দশ টাকা দান
ষাটোর্ধ বৃদ্ধ জীর্ণশীর্ণ শরীর নিয়ে চলন্ত ট্রেনের ভিতরে এক বগি থেকে আরেক বগিতে হাটতেছে আর কান্নাকণ্ঠে বলতেছে, চারই আনা দাও! আমি না খেয়ে আছি! টাকা দিতে বিলম্ব হলে বৃদ্ধ ব্যক্তিটি তাড়াহুড়ো করে যাত্রীদের পা ধরিয়ে আবার চিৎকার করে বলতেছে, দাও বাবা রে, দাও আমাকে চার আনা! এ যুগে চার আনা মানুষ কোথায় পাবে। তাই কেউ ৫ টাকা, কেউ ১০ টাকা দিয়ে বৃদ্ধকে দিয়ে বিদায় জানাচ্ছে।
জয়পুরহাট থেকে ছুটে আসা বরেন্দ্র এক্সপ্রেস ট্রেনটি পার্বতীপুর রেলওয়ে স্টেশনে আধা ঘণ্টা জন্য যাত্রা বিরতি দিয়েছে। এ বিরতির জন্য পথের মানুষ পথেই ছুটছে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে। কত শত মানুষের কাছে হাত পাতিয়ে যাচ্ছে। এদের মধ্যে এক বৃদ্ধার দেখা যায় 'ছ' বগির বাষট্টি নম্বর আসনে অর্থাৎ মাঝ বরাবর জানালার পাশে চার হাত পাতিয়ে আছেন।
বৃদ্ধার সাথে তার প্রতিবন্ধী শিশুটাও হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সেও টাকা চায়। এ জগৎ-সংসারে সবার মত সেও বাঁচতে চায়। ফেব্রুয়ারি মাসের ১৬ তারিখ তবুও জেঁকে বসেছে শীত। কাঁপছে থরথর। বৃদ্ধার সাথে প্রতিবন্ধী শিশুও কাঁপছে। দাও বারে ক'টাকা? শিশু সন্তান নিয়ে না খেয়ে আছি। এ কথা বলে চলে যাচ্ছেন বৃদ্ধা। এই যে শোনো বাহে চাচি? চিল্লায় উঠে শরিফুল। যাত্রী শরিফুল একজন কামলা মানে দিনমজুর। তিনি আক্কেলপুরে গেছেন কামলা দিতে। কিছু ক্ষেত্রে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শান্তিপ্রিয় মানুষ যদি খোঁজা দেয় তাহলে উত্তরবঙ্গের নীলফামারি জেলার মানুষের মধ্যে শান্তশিষ্ট মানুষ পাওয়া যাবে। এ অঞ্চলের মানুষের আছে মায়া, মমতা ও ভালোবাসা।
দরদী শরিফুল তার পকটে থেকে বিশ টাকা বের করে বৃদ্ধাকে বলল, বাহে! চাচি এখান থেকে দশ টাকা নেন আর আমাকে দশ টাকা দেন। অভাগী বৃদ্ধা দশ টাকা নিয়ে খুশি হয়ে। পরের যাত্রীর কাছে হাত আবার পাতায়। ভিক্ষুকের ভিক্ষা করা তো স্বভাব। তো বৃদ্ধার আর কোনো খোঁজ মেলে না। তবে খোঁজ মেলে শরিফুলের দান করার আত্মতৃপ্তি দেখে।
ঘটনা রহস্য তৈরী হয় তাকে ঘিরে। শরিফুল ট্রেনের ভিতরে চিল্লাতে চিল্লাতে তার নিকট আত্মীয় স্বজনের বলতেছে, আমি দশ টাকা আল্লার রাস্তায় দিলাম।
এই যে বাদাম বেচা আয় এদিক আয়। আমার পকেটে দশ টাকা আছে আর! বিশ টাকা ছিল আল্লার রাস্তায় দিলাম। তুইও দশ টাকা নে। আর বাদাম দাও। সবাই মিলে খাই। আরে হরি দাদা তুই দশ টাকা ভিক্ষা দে। ভিক্ষা দিলে স্বর্গে যেতে পারবি! হরি তার মাথার কপালে দুভাজ দিয়ে বসে আছেন। ভাবছে রাত ১১ টা বেজে গেল! কখন বাড়ি যাব? অপরচিত এক ব্যক্তি বলতেছে শরিফুল ভাই শুনেন। আপনি কোথায় যাবেন?
শরিফুল বলল ডোমারে যাব ভাই।
অপরিচিত ব্যক্তি বলল, মনে কিছু না করলে একটা প্রশ্ন করতে পারি? শরিফুল বলল, আপনি চিৎকার করে বেড়াচ্ছেন একটু আগে আল্লাহর রাস্তায় দশ টাকা দিলেন। সেই আল্লাহর রাস্তা এত কঠিন কেন ভাই?
শরিফুল বলল, কেন ভাই কি হয়েছে? অপরচিত ব্যক্তি বলল, হরি দা কে স্বর্গের পথ দেখালেন। আর বললেও বৃদ্ধা যে পথে আছে সেটা কি আল্লাহর রাস্তা। তাহলে বৃদ্ধা মহিলার মত আপনি ওভাবে ভিক্ষার থলে নিয়ে বেড়াতে পারবেন?
হতভম্ব হয়ে শরিফুল তাকিয়ে আছে! শরিফুল বলল- যুবক বয়সে শরীরে পর্যাপ্ত শক্তি আছে। প্রতিদিন কাজকাম করে খেতে পাই। আমি কেন সে পথে যাব।
তাহলে একটু আগে তো হরিদাকে বললেন বৃদ্ধাকে দশ টাকা দিয়ে স্বর্গে যেতে? শরিফুল বলল, স্বর্গের তো সুখ আর শান্তির জায়গা। অপরিচিত ব্যক্তি বলল, আল্লাহর রাস্তা কেমন? ক্ষানিকটা চুপ করে শরিফুল উত্তর দিল সে জায়গা চির সুখের জায়গায়।
ডিএসএস/