চা শ্রমিক আন্দোলন
১৪ বছরে মজুরি বেড়েছে সাড়ে ৮৭ টাকা
ফাইল ছবি
দৈনিক মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন চা শ্রমিকরা। দফায় দফায় বৈঠক হলেও কোনো কার্যকরী সিদ্ধান্ত আসেনি। এর ফলে ১৮ দিন ধরে চলছে তাদের এই আন্দোলন। এর মধ্যে প্রথম ৪ দিন তারা দুই ঘণ্টা করে কর্মবিরতি পালন করেন। আর ১৪ দিন ধরে চলছে ধর্মঘট।
এদিকে ২০০৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত গত ১৪ বছরে চা শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে সাড়ে ৮৭ টাকা। ২০০৮ সালে দৈনিক ভিত্তিতে নিয়োজিত একজন চা শ্রমিকের সর্বোচ্চ মজুরি ছিল ৩২ টাকা ৫০ পয়সা। ২০০৯ সালের জুলাই মাসে চা শ্রমিকদের জন্য দ্বিতীয়বারের মতো গঠিত নিম্নতম মজুরি বোর্ড চা শ্রমিকদের জন্য নিম্নতম দৈনিক মজুরি নির্ধারণ করে দেয়। তখন 'এ' ক্লাস বাগানের জন্য মজুরি নির্ধারণ হয় ৪৮ টাকা, 'বি' ক্লাস বাগানের জন্য ৪৬ টাকা এবং 'সি' ক্লাস বাগানের জন্য ৪৫ টাকা নির্ধারিত হয়।
২০১৪ সালের ১০ আগস্ট গোপন ব্যালটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয় বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যকরী পরিষদ। নির্বাচনের পর বাংলাদেশীয় চা সংসদের সঙ্গে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের যে চুক্তি হয় তাতে চা শ্রমিকের দৈনিক নগদ মজুরি দাঁড়ায় 'এ' ক্লাস বাগানের জন্য ৮৫ টাকা, 'বি' ক্লাস বাগানের জন্য ৮৩ টাকা এবং 'সি' ক্লাস বাগানের জন্য ৮২ টাকা। এ বেতন কাঠামো ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয়।
গোপন ব্যালটের মাধ্যমে চা শ্রমিক ইউনিয়নের তৃতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৮ সালের ২৪ জুন। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের বিজয়ী প্যানেলের সঙ্গে বাংলাদেশীয় চা সংসদের সর্বশেষ চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হয় ২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে দুই বছরের জন্য কার্যকর চুক্তিপত্র অনুসারে চা শ্রমিকদের মজুরি 'এ' ক্লাস বাগানের জন্য ১২০ টাকা, 'বি' ক্লাস বাগানের জন্য ১১৮ টাকা এবং 'সি' ক্লাস বাগানের জন্য ১১৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
দৈনিক নগদ মজুরির পাশাপাশি শ্রমিক কলোনিতে একটি ঘর ছাড়াও প্রান্তিক সুবিধা হিসেবে চা শ্রমিকরা আরও কিছু সুবিধা পান। যেমন: ভাতা, হাজিরা উৎসাহ বোনাস, হ্রাসকৃত মূল্যে রেশন, ফসল উৎপাদনের জন্য ক্ষেতল্যান্ড ব্যবহারের সুযোগ (যে শ্রমিক এ সুযোগ গ্রহণ করে, তার রেশন আনুপাতিক হারে কেটে নেওয়া হয়), চিকিৎসা সুবিধা, প্রভিডেন্ট ফান্ড, পেনশন ইত্যাদি।
দৈনিক মজুরি এবং অন্যান্য যেসব সুবিধা চা শ্রমিকরা পান সেসব যোগ করলে তাদের মোট দৈনিক প্রাপ্তি ২০২০ সালে এসে ২০০ টাকারও কম এমন দাবি বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন ও অন্যান্য অনেকের।
এর মধ্যে ২০১৯ সালের শেষার্ধে চা শ্রমিকের মজুরি নির্ধারণের জন্য তৃতীয়বারের মতো নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠন করে সরকার। মজুরি বোর্ডে শ্রমিক ও মালিক উভয় পক্ষের প্রতিনিধি রয়েছে। মজুরি বোর্ডে শ্রমিক পক্ষের প্রতিনিধি রামভজন কৈরী জানিয়েছেন, নিম্নতম মজুরি বোর্ডের কাছে তারা দৈনিক নগদ মজুরি ৩০০ টাকা দাবি করছেন।
বাংলাদেশ চা শ্রমিকের পাশাপাশি অন্য কিছু পক্ষও তাদের সুপারিশ পাঠিয়েছে নিম্নতম মজুরি বোর্ডের কাছে। তবে মালিক পক্ষ বলছে, চায়ের দাম পড়ে গেছে। কাজেই মজুরি বাড়ানোর সুযোগ নেই। শ্রমিকদের চরমভাবে হতাশ করে মঞ্জুরি বোর্ড ২০২১ সালের জুনে শ্রম মন্ত্রণালয়ে যে সুপারিশ পাঠায় তাতে শ্রমিকদের মজুরি না বাড়িয়ে ১২০ টাকাই রাখা হয়। বরং শ্রমিকরা এতদিন ধরে যেসব সুযোগ সুবিধা পেয়ে আসছেন তা কমানোর সুপারিশ করে মজুরি বোর্ড। তবে শ্রম মন্ত্রণালয় শ্রম আইন অনুসরণ করে মজুরি বোর্ডের প্রস্তাবিত মজুরি কাঠামো পুনর্বিবেচনার জন্য ফেরত পাঠায়। এরপরও মজুরি বোর্ড তার সুপারিশে কোনোরকম পরিবর্তন না আনায় ২০২১ সালের ১৭ নভেম্বর শ্রম প্রতিমন্ত্রীর সভাপতিত্বে চা শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণের ব্যাপারে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়।
জানা গেছে, এ সভায় কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে মজুরি বোর্ডকে। এরপরও মজুরি না বাড়ানোর ব্যাপারে শক্ত অবস্থানে থাকা মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান সুলতান মাহমুদ (সিনিয়র জেলা জজ) অবসরে যাওয়ায় এখন পর্যন্ত মজুরি বোর্ড চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। এমন পরিস্থিতি চা শ্রমিকদের জন্য চরম হতাশাজনক। কারণ তারা বর্তমানে যে মজুরি পাচ্ছে তা ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কার্যকর। ২০২১ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে তাদের মজুরি বাড়ার কথা। একদিকে মজুরি বোর্ড নিয়ে অচলাবস্থা অন্যদিকে মালিক-শ্রমিক পক্ষের দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বিলম্ব। সাধারন চা শ্রমিকরা দ্রুত মজুরি নিয়ে এ অচলাবস্থার অবসান চান।
মজুরি বোর্ডে শ্রমিকপক্ষের একমাত্র প্রতিনিধি ও বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাহী উপদেষ্টা রামভজন কৈরী বলেন, মজুরি নিয়ে এসব সমস্যার প্রধান হলো মজুরি বোর্ড। তারা এত মিটিং-আলোচনার পরও এক টাকাও বাড়াতে চায়নি। মজুরি বোর্ড যদি মালিকদের কথা না শুনে একটা নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত দিত তাহলে আজকের এই সমস্যা তৈরি হতো না। আমি মজুরি বোর্ডের কাছে যে প্রস্তাব করেছিলাম সেগুলো তারা উপেক্ষা করেছে। তাই আমি ওইসব মিটিং এ স্বাক্ষর না করেই বেরিয়ে এসেছি।
বাংলাদেশ চা কন্যা নারী সংগঠনের সভাপতি খাইরুন আক্তার বলেন, এই যে মজুরি বৃদ্ধির হার সেটা কোনোভাবেই সন্তোষজনক নয়। উপমহাদেশের ১৮৭ বছরের চা শিল্পের ইতিহাসে যদি ১ টাকা করে প্রতিবছর মজুরি বাড়ত তাহলেও আমাদের মজুরি ১৮৭ টাকা হতো। মজুরি বোর্ড ও মালিকপক্ষ মিলে চক্রান্ত করে আমাদের মজুরি বাড়াতে চায় না।
এ বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তারা এ বিষয়ে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান তারা।
তবে বাংলাদেশ চা শ্রমিক অধিকার পরিষদের আহ্বায়ক মোহন রবিদাস বলেন, এই যে গত দুই চুক্তিতে অল্প অল্প করে টাকা বাড়ানো হলো এ নিয়ে ইউনিয়ন কোনো আন্দোলন করল না। ইউনিয়ন যদি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করত তাহলে আমাদের বর্তমান মজুরি ৩০০ টাকাই থাকত।
এদিকে টানা ১৪ দিনের মতো ধর্মঘট পালন করছেন চা শ্রমিকরা। শুক্রবারও জেলার ৯২টি চা বাগানে কোথাও কোনো কাজ হয়নি। আন্দোলনরত চা শ্রমিকরা জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী যেহেতু শনিবার বাগান মালিকদের সঙ্গে বসবেন তাই তারা আজ বাগানের ভেতরই মিছিল সমাবেশ করেন।
প্রসঙ্গত, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং থেকে জানানো হয়েছে, শনিবার (২৭ আগস্ট) বিকালে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী বাগান মালিকদের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন।
এসজি