ট্রান্সজেন্ডার ও হিজড়াদের নিয়ে কী বলে ইসলাম?
ছবি সংগৃহিত
বর্তমানে বিভিন্ন মাধ্যমে ‘ট্রান্সজেন্ডার’ নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। ট্রান্সজেন্ডার ইস্যু সময়ের অন্যতম চর্চিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকে মনে করছে ট্রান্সজেন্ডার আর তৃতীয় লিঙ্গ একই। এ বিষয়ে কথা হয় ইসলামিক স্কলার, লেখক, গবেষকদের সাথে। সম্প্রতি সপ্তম শ্রেণীর ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বই থেকে শরীফ ও শরীফার গল্প নিয়ে তৈরী হয়েছে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা।
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির খণ্ডকালীন শিক্ষক আসিফ মাহতাব উৎস কয়েক দিন আগে একটি সেমিনারে সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক থেকে ‘শরিফ ও শরিফা’র গল্পাংশ ছিঁড়ে ফেলেন। এই ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর তার পক্ষে-বিপক্ষে দেশে নেটিজেনদের দুটি ভাগ হয়ে যায়। একপক্ষ আসিফের পক্ষ নেন, অপর পক্ষ তার বিপক্ষে অবস্থান নেন। অনেকে আবার দুই ভাগের মাঝে সমাধানের পথ খোঁজার চেষ্টা করছেন। সমকালীন এ ইস্যুকে কেন্দ্র করে নয়, আমাদের মূলত সঠিকভাবে বিষয়টি জানা অত্যন্ত আবশ্যক। ইস্যু দুদিন পর এমনিতেই শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু এ বিষয়ে ইসলামের কী শিক্ষা সেটি আমাদের একজন মুসলিম হিসেবে জানা জরুরি। জেন্ডার সম্পর্কে ইসলাম কী বলে? কুরআন-হাদিসে কি ট্রান্সজেন্ডার ও হিজড়া সম্পর্কে কিছু আলোচনা আছে? কুরআন-হাদিস ও বাস্তবতার আলোকে ইসলাম এ বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত দেয় তা আমাদের বুঝতে হবে।
ইসলাম এক সামগ্রিক ধর্ম। এর অর্থ প্রতিটি বিষয়ে ইসলামের সুস্পষ্ট বিধান আছে। হয়তো কুরআনে থাকবে, নয়তো হাদিসে, অথবা কুরআন-হাদিসের মূলনীতির আলোকে বাস্তবতার নিরিখে সেটির সমাধান বের করতে হবে। এটিকেই ফিকহ বলা হয়। বিজ্ঞানে যেটা প্রতিষ্ঠিত সত্য সেটিকে কুরআন-হাদিসের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো যায় না। কারণ, কুরআন-হাদিস ও বিজ্ঞান একটি আরেকটির প্রতিপক্ষ নয়। বরং একটি আরেকটির সহায়ক। আল কুরআনে বিবেক বুদ্ধি ও কমনসেন্স ব্যবহার করতে বারবার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ‘তারা কি বোঝে না? তারা কি চিন্তাভাবনা করে না? এতে নিদর্শন আছে বুদ্ধিমানদের জন্য, আকলমন্দদের জন্য, যাদের ভেতর বিবেক আছে তাদের জন্য এতে এভিডেন্স আছে, উলুল আলবাব, উলুন নুহা, আফালা ইয়াকিলুন, তারা কি ভাবে না? পরিণাম সম্পর্কে চিন্তা করে না? হে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন লোকেরা, উপদেশ গ্রহণ কর।’ ইত্যাদি বিভিন্নভাবে অসংখ্য আয়াতে আল কুরআনে বুদ্ধি ও মেধা ব্যবহার করতে উৎসাহিত করা হয়েছে। বুদ্ধির ব্যবহার থেকেই বিজ্ঞান। পবিত্র কুরআনই পৃথিবীতে বিজ্ঞানের দরজা উন্মুক্ত করেছে। এখন আসি জেন্ডার বিষয়ে। নারী ও পুরুষ এই দুটিতেই কি সীমাবদ্ধ? থার্ড জেন্ডার বা ট্রান্সজেন্ডার সম্পর্কে ইসলামের অবস্থান কী?
প্রথমেই আমরা পবিত্র কুরআন খুলে দেখি। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, আর এই যে, তিনিই সৃষ্টি করেন যুগল পুরুষ ও নারী, শুক্রবিন্দু হতে, যখন তা স্খলিত হয়। [সুরা নাজম, আয়াত: ৪৬, ৪৭]
তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়াদের জন্মগত কিছু শারীরিক পরিবর্তনের জন্যে হয়ে থাকে, যা আল্লাহ প্রদত্ত। আর ট্রান্সজেন্ডার মানে হচ্ছে রূপান্তরিত লিঙ্গ। অর্থাৎ জন্মের সময় আল্লাহ তাকে ছেলে বা মেয়ে বানিয়েছেন, কিন্তু সে নিজে থেকে সেটার পরিবর্তন করছে। সেটা মানসিক বা শারীরিক যেকোনটাই হতে পারে।
অর্থাৎ ট্রান্সজেন্ডার বলতে আল্লাহর যে সর্বোত্তম সৃষ্টি করেছেন সেটার উপর নিজে থেকে কিছু পরিবর্তন করা, অনেকটা খোদার উপর খোদাগিরি করা।
আল্লাহর রাসূল (সা.) হাদিসে লিঙ্গ পরিবর্তন তো অনেক দূরে, বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গে সাদৃশ্য অবিলম্বন করাকেও লানত জানিয়েছেন। হজরত ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নারীর সাদৃশ্য গ্রহণকারী পুরুষ এবং পুরুষের সাদৃশ্য গ্রহণকারিণী নারীদের ওপর অভিশাপ দিয়েছেন এবং বলেছেন, ‘তাদেরকে তোমাদের ঘর থেকে বের করে দাও।’ (বুখারি, দারেমি, আবু দাউদ, ইবনু মাজাহ)
হজরত আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু আরও বর্ণনা করেছেন, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহর লানত সে পুরুষদের ওপর যারা নারী সাদৃশ্য ধারণ করে এবং সে সব নারীদের ওপর যারা পুরুষ সাদৃশ্য ধারণ করে।’ (বুখারি, মিশকাত)
তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়াদের নিয়ে হাদিসে আছে, আহলে বাইতে রাসূল (সা.) স্ত্রীদের ইন্যে অবস্থান করার সময় সেখানে একজন তৃতীয় লিঙ্গের লোক এসেছিলেন। এ সময় তারা নারী ভেবে সেভাবে পর্দা করেননি। তৃতীয় লিঙ্গের লোকটি বের হয়ে যাবার পরে রাসূল (সা.) স্ত্রীদের উদ্দেশ্যে বলেন, তারা যখন পরবর্তীতে আসবে পর্দা করবে। স্ত্রীরা বলেন, তারা তো হিজড়া। তখন রাসূল (সা.) বলেন, হিজড়া বলতে কিছু নাই। হয় সে নারী নয়তো পুরুষ। যে পুরুষ হয়তো তার সঙ্গে নারীর কিছু সাদৃশ্য বা বৈশিষ্ট আছে, অথবা যে নারী তার সঙ্গে পুরুষের কিছু সাদৃশ্য বা বৈশিষ্ট আছে। অর্থাৎ মিশ্র লিঙ্গ বলা যেতে পারে।
ট্রান্সজেন্ডার সম্পর্কেও বিস্তর গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। যেটা ইসলামবিরুদ্ধ সেটা তো মুসলিম হিসেবে আমরা মেনে নিতে পারি না। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে যেসব ছেলে-মেয়ে রূপান্তরকামী বা এক জেন্ডার হয়ে অন্য জেন্ডারের হরমোন বয়ে বেড়াচ্ছে বা মানসিকভাবে নিজেদেরকে ভিন্ন জেন্ডার মনে করছে তাদের সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা রাষ্ট্র ও সমাজের দায়িত্ব। এ বিষয়টিকেও নিষিদ্ধ গন্দম না বানিয়ে এ সম্পর্কে খোলামেলা আলোচনা হওয়া জরুরি। আলোচনা পর্যালোচনার মাধ্যমে অনেক নতুন নতুন বিষয় আমাদের সামনে আসবে। কুরআন-হাদিসের দিকনির্দেশনা সম্পর্কেও আমরা সম্যক অবহিত হতে পারব। উত্তেজনা না ছড়িয়ে মূল বিষয়ের সঠিক জ্ঞান আহরণই আমাদের জন্য কল্যাণকর হবে। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা আমাদের তাওফিক দিন। আমিন।