পাট শুকাতে ব্যস্ত চাষিরা, তবুও লোকসানের শঙ্কা
কুড়িগ্রামে পাটের আঁশ ছাড়ানো ও শুকাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা। কিন্তু দাম কম থাকায় লোকসানের আশঙ্কা করছেন তারা। চলতি মৌসুমের এক থেকে দেড় মাস অনাবৃষ্টির কারণে খাল-বিল শুকিয়ে যাওয়ায় ঠিক সময়ে পাট পচাতে পারেননি চাষিরা।
খরার কারণে অতিরিক্তি খরচ করে অনেক চাষি দূর-দূরান্তে নদ-নদীতে পাট পচানোর ব্যবস্থা করেন। আবার অনেক চাষি পাটকাঠির আশা ছেড়ে দিয়ে শুধু আঁশ তুলে স্বল্প পানিতে ‘রিবন রোটিং’ পদ্ধতিতে পাট পঁচার ব্যবস্থা করেন। তবে গত দেড় সপ্তাহ ধরে টানা বৃষ্টিতে নদ-নদী ও খাল-বিল ভরে যাওয়ায় পাট চাষিদের মাঝে স্বস্তি দেখে দিয়েছে।
কুড়িগ্রাম কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, এ বছর চলতি মৌসুমে কুড়িগ্রাম জেলায় পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ১৯ হাজার ৬০২ হেক্টর। অর্জন হয়েছে ১৬ হাজার ৫৭৭ হেক্টর। গত বছরের তুলনায় এ বছর কম পাট চাষ করেছেন কৃষকরা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বিভিন্ন নদ-নদীতে পাট চাষিরা এখনো পাট পচাচ্ছেন। আবার অনেকেই পাটের আঁশ ছাড়ানো ও পাট শুকাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। একই সঙ্গে বিভিন্ন হাট-বাজারে পাট উঠতেও শুরু করেছে। এ ছাড়া পাট কিনতে দূর-দূরান্ত থেকে পাইকাররা আসছেন। বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় তাদের পাট কিনতেও দেখা গেছে।
বিভিন্ন এলাকার পাট চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার একদিকে খরা আর অন্যদিকে শ্রমিকসহ কৃষিতে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। পাটের মণ আড়াই হাজার, ২ হাজার ৭০০, ২ হাজার ৮০০ ও ৩ হাজার টাকায় বিক্রি করতে পারলেও লোকসানের আশঙ্কা করছেন পাট চাষিরা।
নাগেশ্বরী উপজেলার বদিজামারপুর এলাকার পাট চাষি পীজুষ চন্দ্র রায় ও আবুল কামাল জানান, তারা প্রত্যেকেই দেড় বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছেন। অনাবৃষ্টির কারণে বাড়ি থেকে ২ কিলোমিটার দূরে এক ডোবার হাঁটু পানিতে পাট পচে আঁশ ছাড়ানোর কাজ শেষ করেছেন। এই দুই চাষি বেশিরভাগ কাজ নিজেরাই করেছে বলে বিঘায় ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এই দুই চাষির পাটের আঁশ ছাড়ানোর বদলে পাটকাঠি দেওয়ায় অনেকেই পাটের আঁশ ছড়ানোর কাজ করে দেন। বিঘায় ৫ মণ পাট আসায় দেড় বিঘায় সাড়ে ৭ মণ পাট হয়েছে পাট চাষি কাসেমের।
ফুলবাড়ী উপজেলার নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের গোরকমন্ডল এলাকার কৃষক নজরুল ইসলাম জানান, তিনি এ বছর ৪ বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছেন। এ বছর অতিরিক্ত খরার কারণে ফলন ভালো হয়নি। তবে এবার পাট চাষে খরচ বেশি হয়েছে। তাই বিঘাপ্রতি ৬ মণ পাট আসবে।
তিনি আরও জানান, প্রতি বিঘায় পাট চাষ করতে খরচ হয়েছে ১০ হাজার টাকার বেশি। আমার পাটের বর্তমান বাজার দর ২৫০০ থেকে ২৭০০ টাকা। ফলন ভালো ও পাটের রং ভালো হলে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। পাটের মণ ৩ হাজার ৫০০ থেকে ৪ হাজার টাকা মণ হলে পাট চাষিরা লাভবান হবেন। তা না হলে পাট চাষিদের লোকসান গুনতে হবে।
একই ইউনিয়নের পূর্ব ফুলমতি এলাকার পাট চাষি তৈয়ব আলী জানান, তিনি এ বছর ৮ বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছেন। পাট রোপণের কিছুদিনের মধ্যে টানা বৃষ্টিতে ৫ বিঘা জমির পাট নষ্ট হয়ে গেলেও ৩ বিঘা জমির পাট ঘরে তুলতে পেরেছেন।
তিনি জানান, এক বিঘা জমিতে হালচাষ, সার, কীটনাশক, পাট বীজসহ খরচ প্রায় ৫ হাজার টাকা। এক বিঘা পাট কাটা ও জাগ দিতে শ্রমিককে দিতে হয় ৬ হাজার টাকা। পাটের বোঝা হয় ২০০-২৫০টি। ২০টি পাটের বোঝার আঁশ ছাড়ানোর জন্য শ্রমিককে দিতে ৪০০ টাকা। এক বিঘা পাটের আঁশ ছাড়ানোর মোট ব্যয় ৫ হাজার টাকা। সবমিলিয়ে এক বিঘা জমির পাট চাষ করতে খরচ হয় ১৬-১৭ হাজার টাকা। ভালো ফলন হলে এক বিঘা পাটের জমিতে পাট আসবে ৮-১০ মণ। বর্তমান পাটের বাজার ২ হাজার ৫০০, ২ হাজার ৭০০, ৩ হাজার টাকা।
তিনি আরও জানান, সার, কীটনাশক, শ্রমিকসহ যে পরিমাণ খরচ বাড়ছে তাতে পাটের দাম ৩৫০০-৪ হাজার টাকা মণ বিক্রি করতে পারলে পাট চাষিরা লাভের মুখ দেখবেন। তা না হলে প্রতিবছর পাট চাষিরা লোকসান গুনতে গুনতে পাট চাষে আগ্রহ হারাবে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা লিনুফা ইয়াছমিন বলেন, চলতি মৌসুমে ফুলবাড়ী উপজেলায় পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৭৫৯ হেক্টর। পাট রোপণের সময় অতিবৃষ্টির কারণে এ বছর ৫৪০ হেক্টর জমিতে পাট চাষিরা পাট চাষ করেছেন।
তিনি আরও বলেন, পাট চাষ এখন পরিত্যক্ত জমি ও চর এলাকাগুলোতে হচ্ছে। উন্নতজাতের পাট চাষ করতে কৃষি বিভাগ প্রান্তিক চাষিদের পাট চাষে উদ্বুদ্ধ করছে। কৃষি বিভাগ চলতি পাট মৌসুমে বিভিন্ন স্থানে কৃষকের মাধ্যমে প্রদর্শনী প্লট তৈরি করেছি। বর্তমান পাটের বাজারে চাষিরা ২ হাজার ৮০০ টাকা থেকে ৩ হাজার টাকায় পাট বিক্রি করছেন। দাম বাড়লে পাট চাষিরা আরও লাভবান হবে।
এসজি