৮ প্রকল্পে বদলে যাবে চট্টগ্রাম
চট্টগ্রামে এ বছরই চালু হচ্ছে ৮ প্রকল্প। এর মধ্যে রয়েছে মেগা প্রকল্প কর্ণফুলী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল, বাঁশখালী বিদ্যুৎ কেন্দ্র, জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প। এছাড়া আউটার রিং রোড, ভান্ডালজুড়ি পানি শোধনাগার প্রকল্প, বায়েজিদ বাইপাস সড়কও চালু হচ্ছে। অবকাঠামো খাতের এসব প্রকল্পে বদলে যাবে চট্টগ্রামের রুপ।
কর্ণফুলী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল: কর্ণফুলীর তলদেশে নির্মিত হচ্ছে উপমহাদেশের প্রথম টানেল। এ প্রকল্পের কাজ চলতি বছরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। দুই টিউবের খনন কাজ ইতোমধ্যে শেষ। চলছে সংযোগ সড়কের কাজ।
টানেল প্রকল্পের পরিচালক হারুনুর রশিদ চৌধুরী জানান, চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গা থেকে শুরু হওয়া প্রথম সুড়ঙ্গের খননকাজ শেষ হয় ২০২০ সালের ২ আগস্ট। দ্বিতীয় সুড়ঙ্গের খননকাজ শেষ হয় গত বছর ৬ অক্টোবর। এখন আনোয়ারা ও পতেঙ্গা প্রান্তে ৫.৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়কের কাজ চলছে। আনোয়ারা প্রান্তে ৭২৭ মিটার দীর্ঘ উড়ালসেতুর কাজও প্রায় শেষ।
তিনি বলেন, মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩.৩২ কিলোমিটার। এর মধ্যে টানেলের প্রতিটি সুড়ঙ্গের দৈর্ঘ্য ২.৪৫ কিলোমিটার। দুই সুড়ঙ্গে দুটি করে চারটি লেন থাকবে। প্রায় ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। প্রকল্পের অর্থ ব্যয়ে ঋণ হিসাবে চীনের এক্সিম ব্যাংক দিচ্ছে ৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা। অবশিষ্ট অর্থের যোগান হয়েছে সরকারি তহবিল থেকে।
তিনি জানান, চীনের সাংহাইয়ের আদলে চট্টগ্রামকে ওয়ান সিটি টু টাউন হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এটা প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্পের অন্যতম। প্রকল্প ঘিরে ইতোমধ্যে পতেঙ্গা ও আনোয়ারা এলাকায় বিশেষ অর্থনীতি অঞ্চলসহ নানা উন্নয়ন কর্মকান্ড শুরু হয়েছে।
সমাপ্তির দিকে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প: চট্টগ্রাম মহানগরীর দু:খ জলাবদ্ধতা। যা থেকে পরিত্রাণের লক্ষ্যে প্রায় ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়ন হচ্ছে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) তত্ত্বাবধানে এই মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সেনাবাহিনী। যা চলতি বছর শেষ হওয়ার কথা।
চউকের নির্বাহী প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, প্রকল্পের আওতায় নগরীর ৩৬টি খাল ও ৩০২ মিটার নালা সংস্কার করছে চউক। ২০১৭ সালের জুুলাই মাসে শুরু করা এ প্রকল্পের কাজ এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে। পুরো কাজ শেষ হলে জলাবদ্ধতা নিরসন হবে।
উৎপাদনে যাচ্ছে বাঁশখালী বিদ্যুৎ কেন্দ্র: চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে যাচ্ছে এ বছরেই। এটি বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ প্রকল্প। এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন এসএস পাওয়ার লিমিটেড ও চীনের দুটি প্রতিষ্ঠান যৌথ উদ্যোগে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।
প্রকল্পের কর্মকর্তা আদিল হোসেন জানান, ২০১৬ সালের মার্চ মাসে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। নতুর বছরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষে হবে। প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হলে বিদ্যুতের চাহিদা অনেকাংশ পূরণ করা সম্ভব হবে।
শেষের পথে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প: যানজট নিরসনে চট্টগ্রামের লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত প্রায় ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্পও শেষের পথে। ২০১৭ সালে এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়।
প্রকল্পের পরিচালক ও চউকের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান বলেন, নতুন বছরের মধ্যে প্রকল্পের মূল কাজ শেষ হবে। এরপর যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে। তবে র্যাম ও লুপের কাজ শেষ হতে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
চউকের তথ্যমতে, প্রায় তিন হাজার ৩২০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই মেগা প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন করছে চউক। প্রকল্পের কাজ শেষে হলে নগরীর সবচেয়ে ব্যস্ততম কালুরঘাট-শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর সড়কে যাতায়াত অনেকটা সহজ হবে।
চালু হচ্ছে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল: এ বছরের মার্চ মাসে চট্টগ্রাম বন্দরের পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) প্রকল্প চালু হতে পারে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান।
তিনি বলেন, ২ একর জায়গায় নির্মিতব্য টার্মিনালটি চালু হলে চার লাখ একক কনটেইনার হ্যান্ডলিং করা সম্ভব হবে। কনটেইনারের পাশাপাশি এই টার্মিনালে থাকবে তেলবাহী জাহাজ ভিড়ানোর সুবিধা। নির্মাণাধীন পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল বাস্তবায়ন হলে বন্দরের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে, বাড়বে লজিস্টিক সক্ষমতা।
বন্দর সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের ১৩ জুন পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল প্রকল্পের অনুমোদন দেয় সরকার। ১ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে এই মেগা প্রকল্পের শেষ সময় ছিল ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। পরে ব্যয় আরও ১ হাজার ৩৯৩ কোটি ৪১ লাখ টাকা বাড়ানোর সঙ্গে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যস্ত সময় চেয়ে আরডিপি বরাবর আবেদন করে প্রকল্প সংস্থা। ২০০৭ সালের পর এই প্রথম কোন-জেটি টার্মিনাল বন্দরের বহরে যোগ হচ্ছে।
চালু হচ্ছে আউটার রিং রোড: পতেঙ্গা থেকে সাগরিকা পর্যন্ত সাগরের পাড় ঘেঁষে আউটার রিং রোডের কাজ শেষ হলেও দুটো ফিডার রোড চালু হয়নি এখনো। তবে নতুন বছরের মধ্যে এ কাজ শেষ হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্পের পরিচালক ও চউকের প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস।
তিনি বলেন, ফিডার রোড-৩ (সাগরিকা স্টেডিয়ামের পাশ দিয়ে) এর নির্মাণ প্রায় শেষ। শিগগিরই তা চালু হয়ে যাবে। অপরদিকে ফিডার রোড-১ (পতেঙ্গা খেজুরতলা অংশে) এর নির্মাণকাজ চলতি বছরের মধ্যে শেষ হবে। ফিডার রোড-২ (বড়পোল অংশে) এর জন্য ডিপিপি প্রণয়ন করা হচ্ছে। এর নির্মাণকাজও চলতি বছরে শেষ হবে।
চালু হচ্ছে স্যুয়ারেজ ও পানি শোধনাগার প্রকল্প: নগরীর হালিশহর ১৬৫ একর জায়গায় ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম ওয়াসার স্যুয়ারেজ প্রকল্প চালু হওয়ার কথা এ বছরেই। অপরদিকে কর্ণফুলীর তীরে বোয়ালখালীতে দিনে ৬ কোটি লিটার ধারণক্ষমতার ভান্ডালজুড়ি পানি শোধনাগার প্রকল্পও এ বছর চালু করা হচ্ছে বলে জানান ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক একেএম ফজলুল্লাহ। তিনি বলেন, প্রকল্পের কাজ শেষ হলে পটিয়া, আনোয়ারা ও বোয়ালখালী এলাকার আবাসিক ও শিল্প কারখানায় সুপেয় পানি সরবরাহ করা যাবে।
চালু হবে বায়েজিদ বাইপাস রোড: প্রায় এক বছর আগে প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্দেশনা ও রেল লাইনের উপর ব্রিজ নির্মাণে রেলওয়ের গাইড লাইনে আটকে আছে বাইপাস রোডটি। তবে সব বাঁধা অতিক্রম করে চলতি বছরে মার্চ মাসে পুরোদমে চলাচলের উপযোগী হবে বলে জানান চউকের প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস। তিনি বলেন, ৩৩ কোটি ৮১ লাখ টাকা ব্যয়ে চার লেন এই সড়কের কাজ শুরু হয়েছিল ২০০৪ সালে।
এদিকে, শেষের পথে চাক্তাই-কালুরঘাট সড়কের কাজও। আট কিলোমিটার দীর্ঘ চার লেনের এই সড়কের ৫০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে বলে জানান প্রকল্পের পরিচালক ও চউকের নির্বাহী প্রকৌশলী রাজীব দাশ। এছাড়া মহেশখালীতে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরের কাজও এবছরে পুরোদমে শুরু হবে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।
এছাড়া মালয়েশিয়ার প্রশাসনিক রাজধানী পুত্রজায়ার আদলে ১১০ একর জমিতে নির্মিত হতে যাচ্ছে মিনি সেক্রেটারিয়েট ফর চট্টগ্রাম। যেখানে ৪৪টি সরকারি দপ্তর ছাড়াও বিভিন্ন স্থাপনা থাকবে বলে জানান চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মো. মমিনুর রহমান।
চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, এসব প্রকল্প চালু হলে চট্টগ্রামের চেহারা বদলে যাবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটবে। অর্থনৈতিক অঞ্চল মিরসরাই ও আনোয়ারায় ইতোমধ্যে ব্যাপক শিল্পায়ন শুরু হয়ে গেছে। সমৃদ্ধি আর্জন করবে বাংলাদেশ।
কেএফ/