এখনো জানে না- তার বাবার কী হয়েছে, কেবলই বলে 'বাবা কখন আসবে'।
বিজিবি সূত্র জানায়, গত ১৬ নভেম্বর বেলা ১১টার দিকে সীমান্তের শূন্যরেখার কাঁটাতারের পাশে ঝোপের মধ্যে এক ব্যক্তির মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেন স্থানীয় লোকজন। সেটিকে মেজবাহারের মরদেহ হিসেবে শনাক্ত করা হয়। মরদেহটি ওই স্থানে ১৬ ঘণ্টা পড়ে ছিল।
১৭ নভেম্বর ভোরে বাংলাদেশির ওই মরদেহ উদ্ধার করা হয়। কিন্তু মরদেহ উদ্ধারের এতদিন পরও ফেরত দেয়নি বিএসএফ। গত ১৬ নভেম্বর রাত ৩টায় বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি ও বিএসএফের পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক শেষে সমঝোতার ভিত্তিতে মরদেহ উদ্ধার করে বিএসএফ।
বিজিবি সূত্র আরও জানায়, ওইদিন ভোরে দুই পক্ষের সমঝোতা বৈঠকে পরদিন ১৭ নভেম্বর বিএসএফ আনুষ্ঠানিকভাবে বিজিবির নিকট বাংলাদেশি কৃষক মোহাম্মদ মেজবাহারের (৪৭) মরদেহ হস্তান্তর করার আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্ত তাদের দেশের আইন অনুযায়ী সব প্রক্রিয়া শেষ না হওয়ায় রবিবার পর্যন্ত মরদেহটি হস্তান্তর করা হয়নি।
পরশুরাম পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ড উত্তর গুথুমা এলাকার কাউন্সিলর মো. নিজাম উদ্দিন চৌধুরী সুমন জানান, গত ১৬ নভেম্বর বেলা ১১টার দিকে স্থানীয় লোকজন সীমান্তের শূন্যরেখার কাঁটাতারের পাশে ভারতীয় অংশে এক ব্যক্তির মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেন স্থানীয় লোকজন। খবর পেয়ে পরিবার ও স্বজনরা জানায় সেটি মোহাম্মদ মেজবাহারের মরদেহ।
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মধ্যে পতাকা বৈঠকের আগে অর্ধগলিত মরদেহটি সেখানে ১৬ ঘণ্টা পড়ে ছিল। ১৭ নভেম্বর রাত ৩টায় দুই পক্ষের পতাকা বৈঠকে সমঝোতা হয়। এরপর বিএসএফ মরদেহটি নিয়ে যায়। ভারতে আনুষ্ঠানিকতা শেষে তা ফেরত দেবে বলে জানায়। কিন্তু উদ্ধারের ১৫ দিন পরও তারা হস্তান্তর করেনি।
ফেনীর ৪ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ কে এম আরিফুল ইসলাম জানান, বিএসএফ মরদেহ ফেরত দেওয়ার কথা হয়েছে। তবে ওই দেশের আইনগত আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়নি বলে মরদেহটি এখনো হস্তান্তর করা হয়নি। মোহাম্মদ মেজবাহারের মরদেহ বিএসএফ কখন হস্তান্তর করবে তাও জানায়নি। তবে তাদের দেশের আইনগত প্রক্রিয়া শেষ হলেই তার মরদেহ হস্তান্তর করা হবে।
মেজবাহারের স্ত্রী মরিয়ম বেগম এখন তার স্বামীর মরদেহটি ফেরত চান। তাদের চার মেয়ে বাবার মরদেহ একবার দেখতে চায়। তার স্বামীকে কী অপরাধে হত্যা করা হয়েছে তার কারণ জানতে চান। তার স্বামী কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। স্বামীর মরদেহ পাওয়ার জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও বিজিবি ক্যাম্পে বার বার ধরনা দিচ্ছেন।
জানতে চাইলে পরশুরাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দা শামসাদ বেগম মুঠোফোনে বলেন, ভারতের আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে মরদেহ হস্তান্তর করার কথা রয়েছে। মেজবাহরের পরিবারটির আর্থিক কষ্টের বিষয়টি উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটি ও উন্নয়ন সমন্বয় সভায় আলোচনা হয়েছে। পরিবারটিকে কিছু সহায়তা করা হবে।
এসএন