শিক্ষার্থীর তৈরি পকেট নেবুলাইজার, মিলবে ৫শ টাকায়!
নেবুলাইজার একটি বিশেষ ধরনের শ্বাস-প্রশ্বাসের ডিভাইস বা যন্ত্র যা ফুসফুসের বিভিন্ন সমস্যা যেমন অ্যাজমা, হাঁপানি, শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা, সিস্টিক ফাইব্রোসিস ইত্যাদিতে কষ্ট পাওয়া রোগীদের শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে সহযোগীতা করে। ফুসফুসে ওষুধ প্রয়োগের বহুল পরিচিত এই যন্ত্রটির দিয়ে তরল ওষুধকে সংকুচিত করে বায়ু বা অক্সিজেন দিয়ে স্প্রে বা অ্যারোসলে রূপান্তরিত করা হয়, যা খুব সহজেই নিঃশ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসের শ্বাসনালী ও অ্যালভিউলিতে ঢুকে শ্বাসকষ্ট দূর করে।
এই যন্ত্রে ব্রঙ্কোডাইলেটার, স্টেরয়েড ও প্রিভেন্টিভ...এই তিন ধরনের ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। শ্বাসনালি ক্লিয়ার রাখতেই এর ব্যবহার। ওষুধ, স্টেরিলাইজড ওয়াটার ও অক্সিজেন একসঙ্গে ভেপার তৈরি করে। নেবুলাইজারের মাধ্যমে তা পৌঁছে যায় ফুসফুসে। ফলে ওষুধ খেলে কাজ শুরু করতে যা সময় নেয়, তার চেয়ে অনেক কম সময়েই কাজ শুরু করে নেবুলাইজার। এতে চিকিৎসা ত্বরান্বিত হয়ে রোগীর দ্রুত কষ্ট লাঘব হয়।
আমাদের দেশে যে নেবুলাইজার পাওয়া যায় তা বিদেশ থেকে আমদানী করা। এগুলোর বাজারমূল্য ৪-৫ হাজার টাকা। ফলে অনেকেই টাকার অভাবে কিনতে পারেননা ওই যন্ত্র। কিছু হলেই ছুটতে হয় হাসপাতাল বা ক্লিনিকে। তবে এবার এক ক্ষুদে শিক্ষার্থী তৈরী করেছেন ওই নেবুলাইজার। চলছে উন্নয়নের কাজ। কাজ শেষ হলে সহজেই মাত্র ৫০০ টাকায় কিনতে পারবেন যে কেউ।
ওই ক্ষুদে আবিস্কারকের নাম রাকেশ সাহা। তিনি নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলার চাঁদপুর এলাকার রতন কুমার সাহা ও শিবানী রানী সাহার বড় ছেলে। তিনি স্থানীয় সিংড়া দমদমা পাইলট স্কুল এন্ড কলেজের ১০ম শ্রেণীর বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। তরুণ উদ্ভাবক রাকেশ পড়ালেখার পাশাপাশি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছেন।
পারিবারিক জীবনে দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনিই বড়। ছোটভাই শিশু শ্রেণীর শিক্ষার্থী। বাবা একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। আর মা গৃহিনী। পারিবারিক অস্বচ্ছলতার কারণে কিনতে পারেননি কোন কম্পিউটার বা ল্যাপটপ। তবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করার জন্য ব্যবহার করেন মিনি প্রসেসর আরডুইনো।
তিনি ইতোমধ্যেই চলতি বছর ৪৩ তম জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মেলায় সিংড়া দমদমা পাইলট স্কুল থেকে অংশগ্রহণ করে সিংড়া উপজেলা থেকে প্রথম স্থান, নাটোর জেলা থেকে দ্বিতীয় স্থান অর্জন সহ বঙ্গবন্ধু সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ প্রতিযোগিতায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে অংশগ্রহণ করে সিংড়া উপজেলা থেকে "সেরা মেধাবী" শিক্ষার্থীর স্থান অর্জন করেছেন।
রাকেশ সাহা জানান, কিছুদিন হল কোন প্রতিযোগিতা না থাকায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিছু প্রজেক্ট তৈরীর চিন্তা ভাবনা করলাম। এরপর আমার মাথায় এলো নেবুলাইজার মেশিন এর কথা। করোনার সময় থেকে দেখা যাচ্ছে অনেক মানুষ শ্বাসকষ্টে মারা যাচ্ছে। হাসপাতালে নেওয়ার মতো সময় ও তাদের হচ্ছে না। ফলে শ্বাসকষ্টের রোগীরা ব্যক্তিগতভাবে নেবুলাইজার মেশিন কিনতে চাচ্ছেন এবং অনেকে কিনছেনও।
তবে নেবুলাইজার মেশিনগুলো আমাদের দেশে তৈরি নয়। আমাদের দেশে আমদানি করতে হয়। তাই এইসব নেবুলাইজার মেশিন এর দাম প্রত্যেকটি ৪০০০ থেকে ৫০০০ টাকা। যা অনেক ব্যয়বহুল। তাই সবার সামর্থ্যও হয় না একটা নেবুলাইজার মেশিন ব্যক্তিগত ভাবে কেনার। এই বিষয়টি নিয়ে দুইদিন যাবত রিসার্চ করলাম। গুগল ইউটিউব সব জায়গায় আমি এসব তথ্য খুঁজতে লাগলাম। কেউ কি সব থেকে ছোট নেবুলাইজার মেশিন বানিয়েছে? কেউ কি কম খরচে নেবুলাইজার মেশিন বানিয়েছে? Google, youtube উইকিপিডিয়া এসব জায়গায় অনেক খোঁজাখুঁজি করলাম।
এরপর সেদিনই সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমিই তৈরি করব পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট, পকেটে বহনযোগ্য এবং সাশ্রয়ী নেবুলাইজার মেশিন। আমি কাজ শুরু করে দিলাম। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ব্যবস্থা করলাম। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুলো সাত দিনের মধ্যে পেয়ে গেলাম। কাজ শুরু করলাম একটা নেবুলাইজার মেশিন তৈরির। মাত্র তিনদিনের ভেতর আমার কাঙ্খিত যন্ত্রটি আবিষ্কার এ আমি সক্ষম হলাম।
তিনি আরো বলেন, আমার স্কুলের ফেরদৌস স্যারের সহযোগিতায় নেবুলাইজার মেশিনে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় ঔষধপত্র সংগ্রহ করলাম। স্যার আমাকে দুইটা ঔষধের নাম লিখে দিলেন। আমি ঔষধ গুলো নিকটস্থ ফার্মেসী থেকে কিনে আনলাম। ঔষধ গুলো আমার তৈরি পকেট নেবুলাইজার মেশিনে দিলাম। এরপর আমি এটি নিজেই ব্যবহার করে দেখলাম।
তিনি দাবী করেন, আমি নিজেই একজন শ্বাসকষ্টের রোগী। গত কয়েক বছর যাবত এটার জন্য আমি কলকাতায় চিকিৎসা করছি। আমাকে ইনহেলার ব্যবহার করতে হয়। আমার ইনহেলার টা শেষ হয়ে যাওয়ায় একটি ব্যবহার করে আমি খুব ভালো ফল পাচ্ছি।
রাকেশ আরো বলেন, আমার তৈরি এই মিনি পকেট নেবুলাইজারটি বেশ কাজে দিচ্ছে। বড় বড় নেবুলাইজার মেশিনগুলো ব্যবহার করার জন্য বিদ্যুৎ সংযোগের প্রয়োজন হয়।
এসব মেশিন থেকে অনেক শব্দ সৃষ্টি হয়। আমার তৈরি এই পকেট নেবুলাইজার মেশিনটি ছোট , দেখতে সুন্দর এবং পকেটে বহনযোগ্য। এমনকি এটি রিচার্জেবল হওয়ায় এটি ব্যবহারের জন্য বিদ্যুৎ সংযোগের কোন প্রয়োজন নেই। আমার তৈরি এই পকেট নেবুলাইজার মেশিনটি বড় মেশিনের মত শব্দ সৃষ্টি হয় না।
এই পকেট নেবুলাইজার মেশিনটি তৈরি করতে আমার প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা খরচ হয়েছে। ফলে এটি আমি অনেক কম খরচেই তৈরি করে সাধারণ মানুষের হাতে আমি পৌঁছে দিতে সক্ষম হব। তিনি বলেন, এটি অনেক কম দামে কিনতে পারবে সকলেই। এটা করা গেলে বড় বড় নেবুলাইজার মেশিনের আমদানি করতে হবে না।
এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে পকেট নেবুলাইজার মেশিনগুলো আমাদের দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানী করে আমাদের দেশ অনেক বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করতে পারবো বলে আমি আশা করছি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, ওই পকেট নেবুলাইজারে একটি ডিভাইস ব্যবহার করা হয়েছে। ওই ডিভাইসের মাধ্যমে উচ্চমাত্রার শব্দ কম্পন তৈরী করে এর মাধ্যমে নেবুলাইজারে সরবরাহ করা তরল ঔষধ বাষ্পে পরিণত হয়ে ফুসফুসে পৌছে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান,তিনি ইতোমধ্যেই ওই নেবুলাইজার পরীক্ষার জন্য উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সের ডাক্তারদের দেখিয়েছেন। ডাক্তাররা ওই নেবুলাইজারটির কার্যকারীতা বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে কিছু আপগ্রেড করতে বলেছেন। সেই কাজটিই এখন চলছে। তবে ওই নেবুলাইজার উৎপাদন ও বাজারজাত করতে অর্থনৈতিক সহযোগীতার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট বিভাগের অনুমতি প্রয়োজন।
এজন্য তিনি তার শুভাকাঙ্খিসহ আইসিটি প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট জুনাইদ আহমেদ পলক,স্বাস্থ্য বিভাগ ও প্রধানমন্ত্রীর সহযোগীতা কামনা করেন। সিংড়া দমদমা স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী প্রধান শিক্ষক আফছার আলী জানান,তিনি তার ওই ছাত্রের বিষয়ে জানেন। ওই কাজে সবসময়ই উৎসাহ দিয়েছেন দাবী করে বলেন, ওই ছাত্রর স্বপ্ন পূরণ ও নেবুলাইজারটি তৈরী ও বাজারজাত করতে প্রয়োজনীয় সকল সহযোগীতা করবেন তিনি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সিংড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার আমিনুল ইসলাম জানান,ওই নেবুলাইজারটি তিনি ছাড়াও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আব্দুর রাজ্জাক ও আরএমও ডাক্তার শিবলী নোমানী পরীক্ষা করে কার্যকারীতা ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছেন।
তবে ওই নেবুলাইজারে এন--95 মাস্কের বদলে অন্য এক ধরণের মাস্ক ব্যবহার ও নেবুলাইজারটি কিছুটা আপগ্রেড করতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে দাবী করে তিনি বলেন, ফুসফুসে সংক্রমণ হলে বা ওষুধ দিতে হলে নেবুলাইজারের মাধ্যমেই তা দেওয়া হয়ে থাকে। এতে কাজ হয় তাড়াতাড়ি। ওই শিক্ষার্থীকে ওই নেবুলাইজার তৈরীর অনুমোদনসহ সংশ্লিষ্ট সকল সহযোগীতা করা হবে এমন আশ্বাস দেন তিনি।
এএজেড