মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে পেটেভাতে দিন কাটছে নওগাঁর নৈশপ্রহরীদের
একদিকে শীতের তীব্রতা বেড়েছে উত্তরাঞ্চলে, অন্যদিকে নিশুতি রাতের স্তব্ধতা। চুরি-ডাকাতিসহ নানা ধরনের দুর্বৃত্তায়ন প্রতিরোধের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত ঘুরছেন একদল নিবেদিত প্রাণ। অথচ তাদের আত্মরক্ষার হাতিয়ার হিসেবে রয়েছে শুধু লাঠি অথবা বল্লম। শুধু তাই নয়, বয়সের ভারে নুয়ে পড়া শরীর নিয়ে ৩৬৫ রাত্রি জেগে যে বেতন পান, তা দিয়ে চলে না ভরণপোষণও। এসব আক্ষেপের কথা জানালেন নওগাঁ শহরের নৈশপ্রহরীরা।
শুক্রবার (১১ নভেম্বর) দিবাগত রাত ২টায় নওগাঁ শহরের বাসস্ট্যান্ড সড়ক ধরে কিছু দূর সামনে এগোতেই শীতে জবুথবু অবস্থায় দেখা মিলল ৭০ বছরের আব্দুল আজিজের। হাতে বল্লম আর টর্চলাইট। বোঝা গেল তিনি নৈশপ্রহরী। রাত জেগে এলাকাবাসীর নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন।
নওগাঁ শহরের আলুপট্টি এলাকার নৈশপ্রহরী আব্দুল আজিজ। সংসারে উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তিনি একাই। বার্ধক্য ও শারীরিক নানা সমস্যা নিয়েও ৬ সদস্যর পরিবারের ভরণপোষণ দিতে ৭ বছর ধরে এখানে কাজ করছেন।
আব্দুল আজিজ ঢাকা প্রকাশ-কে বলেন, আগে ওয়েলডিং মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করতাম। বয়সের কারণে ভারী কাজ করতে পারি না। কিডনির সমস্যা, তাই মাসে সাড়ে তিন হাজার টাকার ওষুধ লাগে। যা পাই তাই দিয়ে অনেক কষ্ট করে সংসার চালাই। ৩৬৫ রাত্রি জেগে অমানিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে হয়।
তিনি নওগাঁ সদর উপজেলার চন্ডিপুর ইউনিয়নের ভদ্রখালী এলাকার বাসিন্দা। স্ত্রী পুতলি বানু ও দুই মেয়ে আরজিনা, সম্পা বানুকে নিয়ে তার সংসার। দুই মেয়েদের বিয়ে দিয়েও নিজের কাছে রেখেছেন। মেয়ে জামাইরা ভালো নয় বলেও জানান।
আব্দুল আজিজের জীবনের বড় অংশজুড়ে আছে হতাশা। ৮ ঘণ্টা রাত জেগে ৭ হাজার টাকা বেতন মিলছে তার। এর আগে তিনি ২০ বছর ওয়েলডিং মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নওগাঁ শহরের বিভিন্ন জায়গায় প্রায় শতাধিক নৈশপ্রহরী রয়েছেন। তাদের অধিকাংশই বৃদ্ধ। অনেকটা বাধ্য হয়েই তারা নিরাপত্তা প্রহরীর কাজ করছেন। বয়স বেড়ে যাওয়ায় শারীরিক সক্ষমতা না থাকায় কাজের ক্ষেত্র খুবই সীমিত তাদের। তা ছাড়া আরও বিভিন্ন ধরনের সমস্যাও রয়েছে তাদের। ফলে অন্য কাজ না পাওয়ায় খুব কম বেতনে বাধ্য হয়েই নিরাপত্তা প্রহরীর চাকরি করছেন তারা।
কিন্তু এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিরীহ-বিপদগ্রস্ত এসব বিশ্বস্ত প্রহরীর বেতনও বাড়ায় না মার্কেট মালিক ও কোম্পানিগুলো। বিশেষ দিনেও নেই কোনো ছুটি। যেখানে জানমালের নিরাপত্তায় নিয়োজিত এসব প্রহরীর রয়েছে জীবনের ঝুঁকি, সেখানে চোর, ডাকাত, ছিনতাইয়ের মতো ঝামেলা এড়াতে বাঁশি আর লাঠি ছাড়া তেমন কোনো হাতিয়ার নেই। কখনো কখনো হামলার শিকার হতে হয়। এ সময় কঠিন বিপদের মুখোমুখি এমনকি প্রাণহানিও হয় তাদের। এরপরও পরিবারকে একটু খাওয়াতে-পরাতে বাধ্য হয়ে রাত জাগার চাকরি করেন তারা।
ব্রিজের মোড় মসজিদ মার্কেটে ৮ বছর ধরে নৈশপ্রহরীর কাজ করে যাচ্ছেন ৭৫ বছর বয়সী গুলবর আলী। তিনি নওগাঁ সদর বোয়ালিয়া ইউনিয়নের দোগাছি শিংড়া গ্রামের বাসিন্দা। তিনি ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, 'আট বছর ধরে চাকরি করছি। বেতন পাই ৭ হাজার তাতে আমাদের খুব অভাবে দিন যায়। ভালো-মন্দ খেতে পারি না। শীতের ভালো কাপড়-চোপড়ও নেই যা পরে ডিউটি করব। বাবা! আমরা খুব অশান্তির মধ্যে আছি। না পারি ভালো বাজার করতে। না পারি ভালো মাছ কিনতে। আর গরুর মাংস তো আমরা বছরে একবারও কিনতে পারি না।'
কিছুদূর সামনে এগিয়ে শহরের সোনারপট্টি মোড় এলাকায় গিয়ে দেখা মিলে নৈশপ্রহরী মোসলেম উদ্দিনের সঙ্গে। এক হাতে টর্চলাইট জ্বালিয়ে এদিক-সেদিক দেখছেন আর পায়চারী করে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছেন। বয়স ৭০ বছর পেরিয়েছে তার। অন্য কোনো কাজ করতে না পরায় রাতজাগা পেশাকেই বেছে নিয়েছেন তিনি। ২০টি দোকান রাতে পাহারা দিয়ে ৭ হাজার টাকা বেতন পান তিনি।
এ বিষয়ে আইনজীবী মহসীন রেজা ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, 'যখন আমরা শহরের বাসিন্দারা রাতে ঘুমিয়ে পড়ি সেই সময় নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন নৈশপ্রহরীরা। ঝড়, বৃষ্টি, বাদল যেকোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যেও তাদের দায়িত্ব পালন করে যেতে হয়। আমরা আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ বাংলাদেশ। আমরা শ্রমজীবী মানুষকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার বিধি-বিধান অনুসারে নানা রকম সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে চাই। অথচ এই নৈশপ্রহরী হিসেবে যারা দায়িত্ব পালন করে তারা সপ্তাহে ৭ দিন এবং বছরে ৩৬৫ দিনই তাদের দায়িত্ব পালন করতে হয়। অথচ এই দায়িত্ব পালন করতে নানা রকম জীবনের ঝুঁকির মুখোমুখি পড়তে হয়।'
তিনি আরও বলেন, 'বিষয়গুলো আমরা নাগরিক হিসেবে খুব বেশি তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে পারি না। প্রশাসনও তাদের প্রতি সু-নজর দিতে পারেন না। আমরা দেখছি নৈশপ্রহরী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তারা অধিকাংশই জ্যেষ্ঠ নাগরিক। একান্তই পরিবারের ভরণপোষণের জন্য বাধ্য হয়ে দিনের পর দিন রাত্রি জেগে অমানিকভাবে এ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। শুধু পরিবারের ভরণপোষণের জন্য। বিষয়টি সভ্য সমাজে একেবারে গ্রহণযোগ্য নয়। এই পদ্ধতির ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক নাগরিক পর্যায়ে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে তাদের আয় বৃদ্ধি, তাদের স্বাস্থ্য এবং বিনোদন ও অবসরে বাড়তি সময় বের করে দেওয়ার পদ্ধতি নিয়ে কথা বলা উচিত।'
এসএন