২৮ বছরের রাজত্ব অফিস সহকারী দুলালের
বরগুনা সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের উচ্চমান সহকারী দুলাল কৃষ্ণ মালাকারের (দুলাল বাবু) বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলা, ঘুষ বাণিজ্য, কাঙ্খিত উৎকোচ না পেয়ে শিক্ষকদের হয়রানিসহ একাধিক অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগের প্রতিকার চেয়ে গত ৩০ জুলাই জেলা প্রাথমিক অফিসার বরাবর লিখিত আবেদন করেছেন বরগুনা সদরের বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত ৪১ জন শিক্ষক।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার এম এম মিজানুর রহমান অভিযোগ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, দুলাল কৃষ্ণের বিরুদ্ধে শিক্ষকদের অভিযোগ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
অভিযোগে বলা হয়, সহকারীি শিক্ষকদের ২০২০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারী থেকে প্রাপ্য ১৩তম গ্রেডের বকেয়া বিল (২০২২ সালের ১৫ জুন পর্যন্ত) প্রদানের জন্য বরগুনা সদরের প্রায় ৬০০ সহকার শিক্ষকের কাছ থেকে ১ হাজার টাকা করে অন্তত ৬ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণ করেছেন। ঘুষ নেয়ার পরও এখন পর্যন্ত শিক্ষকদের বকেয়া বিল দিতে পারেননি।
শিক্ষকদের অভিযোগ, দুলাল কৃষ্ণ এসব ঘুষ বাণিজ্যে ব্যস্ত থাকায় ২০২১-২২ অর্থবছরে বিভিন্ন বিদ্যালয়ের ৩৯টি চেক নির্ধারিত সময় ২৬ জুলাইয়ের মধ্যে অফিসের ব্যাংক হিসাব নম্বরে জমা দিতে পারেননি। যার টাকার অঙ্ক ১ কোটি ৫৮ লাখ টাকা।
শিক্ষকদের দাবি, দুলাল কৃষ্ণ দায়িত্বে অবহেলা এবং শিক্ষকদের কাছ থেকে এসব টাকার কাঙ্খিত উৎকোচ না পেয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে নির্ধারিত সময়ে ব্যাংকে চেক জমা করেননি। যার কারণে উক্ত টাকা অর্থ মন্ত্রণালয়ে চলে গেছে। এ টাকা পুনরায় পেতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনেক ভোগান্তির শিকার হতে হবে।
দুলাল কৃষ্ণের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগে আরও বলা হয়, তিনি শিক্ষকদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে অবসরপ্রাপ্ত জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আ. মজিদের স্বাক্ষর জাল এবং একই স্বারক ব্যবহার করে নির্ধারিত মেয়াদের আগেই শিক্ষকদের স্থায়ীকরণে আদেশ দেন। বরগুনা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের কার্যালয়ের ২০১৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর একটি অফিস আদেশে ৪৩ জন শিক্ষককে স্থায়ীকরণ করা হয়েছে। যার স্মারক নম্বর ১৮৪৯/৪০। তবে আবেদনকারীদের দাবি স্মারক নম্বরটি ভুয়া।
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, দুলাল কৃষ্ণ দীর্ঘদিন একই স্থানে চাকরি করার সুবাদে অনেকটা বেপরোয়া হয়ে গেছেন। বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হয়রানির পাশাপাশি যখন যে শিক্ষা কর্মকর্তা আসেন তার নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে হয়। অন্যথায় ওই কর্মকর্তা বেশি দিন স্থায়ী হতে পারেন না। তিনি দীর্ঘ ২৮ বছর বরগুনা সদর উপজেলা শিক্ষা অফিসে দায়িত্বরত আছেন। এর মধ্যে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগের কারণে অন্যত্রে বদলি করে শিক্ষা বিভাগ। তবে ২ বছর পরই তিনি পুনরায় পূর্বের স্থানে চাকরিতে বহাল আছেন। এ ছাড়াও তিনি সদরের ২২৮টি বিদ্যালয়ের মধ্যে ৪৮টি বিদ্যালয়ে কোভিড-১৯ এর মালামাল ক্রয়ের জন্য বরাদ্দকৃত টাকা উপজেলা শিক্ষা অফিসারের ব্যাংক হিসাব নম্বরের অনুকূলে (জনতা ব্যাংক, বরগুনা শাখা) বরাদ্ধ দেওয়া হলেও উক্ত টাকা বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে দিতে গরিমসি করছেন।
এ বিষয়ে কড়ইতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারীি শিক্ষক মো. মোস্তাফিজুর রহমান লিটন বলেন, অফিস সহকারীি দুলাল বাবুর বেপরোয়া আচরণ, ঘুষ বাণিজ্য এবং শিক্ষক হয়রানি কোনোভাবেই থামছে না। তাকে উৎকোচ না দিয়ে ওই অফিসে কোনো কাজ করা সম্ভব হয় না। যদি কোনো শিক্ষক তার চাহিদা মতো উৎকোচ দিতে না পারে। তাহলে তাকে নানাভাবে হয়রানি শুরু করেন। তাই প্রায় অর্ধশত শিক্ষক-শিক্ষিকা নিরুপায় হয়ে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি। যদি তার এসব কর্মকাণ্ড থামানো না হয় তাহলে আমরা বৃহত্তর আন্দোলনে যেতে বাধ্য হবো।
এসব অভিযোগের বিষয়ে দুলাল কৃষ্ণ মালাকার জানান, উৎকোচ না দেওয়ায় ইচ্ছাকৃতভাবে চেকগুলো নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পাঠানো হয়নি বলে যে অভিযোগ তা সত্য নয়। ভুলবশত নির্ধারিত সময়ের মধ্যে চেকগুলো জমা হয়নি। এগুলো পুনরায় পাওয়ার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। চাকরি স্থায়ীকরণের জন্য ৩ বছর সময় লাগে বলে জানান তিনি।
তবে দুই বছর আগে কিছু শিক্ষকের চাকরি কিভাবে স্থায়ীকরণের আদেশ দেওয়া হয়েছে এ বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
এ ব্যাপারে বরগুনা সদর উপজেলা শিক্ষা অফিসার মো. নাছির উদ্দিন জানান, অফিসের উচ্চমান সহকারীির ভুলের কারণে নির্ধারিত সময়ে ৩৯টি চেক ব্যাংকে জমা হয়নি।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার এম এম মিজানুর রহমান জানান, সদর উপজেলা শিক্ষা অফিস নির্ধারিত সময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ৩৯টি চেক জমা দেননি। ভুলবশত নির্ধারিত সময়ে চেক জমা করেননি এমনটা জানানো হয়েছে। তবে এটি দায়িত্ব অবহেলা। তাই এ ব্যাপারে জবাব চেয়ে চিঠি দেওয়া হবে। আর দুলাল কৃষ্ণের বিরুদ্ধে শিক্ষকদের অভিযোগ পেয়েছি। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে এ বিষয়ে জানানো হবে।
এসআইএইচ