প্রতিশোধ নিতে হামলার পরিকল্পনায় উল্টো নিহত হন পনু
একই এলাকার বাসিন্দা, সম্পর্কে তারা মামা-ভাগ্নে। একজন স্থানীয় ইউপি সদস্য, অপরজন সংগঠক। তবে এলাকায় প্রভাব বিস্তার নিয়ে প্রায় ৫ বছর ধরে উভয়ের মধ্যে চলছিল দ্বন্দ্ব। একাধিকবার হামলা, পাল্টা হামলা ও মামলার ঘটনাও ঘটেছে। গত এক মাস ধরে একে-অপরের প্রতি হামলার প্রস্ততি চলছিল অনেকটা প্রকাশ্যেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ছবিও ছড়িয়েছে। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার সংঘর্ষ বাস্তবতার রুপ নেয়। এতে সাবেক ইউপি সদস্য শফিকুল ইসলাম পনু নিহত এবং উভয়পক্ষের অন্তত ১০ জন গুরুতর জখম হন।
নিহত পনুর বাড়ি বরগুনা সদরের আয়লা পাতাকাটা ইউনিয়নের পাকুরগাছিয়ায়। তিনি মৃত মোসলেম আলী আকনের ছেলে।
সরেজমিনে, প্রত্যক্ষদর্শী ও এলাকার একাধিক বাসিন্দাদের তথ্যমতে, বরগুনা সদরের আয়লা পাতাকাটা ইউনিয়নের তিন নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা শফিকুল ইসলাম পনু ও একই এলাকার পাকুরগাছিয়া সোস্যাল ডেভলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন নামের একটি ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা আকাইদ হোসেন ঠান্ডার মধ্যে গত ৫ বছর ধরে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দ্বন্দ্ব চলে আসছে। ঠান্ডা নিহত পনুর মায়ের সম্পর্কে ভাই। সেই হিসেবে পনু ও ঠান্ডা সম্পর্কে মামা-ভাগ্নে।
স্থানীয়দের তথ্যমতে, ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে শফিকুল ইসলাম পনুকে আয়লা বাজারে জনসম্মুখে কুপিয়ে রক্তাক্ত জখম করে ঠান্ডা বাহিনী। এরপর ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে ইউপি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে ফের পনুকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে আহত করে তারা। দুটি ঘটনায় দায়ের করা মামলায় আসামি হন আকাইদ হোসেন ঠান্ডা, কুদ্দুস খান ও বর্তমান ইউপি সদস্য মোতাহার মৃধা। ২১ জুন নির্বাচনে ঠান্ডার প্যানেলের সমর্থিত ইউপি সদস্য প্রার্থী মোতাহার মৃধা নির্বাচিত হন।
বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্রের তথ্যমতে, বাবার ওপর বারবার হামলার ঘটনায় ক্ষুদ্ধ ছেলে নাজমুল হুদা অভি প্রতিপক্ষের উপর প্রতিশোধ নিতে পাল্টা হামলার পরিকল্পনা করেন। গত এক মাস ধরে বাবা পনু ও ছেলে অভি সময়-সুযোগ বুঝে ঠান্ডা বাহিনীর উপর আক্রমণের প্রস্তুতি নেয় এবং গত ১০ এপ্রিল পনু ও তার ছেলে অভি ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে এলাকায় প্রবেশ করে ঠান্ডা বাহিনীর উপর হামলার প্রস্ততি নিলেও এলাকাবাসীর ধাওয়ায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এ সময় নিহত পনুর রামদা হাতে একটি ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এ নিয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে ক্রমশ উত্তাপ ছড়াতে থাকে।
সর্বশেষ গত মঙ্গলবার পনুর ছেলে অভি সন্ত্রাসীদের ভাড়া করে ঠান্ডা বাহিনীর উপর হামলার প্রস্ততি নেয়। অভি তার ফেসবুক প্রফাইলের স্টোরিতে দেশীয় অস্ত্রসহ ৩৭ সেকেন্ডের একটি ভিডিও পোস্ট করে। যার ক্যাপশনে লেখা ছিল 'বুঝো নাই'। মল্লিক নামের একজন এতে মন্তব্য করেন 'এগুলা সোশ্যাল মিডিয়াতে দিলি'।
পাকুরগাছিয়ার ঘটনাস্থলের পাশেই চায়ের দোকানদার শিউলী বেগম বলেন, ‘মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে একটি সাদা রঙের মাইক্রোবাসে করে ১৩ জন মুখোশধারী ব্যক্তি ঠান্ডার ক্লাবের (পাকুরগাছিয়া সোস্যাল ডেভলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন) সামনে আসে। এ সময় আকাইদ হোসেন ঠান্ডা ক্লাবের ভেতরে বসে দুইজন ব্যক্তির সাথে কথা বলছিলেন। অপরদিকে মুখোশধারীরা গাড়িটি ক্লাবের দরজার সামনে থামিয়ে ৭-৮ জন ভেতরে প্রবেশ করে দরজা আটকে তাকে এলোপাতারি কুপিয়ে জখম করে ফেলে রেখে চলে যায়। একই সময় বাইরে থাকা মুখোশধারীরা ঠান্ডার চাচাতো ভাই হাসিব ও মজিবরকেও কুপিয়ে জখম করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ সময় তাদের চিৎকারে এলাকায় খবর ছড়িয়ে পড়ে ঠান্ডাকে খুন করা হয়েছে। খবর শুনে ঠান্ডার সমর্থক, স্বজন ও এলাকাবাসী সবাই এগিয়ে আসে। এক পর্যায়ে বর্তমান ইউপি সদস্য মোতাহার মৃধা ও কুদ্দুস খান নামের একজনের নেতৃত্বে অর্ধশতাধিক মানুষ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে পনুর বাড়িতে যায়। এ সময় তারা পনুকে বাড়ি থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে এলোপাথাড়ি কুপিয়ে জখম করে। স্বামীকে বাঁচাতে এগিয়ে এলে পনুর স্ত্রী ছবিকেও পিটিয়ে আহত করে। এ ছাড়াও একই সময়ে পনুর বাড়িতে থাকা একই ইউনিয়নের কদমতলার কবির মিয়ার ছেলে জাহিদ ও ঢলুয়া ইউনিয়নের হোসেন হাওলাদারের ছেলে সজিব হোসেনকেও কুপিয়ে জখম করে।’
নিহত শফিকুল ইসলাম পনুর স্ত্রী ছবি আক্তার বলেন, ‘মোতাহার মৃধা, কুদ্দুস ও ঠান্ডা বাহিনীর ২০-২৫ জন সন্ত্রসী রামদা, ছেনা, টেঁটা, চল নিয়ে আমাদের বাড়িতে ঢুকে পনু আকনকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে। সন্ত্রাসীরা আমার স্বামী পনু আকনকে কমপক্ষে ৫০টি কোপ দেয়। আমাকে ও আমার ছেলেকে পিটিয়ে জখম করে। আমি আমার স্বামীর হত্যার বিচার চাই।’
অপরদিকে আহত ঠান্ডার মামা মশিউর রহমান বলেন, ‘পূর্বপরিকল্পিতভাবে পনু ও তার ছেলে আমার ভাগ্নে ঠান্ডাকে হত্যার উদ্দেশে হামলা করে নির্মমভাবে কুপিয়ে জখম করে। আমি ভাগ্নেকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য বরিশাল এসেছি। আমাদের পক্ষের তিনজনের অবস্থা গুরুতর। পরে সেখানে কি ঘটেছে আমি জানি না।’
ফেসবুক স্টোরিতে অস্ত্রের ছবি পোস্ট দেয়ার বিষয়ে নিহত পনুর ছেলের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তার মুঠোফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে বরগুনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলী আহম্মেদ বলেন, 'এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য দশজনকে থানায় ডেকে আনা হয়েছে। তবে কাউকে আটক করা হয়নি।'
এ ব্যাপারে বরগুনার পুলিশ সুপার মো. আবদুস ছালাম বলেন, ‘খবর পেয়ে পুলিশের বেশ কয়েকটি টিম ঘটনাস্থলে যায় এবং আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়। আমি নিজেও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি, স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেছি। এ ঘটনায় জড়িতদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনতে আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে।’
এসআইএইচ