শিক্ষক রাজনীতি চান না ডিসিরা, আমরাও কি চেয়েছি!
শোনা যাচ্ছে এখন শিক্ষক রাজনীতি চান না ডিসিরা! আমরাও কি চেয়েছি কখনো? স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করে দেশের সুশীল সমাজের কেউই সেটা চাননি, আমরাও চাইনি। কিন্তু এই চিৎকার এতোদিন সাধারণের হলেও অতি সম্প্রতি সরকারের আমলাদের মধ্য থেকেই আসা এমন প্রস্তাব ওঠায় আশান্বিত হচ্ছি আমরা।
শোনা যাচ্ছে আসছে ২৪ থেকে ২৬ জানুয়ারি ৬৪ জেলার ডিসিদের নিয়ে অনুষ্ঠিত ডিসি সম্মেলনে এই প্রস্তাব তোলা হবে। বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদরাসা কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের রাজনীতির বাইরে রাখার জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব দিয়েছে ডিসিরা। এজন্য সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালার মত পৃথক সুনির্দিষ্ট বিধিমালা প্রণয়নের প্রস্তাব করা হয়েছে আসন্ন ডিসি সম্মেলনকে সামনে রেখে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাধ্যমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে দেওয়া হয়েছে এই প্রস্তাব।
প্রস্তাবটি নিয়ে ২৪ জানুয়ারি বিকালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ডিসিদের যে সেশন রয়েছে সেখানে আলোচনা হবে এতে শিক্ষামন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত থাকবেন। বেসরকারি শিক্ষকদের রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে এই প্রস্তাবটি পাশ হলে তা স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে হবে একটি যুগান্তকারী ঘোষণা।
প্রান্তিক পর্যায়ে শিক্ষকদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার ক্ষতিকর দিক বিবেচনা করে এই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে। গবেষণায় প্রমাণিত— যে শিক্ষকদের রাজনৈতিক চর্চা শিক্ষার মানের ক্ষেত্রেই ক্ষতিকর প্রভাব পড়েনি সার্বিক পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করে তোলে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক পরিচয় থাকায় সহকারী শিক্ষকের তকমা নিয়ে প্রধান শিক্ষককে হুমকি ধামকিতে তটস্থ রাখতে অপচেষ্টা চালান ফলশ্রুতিতে ব্যাহত হয় স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম।
শুধু রাজনীতি নয়, এই প্রস্তাবে শিক্ষকদের শুধু শিক্ষকতা ছাড়াও ঠিকাদারি, সাংবাদিকতা, ব্যবসাসহ শিক্ষা কার্যক্রম বহির্ভূত সব কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। ফলে শৃঙ্খলার উন্নতি হয়ে শিক্ষকরা পাঠদানে আরও বেশি মনোযোগী হতে পারবে। এতে শিক্ষকতার মান বাড়ার পাশাপাশি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে সার্বিক শিক্ষা কার্যক্রমে।
শিক্ষকতা মানুষ গড়ার পেশা। তাই রাজনীতি করার ক্ষেত্রেও তাদের দায়িত্ব অপরিসীম। বিশ্বের অনেক দেশেই ডাকসাইটে শিক্ষকরা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত সেখানে সুফল ও মিলেছে কিন্তু উল্টো ঘটেছে বাংলাদেশের বেলায়। এখানে শিক্ষকদের শিক্ষক পরিচয়টাই গৌণ। মুখ্য পরিচয় সে ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, উদ্যোক্তা, দোকান মালিক কৃষিজীবী ইত্যাদি। তাদের যুক্তিও ফেলনা নয়। কম বেতনে বাড়তি আয়ের সুযোগ তারা হাতছাড়া করবে কেন।
সরকারি বেসরকারি বৈষম্য জিইয়ে রেখে, শিক্ষকদের আর্থিক প্রসঙ্গটি আমলে না নিয়ে, বেতন বাড়ার প্রসঙ্গটি কৌশলে এড়িয়ে তাদের আচরণ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা কতটুকু সফল হবে সেটা সময় বলবে। এক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করে বৈষম্য হ্রাস ও বেতন বৃদ্ধির পরিকল্পনার টেকসই পরিবর্তন আনবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। তবে কথা সত্য যে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের উত্থান পর্বে ব্যাপকহারে রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে শিক্ষক হয়েছেন লাখ লাখ রাজনৈতিক কর্মী। স্বজনপ্রীতি ও রাজনীতিকরণের এমন নজির দেশের ইতিহাসে বিরল। এতে শুধু শিক্ষাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশ ও আমাদের ভবিষ্যৎ। আমাদের স্টেক হোল্ডাররা। যারা স্থানীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত ওই সব স্কুলের সেবাগ্রহিতা। হোটেল মালিক নিশ্চয় নিজের হোটেলে রান্না খান না। বেসরকারি স্কুল শিক্ষকের ছেলে নিশ্চয়ই সেখানে কমই পড়েন, মন্ত্রীর ছেলে যেভাবে পড়েন বিদেশে।
আমাদের দেশের তথাকথিত শিক্ষক রাজনীতি ও ছাত্র রাজনীতির কারণে ক্ষতি হয়েছে শিক্ষার, সেই তুলনায় বাড়েনি রাজনীতির মান কিন্তু উদ্দেশ্য সেদিকেই ছিল বলে নীতি নির্ধারকরা মনে করেন। স্থানীয় রাজনীতি আর মাসলস পাওয়ার ব্যবহার করে নিয়োগ পাওয়া দেশের বৃহৎ অংশের শিক্ষক সমাজ বলবেন কী— শিক্ষায় তাদের অবদান কতটুকু? শিক্ষকতার মতো মহান ব্রতকে পেশায় পরিণত করার পরিণতি রাষ্ট্র খুব তাড়াতাড়িই টের পাবে। শিক্ষাকে অবহেলা করে পৃথিবীর কোনো দেশ এগিয়ে যেতে পারেনি সেখানে বাংলাদেশেরও কোনো বিকল্প আছে বলে আমরা অন্তত মনে করি না। ঠিক একই কথা অ্যারিষ্টোটল আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে বুঝলেও আমরা কেন তা বুঝলাম আজ বিষয়টি প্রশ্নাতীত।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধ হোক এটা আমাদের সুযোগ্য জেলা প্রশাসকরা আজ বোঝেন, আমজনতা বুঝেছে আগেই। শুধু শিক্ষক রাজনীতি নয় ২৪ ঘণ্টা শিক্ষা চ্যানেল চালু করাসহ শিক্ষা সংস্কারের জন্য আরও নয়টি প্রস্তাব মন্ত্রণালয়েপাস হওয়ার অপেক্ষায় আছে বলে জানা গেছে। নতুন সিলেবাসে পুরনো বই ও শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের নামে সব অপরাজনীতি রুখে আবারও মাথা তুলে দাঁড়াবে বাংলাদেশ। আমাদের যাত্রা এমন সম্ভাবনাময় আগামীর দিকে।
হাসিবুল হাসান: প্রাবন্ধিক, গল্পকার ও শিক্ষা গবেষক
আরএ/