যাকাতের গুরুত্ব ও ফজিলত
ইসলাম ধর্মের বুনিয়াদী শিক্ষার মধ্যে ঈমান ও নামাজের পরেই যাকাতের স্থান। অতএব জাকাত হলো ইসলামের তৃতীয় রোকন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কালামে পাক বহু স্থানে নামাজের সঙ্গেই যাকাতের উল্লেখ করেছেন। যেমন তিনি এরশাদ করেছেন, “নামাজ কায়েম কর এবং যাকাত দাও।”
জাকাতের আভিধানিক অর্থ পবিত্রতা ও বৃদ্ধি। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় বিত্তশালী ব্যক্তিদের প্রয়োজনাতিরিক্ত ধন-সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ অভাবগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণ করার নাম যাকাত। যাকাত ধনের লবণস্বরূপ। এটি ধন-সম্পদকে কলুষমুক্ত করে পবিত্র করে। এটি ধনবান ব্যক্তিদের হৃদয়কে ধন-লিপ্সা, কৃপণতা, লোভ, স্বার্থপরতা ও কঠোরতা হতে পবিত্র রাখে। যাকাত প্রদানের বরকতে ধনী ব্যক্তিদের সম্পদ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। এই জন্যই এই দানের যাকাত নামকরণ করা হয়েছে।
“যে ব্যক্তি তিনটি কাজ করবে সে ঈমানের স্বাদ ও মজা লাভ করবে; যে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে, জানবে যে আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই এবং আনন্দিত চিত্তে পবিত্র মনে তার সম্পদের যাকাত দেবে।” (আবু দাউদ, আস-সুনান ২/১০৩; আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/১৮৩)
হাদিসের আলোকে জানা যায় যে, কিছু কঠিন পাপ আছে সেগুলির শাস্তি শুধু আখেরাতেই নয়, দুনিয়াতেও ভোগ করতে হয়। বিশেষত সে পাপগুলো মানুষের অধিকারের সঙ্গে জড়িত এবং যে পাপের ফলে অন্য মানুষ কষ্ট পায় বা সমাজের ক্ষতি হয়। এরূপ পাপ যদি সমাজে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে তবে আল্লাহ সে সমাজে গজব দেন এবং সমাজের সকলেই সে শাস্তি ভোগ কনে। যাকাত প্রদান টালবাহানা সেসকল পাপের অন্যতম।
রাসূলুল্লাহ বলেছেন, “(১) যখন কোনো সম্প্রদয়ের মধ্যে অশ্লীলতা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে তারা প্রকাশ্যে অশ্লীলতায় লিপ্ত হতে থাকে, তখন তাদের মধ্যে এমন সব রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়ে যা তাদের পুর্বপুরুষদের মধ্যে প্রসারিত ছিল না। (২) যখন কোনো সম্প্রদয়ের মানুষেরা ওজনে কম বা ভেজাল দিতে থাকে, তখন তারা দুর্ভিক্ষ, জীবনযাত্রার কাঠিন্য ও প্রশাসনের বা ক্ষমতাশীলদের অত্যাচারের শিকার হয়। (৩) যদি কোনো সম্প্রদায়ের মানুষেরা যাকাত প্রদান না করে, তাহলে তারা অনাবৃষ্টির শিকার হয়। যদি পশুপাখি না থাকতো তাহলে তারা বৃষ্টি থেকে একেবারেই বঞ্চিত হতো।” (ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ২/১৩৩২; ইসলামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৫/৩১৮; আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/১৮৭।)
যাকাতের নিসাব: যাকাতের পরিমাণ বৎসরের শেষে সঞ্চিত অর্থের চল্লিশ ভাগের এক ভাগ। কেবল টাকার উপরেই যাকাত নির্ধারিত হয়নি; বরং স্বর্ণ, রৌপ্য, ব্যবসার পণ্যদ্রবা, জমির ফসল এবং গৃহপালিত গো, মহিষের উপরও ধার্য করা হয়েছে। তবে প্রত্যেক প্রকারের সম্পদের উপর যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য এটির নিম্নতম পরিমাণ নির্ধারিত আছে। এই পরিমাণের নাম নিসাব। যেমন স্বার্ণের নিসাব সাড়ে সাত তোলা, রৌপ্যোর নিসাব সাড়ে বায়ান্ন তোলা ইত্যাদি।
৪-খ মূলত পাঁচ প্রকার সম্পদের যাকাত প্রদান করা ফরয। (১) বিচরণশীল উট, গরু, ছাগল ইত্যাদি গৃহপালিত পশু, (২) সোনা-রূপা, (৩) নগদ টাকা, (৪) ব্যবসা বা বিক্রয়ের জন্য রক্ষিত দ্রব্য ও (৫) কৃষি উৎপাদন বা ফল ও ফসল। যেহেতু আমাদের দেশে খোলা চারণভূমিতে পশু পালনের ব্যবস্থা নেই এবং নিসাবযোগ্য পশুও কারো থাকে না, সেহেতু আমাদের দেশে গৃহপালিত পশুর যাকাত সাধারণভাবে কাউকে দিতে হয় না। এ ছাড়া বাকি সম্পদগুলির যাকাত প্রদানের নিয়ম নিম্নরূপ:
(১)স্বর্ণ: যদি কারো নিকট সাড়ে ৭ তোলা (ভরি) বা তার বেশি স্বর্ণ থাকে তবে প্রতি চান্দ্র বৎসর (৩৫৪ দিন) পূর্তিতে মোট স্বার্ণের ২.৫% যাকাত প্রদান করতে হবে। যেমন কারো যদি ১০ ভরি স্বর্ণ থাকে তবে প্রতি বৎসরে তাকে ০.২৫ ভরি স্বর্ণ বা তার দাম যাকাত হিসাবে প্রদান করতে হবে। সাড়ে ৭ ভরির কম স্বর্ণ থাকলে যাকাত ফরজ হবে না।
(২) রৌপ্য: যদি কারো কাছে সাড়ে ৫২ তোলা বা তার বেশী রূপা থাকে তবে প্রতি চান্দ্র বৎসরে মোট রূপার ২.৫% যাকাত প্রদান করতে হবে।
(৩) নগদ টাকা। নগদ টাকার নিসাব হবে স্বর্ণ বা রৌপ্যের নিসাবে। হাদিসে মূলত রৌপ্যের নিসাবই বলা হয়েছে। এছাড়া রূপার নিসাবে আগে যাকাত ফরয হয়। এজন্য বর্তমানে কারো কাছে যদি সাড়ে ৫২ তোলা রূপার দাম এক বৎসর সঞ্চিত থাকে তবে তাকে মোট টাকার ২.৫% যাকাত দিতে হবে। যেমন কারো যদি ৩০ হাজার টাকা সঞ্চিত থাকে তবে তাকে বছর শেষে ৬৫০ টাকা যাকাত দিতে হবে।
(৪) ব্যবসায়ের সম্পদ। বিক্রয়ের জন্য রক্ষিত সকল সম্পদের যাকাত দিতে হবে। যদি দোকানে, গোডাউনে, বাড়িতে মাঠে বা যেকোনো স্থানে বিক্রয়ের জন্য রক্ষিত মাটি, বালি, ইট, গাড়ি, জমি, বাড়ি, ফ্লাট বা অন্য যেকোনো পণ্য থাকে এবং তার মূল্য সাড়ে ৫২ তোলা রূপার মূল্যের সমান বা তার চেয়ে বেশি হয় তবে বৎসর শেষে মোট সম্পদের মূল্যের ২.৫% যাকাত দিতে হবে।
(৫) ভূমিজাত ফল ও ফসল। ফল-ফসলের যাকাতকে “উশর” বলা হয়। ভূমি ব্যবহার করে উৎপাদিত সকল প্রকারের ফল, ফসল, মধু, লবন ইত্যাদির যাকাত দিতে হবে। ফল-ফসলের যাকাত দিতে হয় প্রতি মৌসূমে ফল-ফসল ঘরে উঠালে। হাদীসে শরীফে ফল ফসলের নিসাব বলা হয়েছে ৫ ওয়াসাক। অর্থাৎ প্রায় ২৫ মণ। তবে ইমাম অবূ হানীফা (রাহ) বলেছেন সে, কম বেশি সব ফল-ফসলেরই যাকাত দেওয়া দরকার। ফল-ফসলের যাকাতের পরিমাণ হলে ৫% বা ১০%। বৃষ্টির পানিতে বা স্বাভাবিক মাটির রসে যে সকল ফসল বা ফল হয় তা থেকে ১০% যাকাত দিতে হবে। আর সেচের মাধ্যমে উৎপাদিত ফল-ফসলের ৫% যাকাত দিতে হবে। ফল বা ফসলের মূল্যও প্রদান করা যায়।
ইসলামের যাকাত ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য হলো দারিদ্র্য বিমোচন করা। যাকাতের মাধ্যমে দুভাবে দরিদ্রদের সাহায্য করতে হবে। প্রথমত তাদের তাৎক্ষণিক চাহিদা মেটানো এবং দ্বিতীয়ত তাদের দারিদ্রের স্থায়ী সমাধান করা। এজন্য ইসলামে যাকাতকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় প্রদান করা হয়েছে। ইসলামের নির্দেশ হলো রাষ্ট্র নাগরিকদের নিকট থেকে যাকাত গ্রহণ করবে এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় তা বণ্টন করবে। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার অনুপস্থিতিতে মুমিন অবশ্যই নিজের ফরয ইবাদত নিজেই আদায় করবেন। যদিও ব্যক্তিগতভাবে যাকাত আদায়ের কারণে দারিদ্র্য বিমোচনে যাকাত পূর্ণ অবদান রাখতে পারছে না। কারণ দরিদ্র ব্যক্তি নগদ টাকা খরচ করে ফেলেন এবং তা উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করতে পারেন না। এতদসত্ত্বেও আমাদের চেষ্টা করতে হবে ব্যক্তিগতভাবে বা কয়েকভাবে মিলে একত্রিভাবে প্রতি বৎসর যাকাতের কিছু টাকা দারিদ্র্য বিমোচনে ব্যয় করার। যাকাতের টাকা দিয়ে দরিদ্রদের রিকশা, গরু, সেলাই মেশিন বা কুটিরশিল্প জাতীয় কিছু কিনে দেওয়া যায়। যেন গ্রহিতা এগুলি বিক্রয় না করতে পারে সেজন্য তত্ত্বাবধান প্রয়োজন।
যাকাত বণ্টনের খাত সমূহঃ যাকাত ব্যয়ের খাতসমূহ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে সুপষ্ট বিধান রয়েছে। “যাকাতের অর্থ দরিদ্র, মিসকিন, যাকাত আদায়কারী কর্মচারী, যাদের মন আকর্ষণ করা প্রয়োজন হয়, দাস-মুক্তি, ঋণ গ্রস্ত, আল্লাহর রাস্তায় এবং মুসাফিরদের জন্য ব্যয়িত হবে।”
তবে যাকাতের সম্পদ প্রদানের ক্ষেত্রে প্রধান মূলনীতি হলো তা ব্যক্তিকে প্রদান করতে হবে এবং প্রদান নিঃশর্ত হবে। যাকাত গ্রহণকারী ব্যক্তিকে পরিপূর্ণ স্বত্ব, মালিকানা ও ব্যয়ের ক্ষমতা দিয়ে তা প্রদান করতে হবে। এজন্য যাকাতের অর্থ কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে, মসজিদ, মাদ্রাসা, রাস্তাঘাট ইত্যাদি কাজে ব্যয় করা যাবে না। অনুরূপভাবে মৃত ব্যক্তির দাফন কাফন বা ঋণ পরিশোধের জন্যও ব্যয় করা যাবে না। কারণ এখানে নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তিকে যাকাত সম্পদের মালিকানা প্রদান করা হচ্ছে না। কোনো নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান যদি সঠিক খাতে ব্যয় করার জন্য যাকাত সংগ্রহ করে তাহলে তাদের যাকাত প্রদান করা যাবে। উক্ত প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা যাকাত প্রদানকারী মুসলিমের পক্ষ থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত অ্যাটর্নি হিসাবে বিবেচিত হবেন। তাদের দায়িত্ব হলো সংগৃহীত যাকাত সঠিক খাতের মুসলিমগণকে সঠিকভাবে প্রদান বা বণ্টন করা।
যাকাত গ্রহণকারী ব্যক্তি অবশ্যই মুসলিম হবেন। যাকাত শুধুমাত্র মুসলিমদের প্রাপ্য। কোনো অমুসলিম যাকাত পাবেন না। মুসলিম নামধারী কোনো ব্যক্তি যদি নামাজ না পড়ে বা প্রকাশ্য শিরক বা কুফরীতে লিপ্ত থাকে তাহলে তাকে যাকাত দেওয়া যাবে না। একজন মুসলিম কোনো অমুসলিমকে নফল দান, সাহায্য ও সামাজিক সহযোহিতা করতে পারেন। কিন্তু তার ফরয দান বা যাকাত তিনি শুধুমাত্র মুসলিমকেই প্রদান করবেন। নিজের পিতামাতা, স্ত্রী ও সন্তানগণকে যাকাত দেওয়া যায় না। এছাড়া ভাই বোন, চাচা, মামা ও অন্যান্য স্বজন কেউ দরিদ্র হলে তাকে যাকাত দেওয়া যায়। বরং তাদেরকে সবচেয়ে আগে বিবেচনা করতে হবে।
যাকাত এবং সকল দানের ক্ষেত্রে একটি মূলনীতি হলো এর উপকার যত ব্যাপক হবে সাওয়াব তত বেশি হবে। যেমন, যে কোনো মুসলিম দরিদ্রকে যাকাত প্রদান করা যাবে। তবে একজন দরিদ্র তালেবে এলেম বা আলেমকে যাকাত প্রদান করলে এ সাহায্য তাকে অধিকতর ইলম চর্চা ও প্রসারের সুযোগ দেবে, যা উক্ত যাকাত দ্বারা অর্জিত অতিরিক্ত উপকার। এজন্য যাকাত দাতার সাওয়াব বৃদ্ধি পাবে। যাকাত ও উশর প্রদানের সময় এ মূলনীতির দিতে লক্ষ্য রাখা দরকার, যেন আমাদের যাকাত শুধুই ব্যক্তিগত আর্থিক সাহায্য না হয়ে অধিকতর কিছু কল্যাণে পরোক্ষভাবে হলেও অবদান রাখে। কোনো ভাল মাদ্রাসায় যদি যাকাত তহবিল থাকে তাহলে আপনাদের যাকাত ও উশরের টাকা বা ফসল সেখানে দেবেন। এতে যাকাত আদায় ছাড়াও ইলম প্রচারের অতিরিক্ত সাওয়াব হবে। অনুরূপভাবে দীনদার দরিদ্র মানুষকে দিলে যাকাত আদায় ছাড়াও দীন পালনে সহযোগিত হবে।
যাকাত সাধারণত আমরা রমযান মাসেই দিয়ে থাকি। তবে যাকাত হিসাব করে একবারে রমযান মাসে দান করতে পারেন। আবার ইচ্ছা করলে সারা বছরই যখন কাউকে দেয়ার প্রয়োজন মনে করেন তখন তা দিতে পারেন। তবে আপনাকে অবশ্যই হিসাব রাখতে হবে, যে পরিমাণ যাকাত আপনার হয়েছে তা আপনে ঠিকমত দান করেছেন কি না?
ড. মাহবুবা রহমান, সাবেক বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, লালমাটিয়া সরকারি মহিলা কলেজ, ঢাকা।
এসএন