বিশ্ব বাঘ দিবস
সুন্দরবনে হুমকির মুখে রয়েল বেঙ্গল
বিশ্ব বাঘ দিবস আজ। সারা দেশের মত বাংলদেশেও পালিত হচ্ছে দিবসটি। বাগেরহাটের সুন্দরবন ঘেষা মোংলা ও শরণখোলায়ও দিবসটি উপলক্ষে নানা কর্মসূচী গ্রহন করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৮ জরিপ অনুযায়ী সুন্দরবনে বাঘ আছে ১১৪ টি। যদিও ২০১৯ সাল থেকে এই পর্যন্ত বয়ষের কারণে মারা গেছে কয়েকটি বাঘ। একই সাথে চোরা শিকারী ও পাচারকারী চক্রের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে বাঘের চামড়াসহ অংগ-প্রত্যঙ্গ।
তবে কয়েক দফায় সুন্দরবন ভ্রমনে আসা পর্যটকরা বাঘের দেখা পেয়েছেন। আবার সুন্দরবন সংলগ্ন লোকালয়েও বাঘ চলে এসেছে। একই সাথে বনবিভাগের সদস্যরা সুন্দরবনের বিভিন্ন অংশে বাঘের উপস্থিতি টের পেয়েছেন। এ থেকে অনুমান করা হচ্ছে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লোকালয়ে বাঘ আসার অর্থ বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি নয়। সুন্দরবনে বাঘ সংরক্ষন ও বৃদ্ধির জন্য আরো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী।
পরিবেশবাদীদের দাবী, চোরা শিকারীদের দৌরাত্ত, সুন্দরবনে বিষ দিয়ে মাছ ধরাসহ নানা প্রতিকূলতার কারনে হুমকীর মুখে সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার। তারা বলছেন, সুন্দরবনই হচ্ছে এশিয়ার মধ্যে রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ বন্যপ্রাণীর বৃহত্তম আবাসভূমি। বন বিভাগ রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসভূমিকে তাদের জন্য সম্পূর্ন নিরাপদ করতে পারেনি। সুন্দরবনকে বন্যপ্রাণীদের জন্য নিরাপদ করা গেলে দ্রুত বাঘের সংখ্যা বাড়বে। আর বনবিভাগ বলছে, সুন্দরবনে বাঘ সংরক্ষনে সরকারী ভাবে প্রকল্প গ্রহন করা হয়েছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।
সুন্দরবন বিভাগের দেয়া তথ্য থেকে জানা যায়, স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালে রর্বাট হনড্রেকিসের জরিপে সুন্দরবনে বাঘ ছিলো ৩৫০টি এর পর ১৯৮২ সালে মার্গারেট স্যালটার জরিপে ৪২৫টি ও এর দুই বছর পর ১৯৮৪ সালে সুন্দরবন দক্ষিণ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের ১১০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় জরপি চালিয়ে ৪৩০ থেকে ৪৫০টি বাঘ থাকার কথা জানানো হয়।
১৯৯২ সালে ৩৫৯টি বাঘ থাকার তথ্য জানায় বন বভিাগ। পরের বছর ১৯৯৩ সালে সুন্দরবনরে ৩৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় প্যাগমার্ক পদ্ধতিতে জরিপ চালিয়ে ধন বাহাদুর তামাং ৩৬২টি বাঘ রয়েছে বলে জানায়। ২০০৪ সালে জরিপে বাঘরে সংখ্যা ছিলো ৪৪০টি। ১৯৯৬-৯৭ সালের জরিপে বাঘের সংখ্যা উল্লেখ করা হয় ৩৫০টি থেকে ৪০০টি।
ওই সময়ে বাঘের পায়ের ছাপ পদ্ধতিতে গণনা করা হয়। ২০১৫ সালের জরিপে সুন্দরবনের বাংলাদশে অংশে বাঘরে সংখ্যা আশংকাজনক হারে কমে দাড়ায় ১০৬ টিতে। হটাৎ করে সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা ৪০০ টি থেকে ১০৬ টিতে এসে দাড়ালে সারা বিশ্বে হৈজৈ পড়ে যায় ২০১৮ সালের সর্বশেষ বাঘ জরিপে সুন্দরবনে ১০৬ থেকে বেড়ে বর্তমানে বাঘের সংখ্যা দাড়িয়েছে ১১৪ টিতে।
সুন্দরবন বিভাগ সুত্রে আরো জানা গেছে, ২০০১ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৫০টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে স্বাভাবিক ভাবে মারা গেছে মাত্র ১০টি। ১৪ টি বাঘ পিটিয়ে মেরেছে স্থানীয় জনতা, একটি নিহত হয়েছে ২০০৭ সালের সুপার সাইক্লোন সিডরে ও বাকী ২৫ বাঘ হত্যা করেছে চোরা শিকারীরা। ২০১৯ সালের ২০ আগস্ট সুন্দরবনের পূর্ব বন বিভাগের ছাপরাখালি এলাকা থেকে একটি পূর্ণ বয়ষ্ক বাঘিনীর মৃতদেহ উদ্ধার করে। ময়না তদন্তের পর জানা যায়, বাঘটির স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে।
২০২০ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের কবরখালী খালের চর থেকে একটি কুমিরে খাওয়া বাঘের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। যার অর্ধেক অংশ কুমিরে খাওয়া ও বাকী অংশ পচা ছিল। ২০ বছর বয়সি বাঘটির বার্ধক্যজনিত কারনে মৃত্যু বলে জানা যায়। ২০২১ সালের ১৯ জানুয়ারী রাতে বাগেরহাটের শরণখোলা থেকে র্যাব ও বন বিভাগ যৌথ অভিযানে বাঘের চামড়াসহ আটক গাউস ফকিরকে (৫২) আটক করে।
পেশাদার চোরা শিকারী গাউস ফকির সুন্দরবন থেকে একটি রয়েল বেঙ্গল টাইগার হত্যা করে ৮ ফুট ১ ইঞ্চি লম্বা ও ৩ ফুট ১ ইঞ্চি চওড়া চামড়াটির ১৭ লাখ টাকা বিক্রির চেষ্টা করে। পরে ক্রেতা সেজে তাকে আটক করা হয়। এ বছরের ১৯ মার্চ পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের ওয়ার্ড হেরিটের সাইডের অভয়রণ্যের ধনচেবাড়িয়াচর এলাকার ভোলা নদীর চর থেকে ৭ ফুট দৈর্ঘের প্রাপ্তবয়স্ক একটি মৃত রয়েল বেঙ্গল টাইগার উদ্ধার করা হয়। ১৫ বছর বয়সী এই মাদী বাঘটি বার্ধক্যজনীত কারনে মৃত্যু হয়।
একই বছরের ১১ ডিসেম্বর বাগেরহাটের ফকিরহাটে বাঘের চামড়াসহ খুলনার ডুমুরিয়া কাঞ্চনপুর এলাকার মৃত কোরেশ মাহমুদের ছেলে মোঃ আজিজুর রহমান (৪৫) ও খুলনার সোনাডাঙ্গা থানার গ্রামীন আবাসিক এলাকার মোঃ জামাল খানের ছেলে মোঃ সাইদ খানকে (৩৫) আটক করে র্যাব। ফকিরহাট উপজেলার কাটাখালী বাজার এলাকায় সুন্দরবনের ঐতিহ্য রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চামড়া ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে এমন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে এই দুই পাচারকারীকে আটক করলেও বাকীরা পালিয়ে যায়।
২০২২ সালের ২৮ জানুয়ারি সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের দুবলারচর থেকে ৯ ফুট লম্বা একটি বাঘের মৃতদেহ উদ্ধার করে বনবিভাগ। পানি পান করতে খালে নেমে কাদায় আটকে বাঘটি মারা গেছে বলে ধারনা করা হয়। তবে আশার কথা হচ্ছে, কয়েক দফায় সুন্দরবন ভ্রমনে আসা পর্যটকরা বাঘের ভিডিও ধারণ করেছেন। আবার সুন্দরবন সংলগ্ন লোকালয়েও বাঘ চলে এসেছে। বনবিভাগের সদস্যরা সুন্দরবনের বিভিন্ন অংশে বাঘের উপস্থিতি টের পেয়েছেন।
এ বছরের ১২ মার্চ এমএল সুবতি নামের পর্যটকবাহী লঞ্চে ঢাকা থেকে সুন্দরবন ঘুরতে আসেন ৩০ জন পর্যটক পরিবারসহ বাঘের দেখা পান। সুন্দরবনের কটকা ও কচিখালির মধ্যবর্তী স্থানে এলে তারা দেখতে একসাথে ৫টি বাঘ নদীর চরে গোল গাছের পাশে বসে রয়েছে এবং খেলা করছে। ২০২০ সালের ৭ অক্টোবর একটি রয়েল বেঙ্গল টাইগার ভারাট হওয়া ভোলা নদী পার হয়ে বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার ধানসাগর ইউনিয়নের পশ্চিম রাজাপুর গ্রামে আসে।
২০২১ সালের ৯ জানুয়ারী রাতে সুন্দরবন থেকে একটি বাঘ বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার রায়েন্দা ইউনিয়নের দক্ষিণ রাজাপুর গ্রামে ঢুকে পড়ে। বাঘটি ওই গ্রামের প্রায় দেড় কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিচরণ শেষে আবার সুন্দরবনে ফিরে যায়। বাঘের পায়ের অসংখ্য ছাপ গ্রামের ফসলে মাঠ, মাছের ঘের, নদীর চরে নজরে আসে গ্রামবাসীর।
২০২২ সালের ৫ মে রাতে শরণখোলায় সুন্দরবনের একটি রয়েল বেঙ্গল টাইগার (বাঘ) হানা দেয়। সুন্দরবন থেকে দুই কিলোমিটার দূরে শরণখোলা উপজেলার খেজুরবাড়িয়া গ্রামের শাহিন খান নিজ ঘেরের মধ্যে বাঘটিকে শোয়া অবস্থায় দেখা যায়।
সুন্দরবন করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আজাদ কবির জানান, বাঘ একটি নিদৃষ্ট গন্ডির মধ্যে চলাচল করে। যখন বাঘটির বয়ষ হয়ে যায় তখন অন্য বাঘ এটিতে তাড়িয়ে দেয়। তখন সে অন্য দিকে চলে যায়। সেখান থেকেও তাকে তাড়িয়ে দিলে সে লোকালয়ে চলে আসতে পারে। তিনি সুন্দরবনের বিভিন্ন অংশে বনরক্ষীরা বাঘের উপস্থিতি টের পেয়েছে বলে জানান।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) বাগেরহাট জেলা কমিটির আহবায়ক নুর আলম বলেন, ২০ বছর আগে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল ৪৪০টি। এখন আছে মাত্র ১১৪টি। সেখান থেকেও কয়েকটি মারা গেছে। সুন্দরবনে বিষ দিয়ে মাছ শিকার, চোরা শিকারীদের দৌরাত্ত, বাঘের আবাসস্থল সুন্দরবন নিরাপদ না হওয়াসহ বিভিন্ন কারনে বাঘের সংখ্যা কমেছে। সুন্দরবানের পাশে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, শিল্পকারখানাসহ সুন্দরবন বিধ্বংসি সকল কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে।
বাগেরহাট সরকারী পিসি কলেজের প্রাণী বিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ড. শিউলী রাণী সুত্রধর বলেন, সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা বাড়ানো জন্য চোরা শিকারি দমন, বাঘের আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত করা দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। একই সাথে সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল মধু সংগ্রহকারী, গোলপাতা সংগ্রহকারী, মাছ শিকারীরা অবাধে সুন্দরবনের গহিনে প্রবেশ করছে।
এর ফলে বাঘের সাথে মানুষের সংঘর্ষ বেড়ে যাচ্ছে। বাঘের শান্তিময় পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে। এসব মানুষের জন্য বিকল্প পেশার ব্যবস্থা করছে। শুধুমাত্র বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির কারনে বাঘ লোকালয়ে আসে না। খাদ্য সংকট, সুন্দরবনে অনেক বেশি ঘন গাছ, বনের কোন কোন অংশ ফাকা হয়ে যাওয়া, বয়ষ বৃদ্ধির কারনে খাদ্য শিকারে সমস্যার ও প্রজনন কালীন সময়েও বাঘ লোকালয়ে চলে আসতে পারে।
সুন্দরবন পুর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোঃ বেলায়েত হোসেন বলেন, বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধিতে 'সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প' নামের একটি প্রকল্প গ্রহন করা হয়েছে। এর আওতায় সুন্দরবনে ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে বাঘ গণনা, বয়স ও লিঙ্গ অনুপাতে সুন্দরবনের কম বাঘ সম্পন্ন এলাকায় বাঘ স্থানান্তর, বাঘের শরীরে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার স্থাপন ও মনিটরিং করা, বাঘের পরজীবীর সংক্রমণ ও অন্যান্য ব্যাধি নির্ণয় ও সুন্দরবনের লোকালয় সংলগ্ন এলাকায় নাইলনের রশির বেষ্টনী তৈরি করা হবে।
তিনি বলেন, বাঘ এবং তার শিকার প্রাণী যাতে নিরাপদে থাকতে পারে এজন্য অভয়ারণ্য বৃদ্ধি করে সুন্দরবনের ৫২ ভাগ এখন অভয়ারন্য করা হয়েছে। লোকালেয়ে আসা বাঘ নিরাপদে বনে ফেরাতেও ব্যপক জন সচেতনতা তৈরি করা হয়েছে। ইতিমধ্যে এর সুফলও পাওয়া গেছে। এখন বাঘসহ বন্য প্রাণী লোকালয়ে এলে স্থানীয়রা বন বিভাগকে অবহিত করে। ২০২২ সালের শেষের দিকে শুরু হচ্ছে পুন:রায় বাঘ গণনা। এই জরিপে বাঘের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাবে এমনটাই মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এএজেড