পাপকে তুচ্ছ মনে করার ভয়াবহতা !
ছবি: সংগৃহীত
সয়তানের ধোকায় আল্লাহর বিধানের বিপরীতে যে কোন কাজ করাই পাপ। এ পাপকে অবহেলা করা বা কোনো কিছু মনে না করা কিংবা সাধারণ বিষয় মনে করা গুনাহের কাজ। হোক সেটা অতি তুচ্ছ। তাই পাপের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। অনেকেই আছেন, যারা পাপকে তুচ্ছ মনে করে। পাপ বা গুনাহকে তুচ্ছ মনে করা যাবে কি?
কেরামান কাতেবিন (সম্মানিত দুই লেখক) আমাদের কারো গুনাহ লেখার আগে আল্লাহ আমাদের তওবার ব্যাপারে অনেক সুযোগ দিয়েছেন। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, নিশ্চয়ই ভুলকারী মুসলিম বান্দার জন্য বামপাশের ফেরেশতা ছয় ঘন্টা পর্যন্ত কলম উঠিয়ে রাখে। বান্দা যদি অনুতপ্ত হয় এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায় তাহলে তা মাফ করে দেওয়া হয়, নতুবা একটি গুনাহ লেখা হয়। (তাবারানি, বায়হাকি)
বর্তমান সময়ে মানুষ আল্লাহকে ভয় করে না, রাতদিন বিভিন্ন গুনাহ করে চলেছে। এদের কেউ কেউ আবার গুনাহ কিছুই মনে করে না। তাদের কাছে গুনাহ একেবারেই তুচ্ছ। কেউ কেউ ছোট গুনাহকে খুবই তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখে থাকে। যেমন বলে থাকে, একবার খারাপ কিছু দেখলে কিংবা কোন বেগানা নারীর সঙ্গে করমর্দন করলে ক্ষতি কী?
আবার অনেকেই আগ্রহ ভরে হারাম জিনিসের দিকে নজর দেয়। পত্র-পত্রিকায় বা টিভি সিরিয়াল বা সিনেমার দিকে; এমনকি এদের কেউ কেউ যখন জানতে পারে যে এটি হারাম, তখন খুবই রসিকতা করে প্রশ্ন করে, এতে কত গুনাহ রয়েছে? এটি কি কবিরা গুনাহ নাকি সগিরা গুনাহ? অথচ এ কথাগুলো কত মারাত্মক। যা তুলনাই করা যায় না। ইমাম বুখারি রাহমাতুল্লাহি আলাইহির এই হাদিস দুটি পড়ুন-
১. হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, ‘তোমরা এমন সব কাজ কর যা তোমাদের দৃষ্টিতে চুলের চেয়েও সূক্ষ্ম। কিন্তু আমরা রাসুলুল্লাহর যুগে এগুলোকে মনে করতাম ধ্বংসকারী।’
২. হজরত ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, একজন মুমিন গুনাহকে এভাবে দেখে থাকে যে, সে যেন এক পাহাড়ের নিচে বসে আছে যা তার মাথার উপর ভেঙ্গে পড়বে। পক্ষান্তরে পাপী তার গুনাহকে দেখে যেন মাছি তার নাকের ডগায় বসেছে, তাকে এভাবে তাড়িয়ে দেয়।
গুনাহের বিষয়টি কত বিপজ্জনক, তা নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ হাদিস থেকে প্রমাণিত। তাহলো- ‘তোমরা নগণ্য ছোট ছোট গুনাহ থেকে সাবধান হও! নগণ্য ছোট ছোট গুনাহগুলোর উদাহরণ হল ঐ লোকদের মতো যারা কোন মাঠে বা প্রান্তরে গিয়ে অবস্থান করল এবং তাদের প্রত্যেকেই কিছু কিছু করে লাকড়ি (জ্বালানি কাঠ) সংগ্রহ করে নিয়ে এলো। শেষ পর্যন্ত এতটা লাকড়ি তারা সংগ্রহ করলো যা দিয়ে তাদের খাবার পাকানো হল। নিশ্চয় নগণ্য ছোট ছোট গুনাহতে লিপ্ত থাকা ব্যক্তিদের যখন সেই নগণ্য ছোট ছোট গুনাহগুলো গ্রাস করবে (পাকড়াও করবে) তখন তাদেরকে ধ্বংস করে ফেলবে।’
অন্য এক বর্ণনায় এসেছে যে, ‘তোমরা নগণ্য ছোট ছোট গুনাহ থেকে সাবধান হও; কেননা সেগুলো মানুষের কাঁধে জমা হতে থাকে এরপর তাকে ধ্বংস করে দেয়।’ (মুসনাদে আহমাদ, জামে)
এ কারণেই ইসলামিক স্কলারগণ বলেছেন, যখন সগিরা গুনাহর সঙ্গে লজ্জাশরম কমে যাবে, কোনো কিছুতে ভ্রূক্ষেপ করবে না, আল্লাহর ভয় থাকবে না এবং আল্লাহর ব্যাপারে ভক্তি হবে না তখন একে কবিরা গুনাহতে পরিণত করবে।
এজন্যই বলা হয়েছে যে, ক্রমাগত পাপ করলে তা আর সগিরা থাকে না এবং ক্ষমা প্রার্থনা করলে কবিরা থাকে না। অর্থাৎ ক্রমাগতভাবে সগিরা গুনাহ করতে থাকলে তা কবিরা গুনাহে পরিণত হয় এবং ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকলে কবিরা গুনাহ আর থাকে না তা মাফ হয়ে যায়।
পাপের রয়েছে ভয়াবহ শাস্তি ও কঠিন পরিণতি। সে কারণে পাপ বা গুনাহের কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা জরুরি। আল্লাহ তাআলা ঈমানদারকে এভাবে সতর্ক করে পাপ থেকে বেঁচে থাকতে ঘোষণা করেন-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا تُوۡبُوۡۤا اِلَی اللّٰهِ تَوۡبَۃً نَّصُوۡحًا ؕ عَسٰی رَبُّکُمۡ اَنۡ یُّکَفِّرَ عَنۡکُمۡ سَیِّاٰتِکُمۡ وَ یُدۡخِلَکُمۡ جَنّٰتٍ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِهَا الۡاَنۡهٰرُ ۙ یَوۡمَ لَا یُخۡزِی اللّٰهُ النَّبِیَّ وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا مَعَهٗ ۚ نُوۡرُهُمۡ یَسۡعٰی بَیۡنَ اَیۡدِیۡهِمۡ وَ بِاَیۡمَانِهِمۡ یَقُوۡلُوۡنَ رَبَّنَاۤ اَتۡمِمۡ لَنَا نُوۡرَنَا وَ اغۡفِرۡ لَنَا ۚ اِنَّکَ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرٌ
হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবাহ কর; বিশুদ্ধ তওবাহ। সম্ভবতঃ তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের মন্দ কর্মগুলোকে মোচন করে দেবেন এবং তোমাদেরকে প্রবেশ করাবেন জান্নাতে, যার তলদেশে নদীমালা প্রবাহিত। সেই দিন আল্লাহ তাআলা নবি এবং তাঁর বিশ্বাসী বান্দাদেরকে অপদস্থ করবেন না। তাদের জ্যোতি তাদের সামনে ও ডানে আলোকিত হবে। তারা বলবে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের জ্যোতিকে পূর্ণতা দান কর। আর আমাদেরকে ক্ষমা কর। নিশ্চয়ই তুমি সর্ববিষয়ে ক্ষমতাবান।’ (সুরা তাহরিম : আয়াত ৮)
মনে রাখতে হবে
মানুষ গুনাহ করবেই। আর গুনাহের কারণেই বান্দা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে। এমন একটি বর্ণনাও এসেছে হাদিসে। তাহলো-
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যার হাতে আমার জীবন! যদি তুমি পাপ করতে না পারো তবে আল্লাহ তোমাকে অস্তিত্ব থেকে সরিয়ে নেবেন এবং তিনি এমন লোকদের দেবেন যারা পাপ করবে এবং আল্লাহর কাছ থেকে ক্ষমা চাইবে এবং তিনি তাদের ক্ষমা করে দেবেন।’ (মুসলিম)
সে কারণে কেউ যদি পাপ বা গুনাহ করে তবে তারা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবে। কোরআনের বর্ণনায় বিষয়টি এভাবে এসেছে-
رَبَّنَا فَاغۡفِرۡ لَنَا ذُنُوۡبَنَا وَ کَفِّرۡ عَنَّا سَیِّاٰتِنَا وَ تَوَفَّنَا مَعَ الۡاَبۡرَارِ
‘হে আমাদের রব! তুমি আমাদের পাপসমূহ ক্ষমা কর, আমাদের মন্দ কাজসমূহ গোপন কর এবং মৃত্যুর পর আমাদেরকে পুণ্যবানদের সাথে মিলিত কর।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ১৯৩)
অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ তাআলা বান্দাকে আল্লাহর দয়া তথা রহমত থেকে নিরাশ হতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহর প্রতি গুনাহ থেকে মুক্তি পেতে প্রচন্ড আশাবাদী হতে বলেছেন এভাবে-
قُلۡ یٰعِبَادِیَ الَّذِیۡنَ اَسۡرَفُوۡا عَلٰۤی اَنۡفُسِهِمۡ لَا تَقۡنَطُوۡا مِنۡ رَّحۡمَۃِ اللّٰهِ ؕ اِنَّ اللّٰهَ یَغۡفِرُ الذُّنُوۡبَ جَمِیۡعًا ؕ اِنَّهٗ هُوَ الۡغَفُوۡرُ الرَّحِیۡمُ
(হে রাসুল! আপনি) ঘোষণা করে দিন (আমার এ কথা), হে আমার বান্দাগণ! তোমরা যারা নিজেদের প্রতি (গুনাহ বা পাপ দ্বারা) জুলুম করেছ, তারা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না; নিশ্চয়ই আল্লাহ সব পাপ মাফ করে দেবেন। নিশ্চয়ই তিনি চরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা যুমার : আয়াত ৫৩)
এ ঘোষণা মুমিন বান্দার জন্য, ইবাদতকারী বান্দার জন্য আশার বাণী। তাই বলে গুনাহের ব্যাপারে অবহেলা করা যাবে না। আল্লাহর কাছে ক্ষমা পেতে অনুনয়-বিনয়ের মাধ্যমে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। আল্লাহর স্মরণাপন্ন হতে হবে। বিশুদ্ধ তওবাহ করতে হবে।
সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, গুনাহ নিয়ে অবজ্ঞা কিংবা তুচ্ছ মনে করা কোনোভাবেই উচিত নয়। গুনাহের কাজ থেকে দূরে থাকা খুবই জরুরি। আল্লাহর কাছে ক্ষমা পেতে গুনাহমুক্ত জীবন গড়ে দুনিয়া ও পরকালের কল্যাণে নিজেদের নিয়োজিত রাখার বিকল্প নেই।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে গুনাহ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তওবা করে নিজেদের শুধরিয়ে নেওয়ার তাওফিক দান করুন। গুনাহমুক্ত জীবন গঠনের তাওফিক দান করুন। আমিন।