জাহাজ নির্মাণ শিল্পে এগিয়ে খুলনা শিপ ইয়ার্ড
জাহাজ রপ্তানিতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে অন্যতম প্রতিষ্ঠান খুলনা শিপ ইয়ার্ড। এটি বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। জার্মানির সহায়তায় প্রায় ৬৫ বছর আগে যাত্রা শুরু করেছিল এই শিপ ইয়ার্ড। তবে আশির দশকের দিকে এটি লোকসানের মুখে পড়ায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। এরপর ১৯৯৯ সালের দিকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মৃতপ্রায় প্রতিষ্ঠানটিকে বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করেন। তার পর থেকেই ধারাবাহিকভাবে ইয়ার্ডটি উন্নয়নশীল লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও গত ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি নিট মুনাফা করেছে ৪৩ দশমিক ২২ কোটি টাকা।
এ প্রসঙ্গে এক সময়ের বাংলাদেশে সাড়া জাগানো ম্যাজিষ্টেটি এবং বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তরের ডিরেক্টর (এনফোর্সমেন্ট) মুনীর চৌধুরী জানান, তিনি ৫/৬ মাস আগেই খুলনা শিপ ইয়ার্ড দিয়ে ঘুরে এসেছেন এবং সেখানকার পরিবেশ সন্তোষজনক। বাংলাদেশের যেকোনো শিপ ইয়াডের চেয়ে খুলনা শিপ ইয়ার্ড ভালো অবস্থানে রয়েছে। তিনি বাংলাদেশের সকল শিপ ইয়ার্ডকে খুলনা শিপ ইয়ার্ড অনুসরন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের আইন মানতে অনুরোধ জানান।
খুলনা শিপ ইয়ার্ডের সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে কথা বলে বোঝা যায়, প্রতিযোগিতা মূলক দাম, স্বল্প সময়ে ডেলিভারি, কারিগরি দক্ষতার দায়িত্ববোধ, গুণগত মান, গ্রাহক বান্ধব সম্পর্ক, সেবা, পেশাগত ব্যবস্থাপনা, শ্রম প্রত্যায়ন, দক্ষতা সম্পন্ন কর্মশক্তি, মানব সম্পদ উন্নয়ন ইত্যাদি মিলিয়ে খুলনা শিপ ইয়ার্ড লিমিটেড শুধু বাংলাদেশে নয় বরং সমগ্র পৃথিবীতে একটি উজ্জবল নক্ষত্রে পরিণত হয়েছে। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে দেশান্তরের মানুষের নৌযানের জন্য হয়ে উঠেছে এক নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান।
এ ব্যাপারে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় এবং জাহাজ নির্মাণ খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বিভিন্ন দেশের আমদানিকারকরা বাংলাদেশ থেকে জাহাজ আমদানি করতে চাইছে। গত কয়েক বছরে দেশের শিপ ইয়ার্ডগুলো ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার কয়েকটি দেশে ৪০টি জাহাজ রপ্তানি করে। তাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়েছে। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় জাহাজ যুক্তরাজ্যে রপ্তানি করা হয়েছে। দেশের অন্য উদ্যোক্তারাও জাহাজ শিল্পে নতুন স্বপ্ন দেখছেন। জাহাজ নির্মাণে অনুকূল পরিবেশ থাকায় উদ্যোক্তাদের এ খাতে নতুন বিনিয়োগ বৃদ্ধিরও পরিকল্পনা রয়েছে। কারণ বাংলাদেশের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের আমদানিকারকরা আগ্রহী হয়ে উঠছে। এ জন্য বিশ্ববাজারে ছোট ও মাঝারি নৌযানের জন্য বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্প গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। তাইতো অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা পূরণ করে গত এক দশকে এ খাতের রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে।
দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ জালানি, ৭০ শতাংশ কার্গো এবং ৩৫ শতাংশ যাত্রী নৌ-পথে পরিবাহিত হয়, যা দেশের অভ্যন্তরে জাহাজের চাহিদা ব্যাপক বৃদ্ধি করেছে। দেশে ছোট-বড় মিলে প্রায় ৩০০ শিপ ইয়ার্ড রয়েছে। তবে তার মধ্যে মাত্র ১০টি প্রতিষ্ঠান রপ্তানিযোগ্য জলযান তৈরি করে। আর এসব জলযান নির্মাণে প্রায় ৩ লাখ মানুষ জড়িত।
সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়,অভ্যন্তরীণ বাজার ১০-১৫ শতাংশ হারে এবং রপ্তানি বাজার ৫-৬ শতাংশ হারে বাড়ছে। বর্তমানে ১০০টিরও বেশি জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান এবং ১২০টিরও বেশি নানা আকারের নিবন্ধিত শিপ ইয়ার্ড রয়েছে। দেশে ছোট-বড় মিলে পায় তিন শতাধিক শিপ ইয়ার্ড রয়েছে। তার মধ্যে ১০টি রপ্তানিযোগ্য জাহাজ তৈরি করে।
দেশের অভ্যন্তরে ব্যবহারের জন্য স্থানীয়ভাবে নির্মিত নৌযানের মধ্যে রয়েছে এমপিভি, কন্টেনার, বাল্কার, ট্যাঙ্কার, ড্রেজার, টাগ এবং যাত্রীবাহী ফেরি। আকারে ওসব ১-২০ হাজার বিডাব্লিউটির মধ্যে।
এদিকে গত ২০১৮ সাল থেকেই বৈশ্বিক বাজারে আবারো বাংলাদেশের অবস্থান ফেরাতে শুরু করে জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। ইউরোপের বাজারে পরিবেশ বান্ধব জাহাজের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় জাহাজ রপ্তানিতে নতুন নতুন অর্ডার আসতে শুরু করেছে। ফলে বাংলাদেশও এখন পরিবেশ বান্ধব জাহাজ নির্মাণ করছে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৮ সালে অত্যাধুনিক কন্টেনার জাহাজ ‘স্টেলা মেরিস’ ডেনমার্কে রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রথম জাহাজ রপ্তানি শুরু হয়। তারপর মাত্র দুই বছরে বিভিন্ন দেশে ১১টি জাহাজ রপ্তানি করে বাংলাদেশ।
জানা গেছে, জাহাজ শিল্পে নতুন স্বপ্ন দেখছে দেশীয় উদ্যোক্তারা । জাহাজ নির্মাণে অনুকূল পরিবেশ থাকায় নতুন বিনিয়োগ বৃদ্ধিরও পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। বর্তমানে বিশ্বের উপকূলীয় দেশগুলো সমুদ্র কেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে-জোর দিচ্ছে। এ কারণে সমুদ্র থেকে মৎস্য ও খনিজ সম্পদ আহরণ, সামুদ্রিক নবায়নযোগ্য শক্তি, সামুদ্রিক পর্যটন, সমুদ্র নিরাপত্তা ও গবেষণা ঘিরে কর্মযজ্ঞ বাড়ছে। সেজন্য উচ্চ প্রযুক্তির বিশেষায়িত ছোট-বড় জাহাজ সমুদ্র অর্থনীতির ওইসব কর্মকাণ্ডের জন্য প্রয়োজন। ইতিমধ্যে জাহাজ ভাড়া ২৫-৩০ শতাংশ বেড়ে গেছে। আর বিশ্ববাজারেও ব্যাপক হারে বেড়েছে জাহাজের চাহিদা। তার সুফল পাচ্ছে দেশীয় রপ্তানিকারকরা। পাশাপাশি এ খাতের রপ্তানি বাড়াতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে সরকারও। রপ্তানিকারকদের নগদ সহায়তা, কর ছাড়সহ নানা প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। ওই খাতে ব্যাংকগুলোও মোটা অঙ্কের অর্থায়ন করেছে। একটি নীতিমালাও করা হয়েছে। আর বাংলাদেশ ব্যাংক জাহাজ নির্মাণ শিল্পের উন্নয়ন, পরিচালনা ও বিকাশের লক্ষ্যে ২ হাজার কোটি টাকার একটি পুনরায় অর্থায়ন স্কিম গঠন করেছে। তাতে প্রত্যাশা করা হচ্ছে জাহাজ রপ্তানি থেকে বছরে ৪ বিলিয়ন ডলার আয় হবে।
সূত্র আরো জানায়, জাহাজ রপ্তানি থেকে গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১ কোটি ১৩ লাখ ২০ হাজার ডলার আয় করে বাংলাদেশ। বিশ্ববাজারে সম্ভাবনা থাকায় ২০২০-২১ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা প্রায় দ্বিগুণ বাড়িয়ে ১ কোটি ৮০ লাখ ডলার ধরা হলেও তখন রপ্তানিকারকরা কোনো জাহাজই রপ্তানি করতে পারেননি। ওই কারণে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় মাত্র ২ হাজার ডলার। মহামারীর বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে নামমাত্র ওই লক্ষ্য ধরে সরকার। তারপরও অর্থবছর শেষে ওই খাত থেকে ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়। তবে ওই সময় জাহাজ রপ্তানিকারকরা প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু এরপর আবার ঘুরে দাঁড়ায় জাহাজ রপ্তানি। ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় জাহাজের চাহিদাও ব্যাপকভাবে বাড়তে শুরু করে। ফলে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে ১০০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়।
এদিকে বাংলাদেশ থেকে জাহাজ আমদানিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে ইরান ও ভারতের ব্যবসায়ীরা। বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক উইংয়ে ওই আগ্রহ প্রকাশ করা হয়। এমন আগ্রহ থেকে যুদ্ধ জাহাজ তৈরি করা শুরু করে খুলনা শিপ ইয়ার্ড।
এ প্রসঙ্গে খুলনা শিপ ইয়ার্ডের এক কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশ সরকারের সরাসরি সহযোগিতা ও নৌবাহিনীর মাননীয় প্রধানের অবদানে খুলনা শিপ ইয়ার্ড আজ অনেক উন্নত। আইএসও সনদ ও রপ্তানীমুখী জাহাজ তৈরির অনুমোদন পাওয়ায় তিনি এখানকার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমোডর এস ইমরানকে ধন্যবাদ জানান।
তিনি আরও জানান, এমনকি তার সময়ে বিগত ২০ বছরের চেয়ে ৪/৫ গুন বেশি লাভ হয়েছে। বতমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেই ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন রেখেই সামনে এগিয়ে চলছেন।
এসআইএইচ