রুচির দুর্ভিক্ষ: একটি মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ
রুচির দুর্ভিক্ষের কথাটা প্রথম বলেছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সেই ৭০ দশকের গোড়ার দিকে। তার কথায়‘ এখন তো চারিদিকে রুচির দুর্ভিক্ষ! একটা স্বাধীন দেশে সুচিন্তা আর সুরুচির দুর্ভিক্ষ! এই দুর্ভিক্ষের কোন ছবি হয়না।’ শিল্পাচার্যের সেই কথাটি নতুন করে উঠে এসেছে কিংবদন্তী নাট্যকার, অভিনেতা মামুনুর রশিদের কথায়। তিনি বলেন আমরা নতুন করে রুচির দুর্ভিক্ষে মধ্যে পড়ে গেছি। আর সেখান থেকেই হিরো আলমদের মতো একটা লোকের উত্থান হয়েছে। যে উত্থান কুরুচি, কুশিক্ষা, ও অপসংস্কৃতির উত্থান। সামগ্রিক ভাবে তিনি বোঝাতে চান এই সমস্যা একদিকে যেমন রাজনৈতিক অন্যদিকে সাংস্কৃকিতও।
সাম্প্রতিক সময়ে শব্দটা নিয়ে দেশের মানুষ মনে হচ্ছে বহুদা বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একদল সুরুচির পক্ষে আরেকদল এই পরিস্থিতি মানতে নারাজ বলা যায় বিপক্ষে। দুর্ভিক্ষ বলতে যদি সীমাহীন অভাবকে বোঝায় তাহলে ৭০ দশকের শিল্পাচার্য জয়নুলের হাত ধরে এই আলোচনা নতুন করে সামনে আসাটা প্রাসঙ্গিক। চারিদিকে বহুমুখি দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে আপাত দৃষ্টিতে বিষয়টি সরল মনে হলেও এই পতনমুখী সমাজে এটা একদিনে তৈরি হয়নি। এটা তৈরি করেছি আমরা; সস্তা জনপ্রিয়তা আর আকাশ সংস্কৃতির কবলে এই উত্থানের পিছনে আমাদের অবদানও কম নয়। হিরো আলম, মাহফুজুর রহমান, ছিদ্দিক চোর সমাজের এক একজন ট্রাজিক হিরো। সুরুচি আর কুরুচির মধ্যে এক নতুন রসিকতা। ঘটনার আরেকটু পিছনে গেলে আমরা দেখি শব্দটা নাট্যকের মামুনুর রশিদ যে কথা বলেছেন সেটা পুরনো কথার পুরনাবৃত্তি। তাহলে চরম সত্য হলো এই হক কথা নিয়ে এতো হইচই কেন? উত্তর একটাই সেটা চিন্তা ও রুচির দুর্ভিক্ষ। এই চরম সত্য স্বীকার করার মত মানুষের অভাব। এ প্রসঙ্গে হুমায়ুন আজাদের উক্তিটিই বেশি প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়। ‘সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’ আর সব কিছু দখল নেয়ার জন্য রুচিশীল হওয়াটা বিভ্রান্তিকর, ধূয়াশাচ্ছন্ন ছাড়া আর কিছুই নয়। সমকালে এই উক্তি ছিল সকল অরুচির বিরুদ্ধে এক নতুন চপেটাঘাত। আজ হতে অর্ধশত বছর পুর্বেই যদি দেশে রুচির দুর্ভিক্ষের অস্তিত্ব দেখতে পায় তাহলে বলতে দ্বিধা নেই আজ সেটা মহামারীতে রুপ নিয়েছে।
বহুভাষাবিদ ডক্টর মুহাম্মদ শহিদুল্লাহর বয়ানও এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। ‘যে দেশে জ্ঞানের কদর হয়না সে দেশে কোন জ্ঞানীর জন্ম হয় না’। মোসাহেবী প্রবণতা, তৈলমর্দন, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব ও সুযোগকে কাজে লাগিয়ে একটা শ্রেণি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকারের রাজনীতিতে অংশ নিয়ে সমাজের সমীহ আদায় করে নিয়েছে। যেখানে অপেক্ষাকৃত রুচিশীলরা রয়ে গেছে আড়ালে। যেখানে জ্ঞানীদের থেকে তথাকথিত স্বল্পবুদ্ধিসম্পন্ন ধনীদের কদর বেড়েছে সেখানে তালমেলাতে না পেরে বিলিন হয়ে গেছে ডাইনোসারের মত। বাংলাদেশ জন্মের পরবর্তী দর্শকগুলোতে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উত্থান পতনের ডামাডোলে পড়ে মধ্যবিত্তরা যেমন দাঁড়াতে পারেনি, হয় উচ্চবিত্ত না হলে নিম্নবিত্তের ভিতর বিলীন হয়ে গেছে। তেমনি রুচিশীলরা কোথাও টিকতে পারেনি, পৃষ্ঠপোশকতার অভাবে সংখ্যায় কমতে কমতে তারা লীন হয়েছে সর্বত্রই। এখানে একপক্ষ সংগঠিত হয়েছে অন্যপক্ষ উজাড় হয়েছে। এই সময়ে তারা হয়েছে উপেক্ষিত, বঞ্চিত, শোষিত, এবং নিগৃহীত। মেধা, মননে আর চিন্তায় তারা যতটুকু বিকশিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে যতটুকু আত্মিক উন্নতি করতে পেরেছে তথাকথিত অন্যরা তার চাইতে বেশি করেছে। তাদের পতন জানান দিয়েছে দুর্ভিক্ষের, সেটা এখনো চলছে অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় বেড়েছে বৈ কমেনি। প্রতিভাবানরা দেশে নিজেকে সামাজিক রাজনৈতিক কারণে মেলে ধরতে পারেনি, দেশ ছেড়েছে। রয়ে গেছে রুচিহীনরা সংখ্যায়, জনসংখ্যা বৃদ্ধির মত তারাই বেড়েছে। ফুলে ফেপে উঠেছে সর্বত্র, এখন তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ, বাকিরা সংখ্যালঘু । কাজেই এমন চিৎকারে তারা সংঘটিত হবে, সরব হবে সেটা বলাই যাই। আর এই রুচির দুর্ভিক্ষের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র, শিক্ষা, রাজনীতি, অর্থনীতি চিন্তাই মননে নিরব দুর্ভিক্ষের প্রবণতা বাঙালি ব্যতীত অন্য জাতির ভেতর কতটুকু আছে সেটা ভাববার বিষয়। হিরো আলম, ছিদ্দিক চোরদের উত্থান পর্বে প্রমোট করে এখানে টেনে আনাটা আসমানে থু-থু মারার ঘটনাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে একদিকে রুচিহীনদের দৈাড়ঝাঁপ অন্যদিকে সেই স্রোতে টিকতে না পেরে রুচিশীলদের মুখ লুকিয়ে বেঁচে থাকার আপ্রাণ প্রচেষ্টা, এমন চলতে থাকলে এই দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে প্রথমে মানুষের মননে ক্যান্সার পরে মহামারী ছড়িয়ে পড়বে সে কথা বলাই যায়। আর এভাবেই এই দুর্ভিক্ষ ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়বে দেশ হতে দেশান্তরে।
প্রাবন্ধিক, গল্পকার ও শিক্ষা গবেষক
ডিএসএস/