ভিলেজ পলিটিক্স সমাজের বিষফোঁড়া
বর্তমান সময়ে রাজনীতির সর্বনিম্ন প্ল্যাটফর্ম হলে গ্রাম্য রাজনীতি। যেখানে গ্রামের সাধারণ থেকে অতি সাধারণ মানুষ কৃষক, শ্রমিক, মজুর রাজনৈতিক পরিচয় দানে উদ্যোমী হচ্ছে। এই সাধারণ মানুষগুলো বুঝেনা রাজনীতির ইতিবৃত্ত, জানেনা কলা কৌশল তথাপি দেশ ও স্বাধীনতার মায়ায় রাজনৈতিক দল গুলোকে শক্তিশালী করে দেশ ও জাতিকে এগিয়ে দিতে নিজেকে উৎসর্গ করতে চায়। বহুলাংশে তারা সরাসরি দেখেনা তাদের দলনেতাকে তবুও দল ও নেতার মায়ায় সর্বস্ব বিলিয়ে দেয়। সাধারণ মানুষগুলো কতইনা কোমল হৃদয়ের, বন্ধু ভাবাপন্ন, যাদের রয়েছে শস্য ভান্ডারের ন্যায় সম্প্রীতির ভান্ডার। গ্রামের মানুষগুলোর মধ্যে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সৌহার্দ্য সম্পর্ক দেখে মনে হয় যেন সবাই একই পরিবারের আওতাভুক্ত। সুখে-দুঃখে সবাই পরস্পরের পাশে। যে কোনো ধরনের সমস্যার সমাধানে সকলে এগিয়ে আসে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে। একের উপর অপরের অগাধ আস্থা ও বিশ্বাস। ভাতৃত্ববোধ আর ভালোবাসায় শত্রুতাগুলো বন্ধুত্বে পরিণত হয়। অথচ সময়ের ব্যবধানে সেই গ্রামীণ সমাজ যেন আজ অস্থির হয়ে উঠেছে। সেই সৌহার্দ্যপূর্ণ গ্রামীণ শৃঙ্খলা আজ হারিয়ে যাচ্ছে। আফসোস যে, একশ্রেণির হীনমনের মানুষ গ্রামের সাধারণ মানুষগুলোর আবেগ নিয়ে খেলা করছে। যেখানে গ্রামের সাধারণ মানুষগুলো নিজ পরিবার ও সমাজের পরিচয়ে বেড়ে ওঠে সেখানে আজ কথিত দল ও নেতার পরিচয়ে বেড়ে ওঠতে দেখা যায়। একসময় মানুষ বলতো আমি অমুক বংশের লোক, আজ বলছে আমি অমুক দলের হুমুক নেতার লোক। নেতারা সামান্য সুবিধা দিয়ে, অসুবিধা থেকে উত্তোরণের কথা বলে, সামান্য অর্থদানে, চা পান করিয়ে, লোভে-প্রলোভনে সাধারণ মানুষ গুলোকে নিজেদের গোলামে পরিণত করছে। যুব সমাজের হাতে তুলে দিচ্ছেন মদ, গাঁজা, ইয়াবা, ফেনসিডিল ও ভারী অস্ত্র। শহরের ন্যায় গ্রামের রাস্তায়ও এখন যুবকদেরকে মদ খেয়ে ঢলে পড়তে দেখা যায়। নেতারা যুবকদের সামান্য পকেট খরচ ও সুবিধাদী দিয়ে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে লিপ্ত আছে। গ্রামীণ অপরাজনীতির ফলে সমাজ থেকে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ উঠে যাচ্ছে। দলীয় প্রীতির কারণে পিতা-পুত্রের, পুত্র-পিতার, ভাই-ভাইয়ের, চাচা-ভাতিজার, খেলার সাথী এমনকি সহপাঠী একে অপরের মাথায় আঘাত করতে দ্বিধা করছেনা। সমাজ থেকে সামাজিকতা চিরতরে বিদায়ের পথে। সামাজিকতার আসনে রাজনৈতিকতা প্রতিস্থাপিত হচ্ছে।
একসময় গ্রামের শালিস গুলো মুরুব্বিদের সম্বন্বয়ে সম্পন্ন হতো। মুরুব্বিদের কথার উপরে কেউ কথা তুলতো না। কিন্তু আজ শালিস গুলো করছে কথিত রাজনৈতিক নেতা। যিনি শালিসে যাওয়ার সময় একদল গুন্ডাপান্ডা সাথে নিয়ে যান। নেতারা শালিস দাবিদারের পলিটিক্যাল ধ্যান-ধারণা, অর্থকড়ি, দাপট ও প্রভাবের বিষয় মাথায় রেখে রায় দেন। তাদের কাছে নীতির কোনো বালাই নাই। ভ্রুক্ষেপ নেই ন্যায় অন্যায়ের। “জোর যার মুল্লক তার” ও ”আমি কোন হনুরে” এমন ভাবটাই অনেকাংশে লক্ষণীয়।
দাঙ্গা, মারামারি, অপরাজনীতি, অনৈতিক লেনদেন, অনৈতিক প্রভাব, স্বজনপ্রীতি, দলপ্রীতি প্রতিটি সমাজে ক্যান্সারে পরিণত। এক সময় ভার্সিটি ক্যাম্পাস ও শহরের অলিগলিতে রাজনৈতিক বলয়ে গড়ে ওঠা যুবকদের মিলনমেলা দেখা যেত। আজ গ্রামের রাস্তার মোড়ে, চায়ের দোকানে, প্রতিষ্ঠানের মাঠে ও ক্লাব ঘরে আড্ডা মিলছে গ্রামীণ রাজনৈতিক যুব সমাজের। তাদের আলোচনায় ফুটে ওঠে কোন ছেলেটা তাদের দল বিরোধী, এলাকার কোন মেয়েটা সুন্দরী, কার পরিবারে সম্পত্তি বিবাদ এবং কোথায় গেলে দু-চার টাকা ধান্ধা মিলবে। একসময় মানুষ শহরে বেড়ে ওঠতে ভয় পেতো কিন্তু আজ গ্রামের কথিত যুব ও রাজনেতিক নেতাদের অপমানের ভয়ে গ্রাম ছেড়ে শহরমুখী হচ্ছে। শহর গুলোতে অভিভাবক তাদের সন্তানকে প্রতিষ্ঠানে নিজে আনা-নেওয়া করেন কিন্তু আজ গ্রামীণ বখাটের ভয়ে অভিভাবকগণ তাদের কন্যা সন্তানকে প্রতিষ্ঠানে আনা-নেওয়া করতে হচ্ছে। একসময় মানুষ মনে করতো সন্তানকে শহরে পাঠালে অভিভাবকহীনতায় নষ্ট হয়ে যাবে কিন্তু আজ গ্রামে থেকেই নষ্ট হওয়ার ভয়ে কৃষক-দিনমজুর পিতা সন্তানকে শহরে পাঠাচ্ছে।
গ্রামের প্রতিটা রন্ধ্রে রন্ধ্রে রাজনীতি ঢুকে পড়েছে। গ্রামের হাট-বাজার, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন এমনকি মসজিদগুলোর কমিটি পর্যন্ত দলীয় বলয়ে গঠিত হয়। ফলে দেখা যায় এসএসসি’র পূর্ণরূপ না জানা গন্ডমূর্খ উচ্চ-বিদ্যালয়ের সভাপতির পদকে কলঙ্কিত করছে, গাঁজাখোর ও ইভটিজিংয়ের মামলায় কারাবরণ করা ব্যক্তি আলোর দিশারী সামাজিক সংগঠন গুলোর আহ্বায়ক হচ্ছে, সূরা ফাতিহা শুদ্ধ পড়তে না জানা ব্যক্তি হচ্ছেন ফোরকানিয়া মাদ্রাসার সেক্রেটারি আবার মাসিক ও বার্ষিক মুসল্লিই মসজিদ কমিটির সভাপতি মনোনীত। ফলে সমাজের সচেতন ও শিক্ষিত মানুষ গুলো সমাজ বিমুখ হয়ে পড়ছেন। দু’চারজন সমাজপ্রেমি মানুষ বিষয় গুলো নিয়ে কথা বলতে গেলেও হুমকি-ধমকি ও মামলার স্বীকার হচ্ছেন। কি এক করুণ দৃশ্য। কি নিদারুণ কথা। জবাবদিহিতার বালাই নেই কোথাও। ধুয়ে-মুছে যাচ্ছে সামাজিকতা। গ্রামগুলো হারাচ্ছে ইতিহাস ঐতিহ্য।
কিন্তু না। এভাবে চলতে দেওয়া যায় না। ঘুরে দাড়াতে হবে সচেতন যুব সমাজকে। রুখে দিতে হবে অপরাজনীতিকে। সংস্কার করতে হবে সমাজ ব্যবস্থাকে। প্রয়োজনে বিপ্লবের ডাক দিতে হবে। যুবকরাই পারে গুনে ধরা সমাজকে সোনায় সোহাগায় পরিণত করতে। যুবকরা হচ্ছে সমাজের সবচেয়ে কর্মক্ষম অংশ। পরিবর্তনের জন্য যে শক্তি ও ক্ষমতা প্রয়োজন তা একমাত্র যুবকরাই সরবরাহ করতে পারে। ভাঙ্গা গড়ার আঘাত হজম করার সামর্থ্য শুধু তরুনদেরই আছে। সামাজিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন তরুণদের দ্বারাই সম্ভব। দুনিয়ার যে কোন আন্দোলন সংগ্রামের মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে তরুণ সম্প্রদায়। যুবকগন তাদের সাহসী আচরণ দিয়ে সমাজ পরিবর্তন করতে পারে। পবিত্র কালামে পাকে সূরা কাহাফের ৩-১৪ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন যুবকগন সত্যের প্রতি নিবেদিত এবং তারা তাদের রবের প্রতি বিশ্বস্থ। তাদের প্রতি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা তত্ত্বাবধান বাড়িয়ে দেন, তাদের হৃদয়ে শক্তি দান করেন।
যুব সমাজের শক্তি, সাহস, বুদ্ধি ও মেধা পুরোপুরি ব্যবহার করা গেলে সমাজ উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবে। তারা দেশের সমস্যা চিহ্নিত করে এবং সমাধান ও করতে পারে। তারা দেশের শিশুদের অধিকার সম্পর্কে শিক্ষা দিতে পারে। অপর যুবকদের প্রেষণা দিতে পারে। ভিন্ন চিন্তা করা ও উদ্ভাবনের সাহস, অসম্ভবকে সম্ভব , অগম্য পথে গমন করার সাহস, যন্ত্রনা দূর করা,সামাজিকতার স্বার্থে প্রতিকূল পরিবেশের বিপরীতে হাঁটা ও জ্ঞানকে শেয়ার করার সাহস অদ্ধিতীয়ভাবে শুধু যুব সমাজেরই আছে। যুবকদের পৃথিবী হবে দারিদ্র, অসাম্য, শোষন ও প্রতারণা মুক্ত। সেখানে বর্ণ, ধর্ম, জাতি, ভাষা, লিঙ্গভেদে কোন বৈষম্য থাকতে পারবেনা। তারা পরিবর্তনের অভিভাবক হতে পারে এবং দ্বন্ধ নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। ধারনার বাধা কর্তন, ঝুঁকি গ্রহণের মানসিকতা, প্রযুক্তিগত জ্ঞান, ঐকান্তিকতা ইত্যাদি দিয়ে যুবকগন তাৎপর্যপূর্ণ ভুমিকা রাখতে পারে। সুতরাং সিদ্ধান্তগ্রহন প্রক্রিয়ায় যুবকদের অংশ গ্রহন না হলেই নয়।
অতএব সমাজকে পরিশীলিত করতে চাইলে, এগিয়ে নিতে হলে, চ্যালেঞ্জে উত্তীর্ণ হতে হলে, উন্নয়নের পথে হাঁটতে চাইলে, অচলায়তন ভাঙ্গতে গেলে, জাতিকে স্বপ্ন দেখাতে চাইলে, সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজনে যুবকদের কাজে লাগাতে হবে।যুবকদের এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক,
মুহাম্মদ ইয়াসিন আরাফাত ত্বোহা
কলামিষ্ট ও সোশ্যাল এক্টিভিস্ট