জীবনের মূল্যবোধ
মূল্যবোধ এমন একটি জিনিস যা কখনো নিজের মধ্যে পোষণ না করে অন্যের কাছে আশা না করা ঠিক নয়। মানবিক আচরণ সমৃদ্ধ করার সুষ্ঠু নীতি ও মানদণ্ডই হচ্ছে মূল্যবোধ। এ মূল্যবোধ শব্দটা মানুষকে সমাজ জীবনে মর্যাদাবান হতে উদ্বুদ্ধ ও সহায়তা করে থাকে। যে চিন্তা চেতনা, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য মানুষের মানবিক আচরণ, ব্যবহার ও কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রিত করে তাই মানবিক মূল্যবোধ। অবক্ষয় ও অস্থিতিশীলতা প্রায়শই মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টির পথে শত বাধা হয়ে বিরাজ করে। মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ফলে সমাজে নিষ্ঠুর অমানবিক কাজগুলো ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে।
জীবন-অস্তিত্ব বা বেঁচে থাকাটা জীবনের মূল্যবোধ বোঝার আগে আসছে। জীবনের প্রথম চাহিদা, প্রথম ও আদি তাগিদ হলো, ‘জীবিকা’। স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে, যে কোনো প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের প্রাথমিক অধিকার বা Fundamental right হলো, নিজের খাওয়া-পরার সংস্থান নিজে করা। এর পরই আসবে self-esteem বা স্বাভিমান। ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও স্বাভিমান বা আত্মমর্যাদা, এই দুটি শক্ত শিকড়ের বুনিয়াদে গড়ে ওঠে জীবনের মূল্যবোধ এবং সারা জীবন আমরা প্রতি পদে পদে জীবনের মূল্যবোধ উপলব্ধি করতে থাকি। জীবনের চাহিদা ভিন্ন ভিন্ন মানুষের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন। কেউ চায় অর্থ, কেউ চায় জ্ঞান, কেউ চায় ভক্তি, কেউ চায় প্রেম, কেউ চায় ক্ষমতা, কেউ চায় যশ ইত্যাদি। এবং এই উচ্চাকাঙ্ক্ষার কোনো নির্দিষ্ট সীমারেখা টানা যায় না। কথায় বলে বটে, ‘অতি বাড় বেড় না, ঝরে পড়ে যাবে’—কিন্তু আমার যদি বুদ্ধি থাকে, শক্তি থাকে, দক্ষতা থাকে, তবে আমি ঝড়কে উপেক্ষা করতে পারি। আমার ক্ষমতা ও আত্মবিশ্বাস থাকলে কেন বাড় বাড়ব না? আকাঙ্ক্ষা গগণচুম্বী হবে না সীমারেখা মেনে চলবে, তা সবটাই নির্ভর করে ব্যক্তিবিশেষের চারিত্রিক দৃঢ়তার ওপর। আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না, আমরা আড়ম্বর করি, কাজ করি না, যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না, যা বিশ্বাস করি তা পালন করি না’। আবার আমাদের সমাজে অনেককে দেখা যায় আত্মপ্রশংসায় পঞ্চমুখ। তারা নিজেকে বড় বলে প্রচার করে এবং নিজের কর্মকীর্তি নিজেই প্রচার করতে অভ্যস্ত। আপনার কাজ আপনি করে যান নীরবে নিবৃত্তে। সাফল্য, সুনাম, যশ, খ্যাতি অমূল্য ভূষণ হয়ে আপনার চারিত্রিক মাধুর্যকে স্বমহিমায় ফুটিয়ে তুলবে। আত্মতুষ্টি থাকা ভালো, তবে আত্মপ্রশংসা এক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। আপনার মহৎ কাজের স্বীকৃতি প্রশংসার বাণী নিয়ে আপনার মাথায় মুকুট হয়ে শোভা বর্ধন করবে।
প্রাথমিক ধারণায় জীবনের মূল্যবোধকে আমরা সবাই সম্মান করি Universal moral values-এর যে সম্পর্কে তাবৎ বিশ্ববাসী সহমত। সেই নৈতিক গুণাবলী হলো— সততা, বিশ্বাস, প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা, ধৈর্য, শ্রদ্ধা, সহমর্মিতা, শ্রম, সত্যানুরক্তি, কর্তব্যপরায়ণতা, কৃতজ্ঞতা ইত্যাদি।
যাদের মধ্যে এই মানবিক গুণগুলির অভাব দেখা যায় তারা anti-social elements চোর-ডাকাত-খুনি প্রতারক-নিপীড়ক ইত্যাদি। কিন্তু এর মধ্যেও একটা ভাববার কথা আছে। ডাকাতে-পুলিশে হয়ত সমবেদনা-সহানুভূতির সম্পর্ক নেই। কিন্তু চোর-ডাকাতের নিজেদের গোষ্ঠীতে হয়ত তারা জীবনের মূল্যবোধের পরিচয় দেয়। এদের জীবনের মূল্যবোধ সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে। সংসার জীবনে এক ডাকাত হয়ত স্নেহময় পিতা বা দায়িত্বশীল পুত্র এবং প্রেমময় স্বামীর ভূমিকা পালন করছে।
কর্মক্ষেত্রে ‘স্বজন-পোষণ’ নীতিতেও জীবনের মূল্যবোধ বিঘ্নিত হয়। যেমন, আমি আমার বোনপো বা ভাগ্নিকে খুব স্নেহ করি। আমার অফিসে তার কাজের ব্যবস্থা করে দিলাম। নিজের স্নেহ-ভালবাসাকে সম্মান দিলাম ঠিকই কিন্তু এর জন্য হয়ত এক যোগ্যতর প্রার্থীকে বঞ্চিত করলাম। জীবনের মূল্যবোধ লজ্জিত হলো।
মূল্যবোধ অহরহ পিষ্ট হয় আমাদের দৈনন্দিন জীবনে। অ্যাম্বুলেন্স-কর্মী মুমূর্ষু শিশুর নাক থেকে অক্সিজেনের নল খুলে নিল। কারণ সিলিন্ডারটি অ্যাম্বুলেন্স কর্তৃপক্ষের। হাসপাতালের শয্যা পর্যন্ত নাকে অক্সিজেনের নল রইল না। তার আশঙ্কা, যদি সিলিন্ডারটি খোয়া যায়। ফলতঃ শিশুর মৃত্যু। কিন্তু একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, নিজের সন্তানের ক্ষেত্রে কিন্তু কর্মীটি এমন অবিবেচনা কাজ কখনোই করত না। অর্থাৎ সেই আপন-পর বিভেদ, স্বার্থপরতা। দ্বেষ-হিংসা-স্বার্থপরতা সব সময়ে জীবনের মূল্যবোধের অন্তরায়। মাদার টেরেসা পথ শিশুকে বুকে তুলে নিতেন। এই হলো জীবনের মূল্যবোধের সার্থকতা।
জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় দাম্পত্য, এমন এক সম্পর্ক, যাতে রক্তের সম্পর্ক নেই। অথচ সারা জীবন একসাথে পথ চলার শপথ। জীবনের মূল্যবোধে নিবিড়তম যোজনা হলো দাম্পত্যের দাবি। অত্যন্ত সংকটময় পরিস্থিতি। দুটি পৃথক সত্তার জীবনের মূল্যবোধ ভিন্ন-ভিন্ন। অতএব দ্বৈত পথ চলায় সংঘাতের সম্ভাবনা থাকবেই। সে অন্য প্রসঙ্গ।
‘তুমি-আমি দুজন প্রিয়, তুমি-আমি দুজন’ এর বৃত্তে যখন যখন সন্তান এর আবির্ভাব ঘটে, তখন পিতা-মাতার জীবনের মূল্যবোধের বৃত্তে, সন্তান থাকে কেন্দ্রে। বিশেষ করে নতুন মায়ের জীবনের মূল্যবোধে সন্তানই মুখ্য, বাকি সবকিছু গৌণ! জীবনের একটি অধ্যায় একেক ধরনের আবেগ-অনুভূতি প্রাধান্য পায়।
দায়িত্ব-কর্তব্যের সারা জীবন বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আমরা জীবনের মূল্যবোধের চর্চা করি। যখনই দায়িত্ব-কর্তব্যে অবহেলা হয়, তখনই জীবনের মূল্যবোধ ক্ষুণ্ন হয়। নবীন প্রজন্মের জীবনের মূল্যবোধ নিয়ে সমাজের প্রভূত আক্ষেপ। প্রবীণের অভিযোগ, তাদের ঔদ্ধত্য ও বেপরোয়া প্রকৃতি। কিন্তু প্রবীণ প্রজন্ম যদি পিছু ফিরে তাকায়, তবে মনে পড়বে, তাদের কৈশোরে-যৌবনে তারাও গুরুজনদের কাছ থেকে একই অভিযোগ শুনতেন। প্রবীণ প্রজন্মের জীবনের মূল্যবোধ ছিল পরিবার ভিত্তিক। বর্তমান প্রজন্মের মূল্যবোধ আত্মকেন্দ্রিক।
সুখ-শান্তি নয়, জয়ই কাম্য, এটা বর্তমান প্রজন্মের দাবি' কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘নর দিল ক্ষুধা, নারী দিল সুধা’। বর্তমান প্রজন্মের মূল্যবোধ বলছে, ‘ক্ষুধা নারীরও আছে এবং সুধা পুরুষেরও তরফেও বর্ষিত হওয়া চাই। জীবনের মূল্যবোধে নারী-পুরুষের ভূমিকা পৃথক-পৃথক নয় মোটেই।’
কেরিয়ার-ক্ষুধা- হচ্ছে নবীন প্রজন্মের নিশানাযুক্ত মূল্যবোধ। ‘আমার জীবন আমার’ এই জীবনবোধ কিন্তু শেষ কথা নয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তৈরি করার দায়িত্ব কিন্তু নবীন প্রজন্মের। প্রবল আত্মবিশ্বাস, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, উচ্চশিক্ষা অবশ্যই জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করবে। কিন্তু মানুষ তো একা নয়, সভ্যতাকে এগিয়ে নিতে হলে একক উন্নতি কোনো কাজে আসে না। 'আমি ব্যক্তিগত উন্নতি নিয়ে এমনি মত রইলাম, সন্তানকে কোয়ালিটি টাইম টুকুও দিলাম না। সে গোল্লায় গেল, তখন ব্যক্তিগত সাফল্য-ব্যর্থতার নামান্তর। ব্যক্তিগত সাফল্য সম্পূর্ণ মূল্যহীন যদি না তা পরবর্তী প্রজন্মকে উচ্চতর আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।
একটি মাত্র জীবন আর এই জীবনের মূল্যবোধ সর্বজনীন-সর্বকালীন, তার অদল-বদল হয় না। যুগে-যুগে বংশ পরম্পরায় দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টায়। ধ্যান-ধারণার রকমফের ঘটে। কিন্তু মূল কাঠামোটি অর্থাৎ Universal Moral Values অটুট থাকে। সর্বাঙ্গসুন্দর জীবন গড়ে ওঠে ব্যক্তিসত্তার সার্থক বিকাশে। আর জীবনের মূল্যবোধকে যদি এক বাক্যে প্রকাশ করি, তবে বলতে হয়, ‘সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’।
আরএ/