ইবাদাত শব্দের প্রকৃত অর্থ
আমরা কেবল তোমারই ইবাদত করি। এ কথার অর্থ এটা নয় যে, আমরা নামাজ আদায় করি, তোমাকে সিজদা করি, রমজান মাসে রোজা পালন করি, কোরবানি দেই, সামর্থ হলে হজ ও করি, নবী (সঃ) এর প্রতি দরূদ পড়ি, নবীর ইশবে জুলুশ বের করি, রবিউল আউয়াল মাসে গরু জবেহ করি।
আসলে ইসলামে ইবাদত বলতে যা বোঝানো হয়েছে, সেই ইবাদত কি? তা না বুঝার কারণেই মাত্র গুটি কয়েক আনুষ্ঠানিক কাজকেই মানুষ ইবাদত হিসেবে গণ্য করেছে। (ইবাদত) শব্দটি (আবদুন) কে নির্গত যার অর্থ ব্যাপক। এখান থেকে এসেছে (না‘বুদু) অর্থ আমরা কেবল তোমারই ইবাদত করি। এ বাক্যটি উচ্চারণ করে বান্দা মহান আল্লাহবে একথাই জানিয়ে দিচ্ছে যে, আমরা একমাত্র তোমারই উপাসনা করি।
আমরা একমাত্র তোমারই অনুগত হয়ে জীবন যাপন করি এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে শুধু তোমারই আদেশ অনসরণ করে চলি। তাহলে কথা স্পষ্ট হয়ে গেল যে শুধু মাত্র নামাজ, রোজা, হজ্ আদায় করা তাস্বীহ ও জিকির করার নামই ইবাদত নয়। সমগ্র জীবনের প্রতিটি বিভাগে আল্লাহর দেয়া আনি-কানুন অনুসরণ করার নামই হলো ইবাদ। শুধু নামাজ রোজ জিকির আযকার তাস্বীহ স্বাধীন মনে করলে হবে না। যা ইচ্ছা তা করলে হবে না। এটাই যদি ইবাদত হয়-তাহলে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠে যে দিন রাত ২৪ ঘন্টার মধ্যে ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে কতটুকু সময়ের প্রয়োজন হয়?
খুব বেশী হলে দেড় ঘণ্টা সময়ের প্রয়োজন হতে পারে। এই নামায আদায়ের নামই যদি ইবাদত হয়, তাহলে এ কথাই প্রমাণিত হল-একজন মানুষ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মাত্র দেড় ঘণ্টার জন্য আল্লাহর গোলাম। অবশিষ্ট গড়ে ২২ ঘণ্টার জন্য সে শয়তানের গোলাম।
এভাবে যদি ঘণ্টার মধ্যে মাত্র দেড় ঘন্টার জন্য আল্লাহর গোলামী যে করলো সে ব্যক্তি প্রতি মাসে মাত্র ৪৫ ঘণ্টা আল্লাহর গোলামী করলো। এক বছরে সে ৫৪০ ঘণ্টা করলো আল্লাহর। মানুষ যদি গড় আয়ু লাভ করে ৬০ বছর, তাহলে সে গোটা জীবনকালে একদিন অনুসারে ৬০ বছরের জীবন কালে মাত্র ১৩৫০ দিন অর্থাৎ সাড়ে তিন বছরের সামান্য কিছু বেশি সময় আল্লাহর গোলামী করল। আর বাকি সাড়ে ৫৬ বছর শয়তানের গোলামী করলো।
একমাত্র রোজা পালন করার নামই যদি ইবাদত হয়, তাহলে বছরের অবশিষ্ট ১১ মাসের জন্য সে শয়তানের গোলামী করল। ৬০ বছরের জীবনকালে নিয়মিত ভাবে প্রতি রমজান মাসে রোজা আদায় যদি করা হয় তাহলে প্রতি বছরে ১ মাস হিসেবে মাত্র ৬০ মাস অর্থাৎ বছর হয়। মানুষ তার ৬০ বছরের জীবন কালে মাত্র ৫ বছরের জন্য আল্লাহর গোলাম হবে আর অবশিষ্ট ৫৫ বছর শয়তানের গোলামী করবে?
কোন মুসলমান কে যদি প্রশ্ন করা হয় যে আপনি শয়তানের গোলাম বা চাকর হতে প্রস্তুত রয়েছেন কিনা? সুতরাং ইবাদাতের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেল যে শুধুমাত্র নামাজ, রোজ, হজ, জাকাত আদায় করার নামই ইবাদত নয়। এগুলো অবশ্যই করণীয় আনুষ্ঠানিক ইবাদত। এগুলো তো অবশ্যই আদায় করতে হবে।
নামাজ, রোজ, হজ যাকাত হলো ইবাদাতের একটি অংশ। ইবাদাতের যে বিশাল পরিধি রয়েছে, তার কিছু মাত্র অংশ হলো নামাজ ও রোজা। এই নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত মানুষকে বৃহত্তর ক্ষেত্রে ইবাদাতের যোগ্য করে গড়ে তোলে। এগুলো যারা আদায় করে না, তারা ইবাদাতের যোগ্য কোনক্রমেই হতে পারে না। সৈনিক হিসাবে গড়ার লক্ষ্যেই তাদের কে নানা ধরণের ট্রেনিং দেয়া হয। কুচ্কাওয়াজ করানো হয়। তেমনি নামাজ, রোজা নিষ্টার সঙ্গে আদায় করার নির্দেশ এ জন্য দেয়া হয়েছে যেন মুসলমান জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান মেনে চলার অভ্যাস সৃষ্টি করতে পারে। সুতারাং স্পষ্ট হয়ে গেল যে মানুষের সমস্ত ক্রিয়া কর্মই ইবাদত। উঠা-বসা, হাঁটা-চলা, কথা বলা, কথা শোনা দাঁড়ানো, গুমানো, আহার করা, বিশ্রাম করা, করা, মলমুত্র ত্যাগ করা, স্ত্রী সাথে কথা-বার্তা বলা। সন্তান প্রতিপালন করা, চাকুরি করা, ব্যবসা করা, শিক্ষা দেয়া ও গ্রহণ করা, যুদ্ধ করা, যুদ্ধ তেকে বিরত থাকা, আন্দোলন সংগ্রাম করা, মিছিল করা, সাংস্কৃতি অনুষ্ঠান করা, মাতৃভাষা দিবস পালন করা, বই মেরা দেয়া, নেতৃত্ব দেয়া, কর্মী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা, বিচার মীমাংসা করা, দেশ শাসন করা, স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করা, জনসেবা করা, কল্যাণকর কোন কিছু আবিস্কার করা অর্থাৎ যে কোন ধরণের বৈধ কর্মকাণ্ড করাই ইবাদত।
আল্লাহর ইবাদত কেহ করছে না। (আল্লাহ বলেনঃ আফাগাইরা দ্বীনাল্লাহি ইয়াবগুনা ওলাহু আছলামা মান ফিসসামাওয়াতি ওয়াল আরদি ত্বওয়া’ন ওয়া কারহান ওয়া ইলাইহি ইয়ারজিউ’ন)।
অর্থঃ তোমরা কি আমার দেয়া জীবন ব্যবস্থা ত্যাগ করে অন্যের বানানো জীবন ব্যবস্থা, দীন অনুসন্ধান করো?
অথচ আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু রয়েছে, তার সব কিছুই আমার সামনে আনুগত্যের মস্তক অবনত করে দিয়েছে।
এই ভূ-পৃষ্ঠের একটি ক্ষুদ্র ধুলিকণা থেকে শুরু করে ঐ বিশাল বিস্মৃত মহাশূন্যে বিচরণশীল দৃশ্যমান-অদৃশ্যমান গ্রহ-উপগ্রহ, নিহারিকাপুঞ্জ, নক্ষত্র জগৎ অবধি যা কিছু যেখানে রয়েছে, তার সমস্ত কিছুই মহান আল্লাহর নিয়মের আনুগত্য। পৃথিবীতে ক্ষুধামুক্ত পরিবেশ, নিরাপত্তা, স্বস্তি, শান্তি অর্থাৎ মানুষের মৌলিক অধিকার লাভ করতে হলে যেমন আল্লাহর ইবাদত করা অপরিহার্য। তেমনি পরকালে জান্নাত লাভ করতে হলে ও আল্লাহর ইবাদত করা অপরিহার্য। জান্নাতে কে না যেতে চায়? সবাই চায় জান্নাতে যেতে।
পক্ষান্তরে আল্লাহর জান্নাত লাভ করার একমাত্র মাধ্যম হলো নির্ভেজাল পদ্ধতিতে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করা।
লেখক: খতীব বিএসটিআই জামে মসজিদ, মহাখালী, বনানী, ঢাকা