বৃষ্টিতে তরমুজের পচন, লোকসান নিয়ে বাড়ি ফিরছেন চাষিরা
পটুয়াখালীর গলাচিপার তরমুজ চাষি জলিল আকন ট্রলারে করে সাড়ে ৭ হাজার তরমুজ নিয়ে এসেছেন বরিশাল পোর্ট রোডের বালুর ঘাটে (বর্তমানে তরমুজের আরত)। তবে মন খারপ করে বসে আছেন ট্রলারের এক পাশে। এ সময় কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ক্ষেতের সব তরমুজ বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে। পটুয়াখালীর গলাচিপা দিয়া তরমুজ নিয়ে বরিশাল আইজ তিন-চার দিন হইছে আইসি। ক্ষেত দিয়া সব তরমুজ কাইট্টা নিয়া আইসি। দুই কানি জমিতে তরমুজ চাষ করছি। যাতে খরচ হয়েছে আড়াই লাখ টাকা। আর বরিশালে আসার পথেও অর্ধেক তরমুজ নষ্ট হইছে। যা বিক্রি করছি হেয়ার মধ্যে লেবারের টাকা, গাড়ির টাকা, ট্রলারের টাকা দিয়া ঘরে ১০টা টাকা নিয়াও উঠতে পারমু না। বাড়িতে এখন না খালি পকেটে যাওয়ার অবস্থা। এবার তরমুজ ফলন ভালো হয়েছে। কিন্তু মাঠেও টাকা নাই আর আমরা বেচতেও পারি না। সব ফেলায় দেওয়া লাগতেছে।’
বরিশালের তরমুজের পাইকারী আড়ত পোর্ট রোড বালুর ঘাটে সরেজমিনে দেখা যায়, বরিশালের বিভিন্ন স্থান থেকে তরমুজের শত শত ট্রলার ঘাটের চারপাশে খালের মধ্যে নোঙর করা আছে। সিরিয়াল অনুযায়ী এসব ট্রলারগুলো থেকে পণ্য নামাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন ঘাট শ্রমিক ও চাষিরা। অন্যদিকে আরতদার ও চাষিদের মধ্যে চলছে দাম-দর। কেউ কেউ হিসেব নিয়ে ব্যস্ত। তবে ঘাট ঘুরে ঘুরে দেখা যায়, খালের মধ্যে নোঙর করা ট্রলার থেকে হাজার-হাজার পঁচা তরমুজ খালের মধ্যে ফেলছেন চাষি ও শ্রমিকরা। এতে পুরো খাল ভরে গেছে পঁচা তরমুজে।
জানা গেছে, বরিশালের ভোলার চরফ্যাশন, চর কাজল, চর বিশ্বাস, লাহারাহাট, পটুয়াখালীর গলাচিপা, আমতলী, কালাইয়া, কালেসসরী, চন্দ্রদ্বীপ, বাঘমারা, বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ থেকে তরমুজ আসে। পরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ট্রাকে ভরে পাঠানো হয়।
তরমুজ চাষী মোহাম্মদ কোবির খান বলেন, ‘ট্রলারে যত মাল নিয়ে আইছি হেয়ার মধ্যে তিন ভাগের দুই ভাগই নষ্ট হয়ে গেছে। বাকি এক ভাগ এখন কূলে উঠাইতেছি। তরমুজ সিজনের এখন এক মাস চলে। এর মধ্যে ২০ দিনই এই বৃষ্টি আর জোয়ারের পানি। বাকি ১০ দিনে যা পাইছি,ক্ষেতে সব কাইটা ফেলছি।
গলাচিপার চর বিশ্বাস এলাকার তরমুজ চাষী রিপন বয়াতি বলেন, ‘বরিশাল ঘাটে আসছি আজ পাঁচ দিন। আমরা আড়াই কানি জমির মধ্যে তরমুজ চাষ করছি। বরিশালে ৫৫০ পিস তরমুজ নিয়া বরিশালে আসছি। কিন্তু ঝড়-বৃষ্টিতে সব তলায় যাওয়ার কারণে এখন পথে অনাতে আনতেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সাড়ে পাঁচশোর মধ্যে এখন পর্যন্ত ৪৩০ পিস তরমুজ বিক্রি করতে পারছি। তাও কম দামে। এখন এই টলার ভাড়া এবং আড়তে টাকা দিয়ে বাড়িতে টাকা নিয়ে যাওয়া মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। পকেট খালি নিয়েই বাড়ি ফিরতে হবে। আমাগো এখন দুর্যোগ চলে। এত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে যা বলে শেষ করা যাবে না। ক্ষেতে ফলন ভালো হলে কি হবে বৃষ্টিতে সবকিছু শেষ হয়ে গেছে।’
অন্য এক চাষী মোহাম্মদ ইমরান বলেন, ‘বৃষ্টি হইলে তরমুজ নষ্ট হয়। আর বৃষ্টি না হইলে তরমুজ মিষ্টি হয় না। মানুষ এখন বড় যন্ত্রণায় আছে। বর্তমানে ক্ষেতে যার তরমুজ আছে তারও অধিকাংশ পচা। রমজানের শুরু থেকেই বাজারে তরমুজ পঁচা আসতে আছে। তবে রমজানের আগে কিছুটা ভালো ছিল।’
এ বিষয়ে আড়তদার মো. হারুন বলেন, ‘একদিকে নদীর পানি। আরেকদিকে বৃষ্টি। যার কারণে এখন তরমুজ চাষীদের অকাল চলছে। বাজারে কি বিক্রি করবে, খরচ কেমনে উঠাবে? সেই চিন্তায় ব্যবসায়ীগো মাথা খারাপ। মাল (তরমুজ) টলারে এবং গাড়িতে তুলে বরিশাল ঘাটে আনতে আনতে তার অর্ধেকের বেশি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এগুলি অতিরিক্ত বৃষ্টি এবং পানির কারণে হচ্ছে। এখন টলার ঘাটে তরমুজ বিক্রির জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে চাষিরা। যার কারণে তারা ইফতার করারও সময়টুকু পায় না। কারণ যত বেশি ঘাটে তরমুজ রাখবে তত বেশি তরমুজ নষ্ট হবে।’
পোর্ট রোড বালুরঘাটের তরমুজ ব্যবসায়ী আড়তদার শাহাবুদ্দিন বলেন, ‘অধিকাংশ তরমুজ চাষীরা নদীর পাশে চরে চাষ করেন। ফলে জোয়ারের পানিটা ক্ষেতে ওঠে। এ ছাড়াও উপর থেকে বৃষ্টি পড়ে অন্যদিকে অতিরিক্ত গরম। যার কারণে এই তরমুজ নষ্ট হচ্ছে। এর বেশির ভাগ ক্ষতি হয় অমাবস্যা অথবা পূর্ণিমায় হঠাৎ করে ক্ষেতে পানি ওঠে তলিয়ে যায় যা থামানোর মতো কোনো উপায় থাকে না। এই তরমুজটা নষ্ট হওয়ার কারণে চাষিরা সঠিক দামটাও পায় না।’
অন্যদিকে ঘাটের দুর্ভোগের কথা জানিয়ে এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘এই খালটির খনন কাজ না হওয়ার কারণে সব ট্রলারগুলো একত্রে ঘাটে ভিড়তে পারে না। এই কারণে সিরিয়াল নিয়ে ঘাটে ভিড়তে হয়। অনেক চাষীদের দুই থেকে তিন-চার দিনও ট্রলার দূরে ভিড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয়। এ জন্য রোদ আর অতিরিক্ত গরমের কারণে তরমুজ নষ্ট হচ্ছে। এই খালটি খননের দাবি জানাই। খনন হলে কিছুটা চাষীদের দুর্ভোগ কমবে। বরিশাল পোর্ট রোড এবং লঞ্চঘাটের আওতাভুক্ত যারা ভুক্তভোগী তাদের এই সমস্যাটা বেশি দেখা দিচ্ছে। যেখানে একটি তরমুজের ট্রলার খালি করতে সময় লাগে এক থেকে দেড় ঘণ্টা কিন্তু সেখানে ট্রলার ঢুকতেই সময় লাগে তিন থেকে চার দিন। ফলে ওই তরমুজের সঠিক দামটাও চাষিরা পায় না। ওই তরমুজের বাজার দর যদি থাকে ১০ থেকে ৯ হাজার টাকা সেখানে তারা তিন-চার দিন পরে পায় তিন থেকে চার হাজার টাকা। তাহলে চাষিরা দাম পাবে কিভাবে?’
আড়তদার ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘খালে পানি নাই। ট্রলার ভিড়তে পারে না। ঠিকমতো প্লেস পায় না। যার জন্য এখন চাষিরা লাখ লাখ টাকার ক্ষতি হচ্ছে। আমরা ঘাট কর্তৃপক্ষের কাছে বলেছি এখানে ব্যবসা করতে হলে খালটিকে দ্রুত খনন করতে হবে। তা না হলে ব্যবসা করা সম্ভব হবে না। কারণ কোনো ট্রলার এখন ভিড়তে পারছে না ঘাটে।’
বরকত ফল ভান্ডারের স্বত্বাধিকারী বরকতুল্লাহ বলেন, ‘বৃষ্টির কারণ এবং পানির কারণে পঁচা তরমুজ বাজারে আসছে। তরমুজ এমনভাবে পচা শুরু করেছে, ভয়ে চাষিরা তাদের ক্ষেতে যা পেয়েছে তাই কেটে বাজারে নিয়ে আসছে। তাও পথে পথে অনেক তরমুজ পঁচে যাচ্ছে। যার কারণে এখন অর্ধেক তরমুজ ঘাটে এসে পৌঁছায় না। এমন অবস্থায় পৌঁছেছে। যেমন ৫০০ টাকার তরমুজে এখন কৃষক পাচ্ছে মাত্র ৫০ টাকা। এছাড়া আড়তদারাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’
মেসার্স বিসমিল্লাহ ফ্রটসের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ আবুল কালাম বলেন, ‘বর্তমানে তরমুজের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। কারণ বর্ষার জন্য তরমুজ ক্ষেত তলিয়ে গেছে। গাছ মরে যাচ্ছে। এজন্য চাষিদের পাশাপাশি আড়তদারেও ক্ষতি হচ্ছে। আমাদের মধ্যে অনেকে আছে দাধন দিয়েছি। যেখানে ৫ লাখ টাকার মাল আসার কথা সেখানে মাল নামতেছে ৫০ হাজার টাকার। তাতে চাষীও শেষ এবং দাদন দেওয়া আড়তদারাও শেষ। দিন শেষে আমরাই খারাপ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।’
এ ব্যাপারে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামার বাড়ি পটুয়াখালীর অতিরিক্ত পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, ‘এই বছর বৃষ্টির কারণে পটুয়াখালী অঞ্চলে ১২০০ হেক্টর জমির তরমুজ চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে এই বৃষ্টি চলতি মাসের শেষ বা মাঝামাঝি সময়ে হলে চাষিরা বেশি ক্ষতি হতো না।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বরিশাল আঞ্চলিক কার্যালয়ের উদ্যান বিশেষজ্ঞ জিএমএম কবীর খান জানান, কয়েক দিনের বৃষ্টিতে তরমুজ ক্ষেতে পানি জমে গেছে। এ ছাড়াও কোথাও কোথাও শিলা বৃষ্টির কারণে তরমুজে পচন ধরে। তবে বরিশাল বিভাগে তরমুজে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কত সেটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তাদের কর্মকর্তারা মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন। পানি নেমে যাওয়ার পর ওইসব ক্ষেতে ওষুধ ছেটানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
বরিশাল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের খামার বাড়ির তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে বরিশাল জেলায় তরমুজ চাষে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭০০ হেক্টর জমিতে। তবে আবাদ হয়েছে ১০৪৬ হেক্টর জমিতে।
এসআইএইচ