ইতিকাফ
ইতিকাফের সংজ্ঞা, উদ্দেশ্য ও স্থান
ইতিকাফ-এর শাব্দিক অর্থ অবস্থান করা, কোনো বস্তুর উপর স্থায়িভাবে থাকা। ইতিকাফের মধ্যে নিজের সত্তাকে আল্লাহর ইবাদতের মধ্যে আটকিয়ে রাখা হয় এবং নিজেকে মসজিদ হতে বের হওয়া ও পাপাচারে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত রাখা হয়। শরীয়তের পরিভাষায় ইতিকাফের নিয়ত পুরুষের ঐ মসজিদে অবস্থান করা যেখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামায জামা’আতের সঙ্গে আদায় করা হয় অথবা কোনো মহিলার নিজ ঘরে নামাযের স্থানে অবস্থান করাকে ইতিকাফ বলা হয়।
ইতিকাফের উদ্দেশ্য হলো, দুনিয়ার সবরকম ঝামেলা থেকে নিজেকে মুক্ত করে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের নিমিত্তে একমাত্র তার ইবাদতে মশগুল থাকা।
যে মসজিদে নিয়মিতভাবে আজান, ইকামতসহকারে জামা‘আতের সঙ্গে নামায আদায় হয় সেই মসজিদেই ইতিকাফ করা সহীহ্ হবে। ইতিকাফের সর্বোত্তম স্থান মসজিদুল হারাম, এরপর মসজিদে নববী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এরপর মসজিদে আকসা। এরপর ঐ জুমু‘আর মসজিদ, যেখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামায জামা‘আতের সঙ্গে আদায় করা হয়। এরপর সে মসজিদ যেখানে মুসল্লীর সংখ্যা অধিক হয়ে থাকে (শামী, ২য় খণ্ড ও আলমগীর, ১ম খণ্ড)।
ইমাম আযম আবু হানীফা (র.) থেকে বর্ণিত আছে যে ইতিকাফ সহীহ্ হবে এমন মসজিদে যেখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামায জামা‘আতের সঙ্গে আদায় করা হয় (হিদায়া, ১ম খণ্ড)। মহিলাগণ নিজ ঘরে নামাযের জন্য নির্ধারিত জায়গায় ইতিকাফ করবেন। নামাযের জন্য জায়গা নির্ধারিত না থাকলে ইতিকাফে বসার সময় তা নির্ধারিত করে নিলেও সহীহ্ হবে।
ইতিকাফের ফজিলত ও উপকারিতা
ইতিকাফের ফজিলত ও উপকারিতা অপরিসীম। কেননা দুনিয়ার সবরকম ঝামেলা থেকে মুক্ত করে, নিভৃতে আল্লাহর ইবাদত করার জন্য ইতিকাফ করা হয়। ইতিকাফকারী পুরুষ ও মহিলা বহু ধরনের গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে পারেন। বান্দা ইতিকাফ অবস্থায় আল্লাহ্ তাআলার দরবারে উপস্থিত থাকে। এ জন্য আল্লাহর কাছে সে খুবই মর্যাদাসম্পন্ন হয় এবং আল্লাহ তাআলা তাকে রহমত, অনুগ্রহ ও ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখেন। ইতিকাফকারী ব্যক্তি পুরো সময় ইবাদতের মধ্যে গণ্য হয়ে থাকে। আতা আল-খোরাসানী (র.) বলেছেন, ইতিকাফকারী সেই ব্যক্তির ন্যায়, যে নিজেকে আল্লাহর সম্মুখে সোপর্দ করে দিয়েছে এবং বলেছে যে, আমি এ স্থান ত্যাগ করব না, যতক্ষণ না আমাকে ক্ষমা করা হয়। এ জন্যও ইতিকাফের গুরুত্ব অপরিসীম যে, ইতিকাফের মধ্যে বান্দা আল্লাহর ঘরে ইবাদতে মশগুল রাখার মাধ্যমে নিজের অসহায়ত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে থাকে (বাদায়েউস্ সানায়ে, ২য় খণ্ড)।
ইতিকাফের মধ্যে অন্তরকে দুনিয়াবী বিষয় থেকে মুক্ত করা হয়, নিজেকে আল্লাহর কাছে সোপর্দ করা হয়, আল্লাহর ঘরে নিজেকে আবদ্ধ রাখা হয় এবং আল্লাহর ঘরে নিজেকে সবসময় আটকিয়ে রাখা হয়। অধিকন্তু ই‘তিকাফকারী ব্যক্তি আল্লাহর ঘরের সঙ্গে নিজেকে স্থায়ীভাবে সম্পৃক্ত করে রাখে, যেন আল্লাহ্ তাকে ক্ষমা করে দেন। ইতিকাফ সর্বশ্রেষ্ঠ আমল যদি তা একনিষ্ঠতার সঙ্গে হয়ে থাকে (বাহরুর রাইক, ২য় খণ্ড)।
হযরত সাঈদ ইব্ন জুবাইর হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্ন আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইতিকাফকারী ব্যক্তি সম্পর্কে ইরশাদ করেছেন যে, সে ইতিকাফ এবং মসজিদে বদ্ধ থাকার কারণে গোনাহ থেকে বেঁচে থাকে এবং তার নেকীর হিসাব সব ধরনের নেক কাজ সম্পাদনকারী ব্যক্তির ন্যায় জারি থাকে (ইব্ন মাজা)।
বান্দা যখন ইতিকাফের নিয়তে নিজেকে মসজিদে আটকিয়ে রাখে তখন যদিও সে সালাত, যিকির ও তিলাওয়াত ইত্যাদি ইবাদতের মাধ্যমে বহু সওয়াব অর্জন করতে সক্ষম হয়, কিন্তু এর পাশাপাশি কিছু কিছু সাওয়াবের কাজ থেকেও সে বিরত হয়। সে রোগীর সেবা করতে পারে না। ইয়াতীম, বিধবা, নিঃস্ব ও সর্বস্বান্তের সহযোগিতা করতে পারে না, কোনো মৃত ব্যক্তিকে গোসল দিতে পারে না, জানাযার নামাযে শরীফ হতে পারে না-যেগুলো খুবই পুণ্যের কাজ বলে হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে। সে জন্য উল্লিখিত হাদীসে ইতিকাফকারী ব্যক্তির জন্য এ সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে যে, তার আমলনামায় সেইসব ইবাদতের সাওয়াবও লেখা হবে, ইতিকাফের কারণে যে গুলো থেকে সে বিরত হয়েছিল।
হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) সর্বদা রমযানের শেষ দশদিন ইতিকাফ করতেন। কিন্তু এক বছর তিনি সফর করেছিলেন সে জন্যে পরের বছর বিশদিন ইতিকাফ করেছেন (ইব্ন মাজা)।
হযরত আবদুল্লাহ ইব্ন উমর (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) রমযানের শেষ দশদিন ইতিকাফ করতেন। বর্ণনাকারী নাফী (র.) বলেন, আবদুল্লাহ ইব্ন উমর (রা) আমাকে মসজিদের সেই স্থানটি দেখিয়েছেন, যেখানে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইতিকাফ করেছেন (ইব্ন মাজা)।
সুন্নাত ইতিকাফ
রমযানের শেষ দশকরে ইতিকাফ যা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা কিফায়া। মহল্লাবাসীর কোনো একজন তা আদায় করলে অন্য সকলে দায়মুক্ত হবে। আর কেউ আদায় না করলে সকলেই তরকে সুন্নাতের জন্য দায়ী হবে।
এই প্রকার ইতিকাফের হুকুম হলো, সুন্নাতে মুয়াক্কাদায়ে কিফায়া থেকে মুক্ত হওয়া এবং সাওয়াব হাসিল করা (হাশিয়াতুত্ তাহতাবী ও বাহরুর রাইক, ২য় খণ্ড)।
রমযানের শেষ দশদিনের ইতিকাফত সুন্নাতে মুয়াক্কাদা আলাল কিফায়া। এ ইতিকাফের জন্য রোযা রাখা জরুরি। এই ইতিকাফ শুরু করার পর ভঙ্গ করে দেওয়া হলে অথবা ভঙ্গ হয়ে গেলে, যে কয়দিনের ছুটি গেছে রোযাসহ সে কয়দিনের কাযা জরুরি। কিন্তু একদিনের ছুটলেও রমযানের পর সতর্কতামূলক পুরো দশদিনের কাযা করে নেওয়া উত্তম (শামী, ২য় খণ্ড)।
সর্বশেষে বলব, ইতিকাফের ফজিলত অনেক। যেহেতু রমযান মাসের শেষ দশ দিন ইতিকাফ করলে ২৭ শে রমযান যদি শবে কদর নাও হয়, তবু এ দশদিনের মধ্যে নির্দিষ্ট শবে কদরের ইবাদত এ ইতিকাফের মধ্যে আদায় হয়ে যায় এবং এর ফলে কদরের রাতের ফজিলতও লাভ করা যায়।
ড. মাহবুবা রহমান: সাবেক বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ
লালমাটিয়া সরকারি মহিলা কলেজ, ঢাকা