শবে কদরের তাৎপর্য
পবিত্র রমজান মাসের শ্রেষ্ঠতম মর্যাদার অন্যতম কারণ হচ্ছে এই যে, এ মাসেই পুণ্যময় রাত শবে কদর প্রচ্ছন্ন রয়েছে। দুনিয়ার বুকে এ রাতের মতো মূল্যবান রাত আর নেই।
এ প্রসঙ্গে হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে যে, একদিন হযরত রাসুলে করিম (সা.) স্বীয় সাহাবায়ে কেরামদেরকে লক্ষ্য করে বনি ইসরাইল গোত্রের বিখ্যাত বুজুর্গ ‘শামউন’- এর কাহিনি বিবৃত করলেন। বর্ণনা প্রসঙ্গে তিনি বললেন-বনি ইসরাইল গোত্রের একজন আবেদ যার নাম ছিল ‘শামউন’। তিনি সাড়ে তিনশত বছর বেঁচেছিলেন এবং দীর্ঘ জীবনভর তিনি রোজা রাখতেন এবং সারারাত আল্লাহ পাকের ইবাদত- বন্দেগিতে নিমগ্ন থাকতেন। শামউনের এহেন ইবাদতের কথা শ্রবণ করে সাহাবায়ে কেরাম বিমর্ষ হয়ে পড়লেন এবং বিনীতভাবে আরজ করলেন--হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আমরা আপনার উম্মত। আমাদের অধিকাংশের হায়াতই ষাট এবং সত্তরের মাঝামাঝি শেষ হয়ে যাবে। আমরা একান্তই হতভাগ্য। কেননা আমরা এত দীর্ঘ সময় বাঁচব না এবং শামউনের মতো বেশি পরিমাণে ইবাদতও করতে পারব না।
সাহাবারা বিস্ময় প্রকাশ করলে আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের জন্য মাত্র একটি রজনীর উল্লেখ করে বার্তা পাঠালেন। যে রজনীকে ‘খাইরুম মিন আলফি শাহরিন’ তথা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম বলে আখ্যা দিলেন। এতে সাহাবাদের বিস্ময় ও হতাশা মনোভাব কেটে গেল। এ প্রসঙ্গে মহান প্রভু নাযিল করলেন একটি গুরুত্বপূর্ণ সূরা-সূরায়ে কদর।
ইরশাদ হয়েছে: আমি এই কিতাব নাজিল করেছি কদরের রাত্রিতে। (হে মুহাম্মদ!) আপনি কি কদরের রাত সম্বন্ধে জানেন? (অর্থাৎ কদরের রাত কত বরকতময় তা কি আপনি জানেন?)
আয়াতে আল্লাহ তাআলা প্রশ্ন করে পরের আয়াতে নিজেই জবাব দিয়েছেন- ‘কদরের রাত্রি হলো (এমন এক মহিমান্বিত রজনী যা) হাজার মাস থেকেও শ্রেষ্ঠ । এই রাতে ফেরেশতারা ও রূহ আপন প্রভুর নির্দেশে প্রত্যেক কাজের জন্যে (জমিনে) অবতরণ করেন। এটা এমন এক নিরাপত্তা যা সুবহে সাদিক পর্যন্ত অব্যাহত থাকে বস্তুত এই রজনী মহিমান্বিত হওয়ার উল্লেখযোগ্য কারণ হলো যে, আল্লাহ তার প্রেরিত সর্বশেষ গ্রন্থ আল-কুরআন অবতীর্ণের সূচনা এই রজনীতেই করেন। তাই একে ‘লাইলাতুল কদর’ বলে উল্লেখ করেন। কদরের অর্থ মহিমান্বিত ও সম্মানিত।
হযরত আবু বকর (রা.) বলেন, এ রাত্রিকে মহিমান্বিত বলার কারণ হলো-সারাটি বছর ইবাদতে মশগুল না হওয়ার দরুন মূল্যহীন হয়ে পড়েছিল যে বান্দাটি, সেও এই রাতে ইবাদতের মাধ্যমে তওবা ইস্তেগফার করে সম্মানিত হয়ে যায়।- মা’আরিফুল কুরআন।
এই রজনীর মাহাত্যের দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তাআলা অপর স্থানে ইরশাদ ফরমান- ‘সুস্পষ্ট কিতাবের শপথ! আমি ইহা (কুরআন) নাজিল করেছি বরকতময় এক রজনীতে, নিশ্চয় আমি সতর্ককারী। (এটা এমন রাত) যে রাতে সকল প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় ছ্িরিকৃত হয়।' - সূরা দুখান: ২-৪।
আয়েশা (রা) বলেন: ‘যখন রামাদানের শেষ রাত এসে যেত তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) রাত্রি জাগরিত থাকতেন, তার পরিবারের সদস্যদেরকে জাগিয়ে দিতেন, তিনি অত্যন্ত উদ্দীপনার সঙ্গে ইবাদত-বন্দেগিতে রত থাকতেন এবং সাংসারিক, পারিবারিক বা দাম্পত্য কাজকর্ম বন্ধ করে দিতেন।’ (বুখারী, আস-সহীহ ২/৭১১; মুসলিম, আস-সহীহ ২/৮৩২)
রামাদানের শেষ দশ রাতের মধ্যেই রয়েছে ‘লাইলাতুল কদর’ বা তাকদীর বা মর্যাদার রাত।
ইমাম বাইহাকী বলেন: লাইলাতুল কদর অর্থ হলো, এ রাত্রিতে আল্লাহ পরবর্তী বছরে ফেরেশতারা মানুষদের জন্য কী কী কর্ম করবেন তার তাকদীর নির্ধারণ করে দেন। (বাইহাকী, শুআবুল ঈমান ৩/৩১৯)। সুরা কদর-এ আল্লাহ বলেন: লাইলাতুল কদর এক হাজার মাস থেকেও উত্তম।’
এই রাতটি উম্মতে মুহাম্মাদ এর জন্য সবচেয়ে বড় নেয়ামত । একটি রাতের ইবাদত এক হাজার মাস বা প্রায় ৮৪ বছর ইবাদতের চেয়েও উত্তম। কত বড় নেয়ামত! শুধু তাই নয়, এ রাত্রি কিয়ামুল্লাইল বা তাহাজ্জুদে জাগ্রত থাকলে আল্লাহ পূর্ববর্তী সকল গোনাহ ক্ষমা করেন।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: ‘যদি কেউ ঈমানের সঙ্গে সাওয়াব লাভের খাঁটি নিয়তে লাইলাতুল কদর কিয়ামুল্লাইল বা তাহাজ্জুদে অতিবাহিত করে তবে তার পূর্ববর্তী সকল গোনাহ ক্ষমা করা হবে।’ (বুখারী, আস-সহীহ ২/৬৭২, ৭০৯; মুসলিম, আস-সহীহ ১/৫২৩)
আমরা মনে করি, ২৭ শের রাত কদরের রাত। এই চিন্তাটি সঠিক নয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) কখনোই বলেননি যে, ২৭ রামাদানের রাত কদরের রাত । তবে অনেক সাহাবী, তাবিয়ী বা আলিম বলেছেন যে, ২৭শের রাত শবে কদর হওয়ার সম্ভবানা বেশি। এজন্য আমাদের দায়িত্ব হলো রামাদানের শেষ দশ রাতের সবগুলো রাতকেই ‘শবে কদর’ হিসেবে ইবাদত করব। ২৭শের রাতে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে ইবাদত করব।
রাসুলুল্লাহ (সা.) এর তরিকায় আমাদের জন্য সর্বোত্তম তরিকা। এতেই আমাদের নাজাত। তিনি নিজে লাইলাতুল কদর লাভ করার জন্য রামাদানের শেষ দশরাত সবগুলোই ইবাদতের ও
তাহাজ্জুদে জাগ্রত থেকেছেন এবং এরূপ করতে নির্দেশ দিয়েছেন । রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: যদি কেউ লাইলাতুল কদর খুঁজতে চায় তবে সে যেন তা রামাদানের শেষ দশ রাত্রিতে খোজ করে ।’ (মুসলিম, আস-সহীহ ২/৮২৩) এ অর্থে আরও অনেকগুলো হাদিস রয়েছে। এ সকল হাদিসে তিনি রামাদানের শেষ দশ রাত্রির সকল রাত্রিকেই শবে কদর ভেবে ইবাদত করতে বলেছেন।
এক হাদিসে তিনি বলেন, ‘তোমরা রামাদানের শেষ দশ রাত্রিতে লাইলাতুল কদর সন্ধান করবে। যদি কেউ একান্তই দুর্বল হয়ে পড়ে, তবে অন্তত শেষ ৭ রাতের ব্যাপারে যেন কোনোভাবেই দুর্বলতা প্রকাশ না করে।’ (বুখারী, আস-সহীহ ২/৭১১; মুসলিম, আস-সহীহ ২/৮২৩)।
কোনো কোনো হাদিসে তিনি বেজোড় রাত্রিগুলোর বেশি গুরুত্ব দিতে বলেছেন। তিনি বলেন. ‘আমাকে লাইলাতুল কদর দেখানো হয়েছে, অতঃপর আমাকে তা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে অতএব তোমরা শেষ দশ রাতের বেজোড় রাতগুলোতে তা খোজ করবে।’ (বুখারী, আস-সহীহ ২/৭০৯; মুসলিম, আস-সহীহ ২/৮২৩)।
রাসুলুল্লাহ (সা.) লাইলাতুল কদরের উদ্দেশে রামাদানের শেষ কয়েক বেজোড় রাত্রিতে সাহাবীদের নিয়ে জামাতে তারাবীহ বা কিয়ামুল্লাইল আদায় করেন । আবু যার (রা.) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) ২৩শে রামাদানের রাত্রিতে আমাদের নিয়ে কিয়ামুল্লাইল করলেন রাত্রির এক তৃতীয়াংশ পর্যন্ত। এরপর বলেন, তোমরা যা খুঁজছ তা মনে হয় সামনে । এরপর ২৭শের রাত্রিতে তিনি নিজের স্ত্রীরা, পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা সবাইকে ডেকে আমাদেরকে নিয়ে প্রভাত পর্যন্ত জামাতের কিয়ামুল্লাইল করলেন, এমনকি আমরা ভয় পেয়ে গেলাম যে, সাহরি খাওয়ার সময় পাওয়া যাবে না। (তিরমিযী, আস-সুনান ৩/১৬৯)।
শবে কদরের জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) একটি দুআ শিখিয়েছেন । আয়েশা (রা.) বলেন, হে আল্লাহর রাসুল, যদি আমি লাইলাতুল কাদর পাই তাহলে আমি কি বলব? রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তুমি বলবে, ‘হে আল্লাহ, আপনি ক্ষমাশীল মর্যাদাময়, আপনি ক্ষমা করতে ভালবাসেন, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন’ (তিরমিযী, আস-সুনান ৫/৫৩৪, ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ২/১২৬৫)।
এ দুআটি মুখস্থ করে অর্থের দিকে লক্ষ্য রেখে এ দশ রাত্রির নামাজের সিজদায়, নামাযের পরে, এবং সর্বাবস্থায় বেশি বেশি করে পাঠ করতে হবে। আল্লাহ আমাদের সকলকে শবে কদরের ইবাদত করার তাওফিক দিন। আমীন।
ড. মাহবুবা রহমান: সাবেক বিভাগীয় প্রধান. ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ লালমাটিয়া সরকারি মহিলা কলেজ, ঢাকা ।