কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের স্মরণে…
আজ ৪ জানুয়ারি কথাশিল্পের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস স্যারের ২৬তম প্রয়াণ দিবস। আমার ভাগ্য যে স্যারের একজন ছাত্র ছিলাম। ১৯৯৫ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা কলেজে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হওয়ার ফলে স্যারের সাথে আমার অন্যরকম পরিচয় ঘটে যায়। স্যার তখন আমাদের পড়াতেন মাইকেল মধুসূদন এর মেঘনাবধ কাব্য।
ভর্তির পর আমি প্রায় এক বছর ঠিকমত ক্লাসে উপস্থিত ছিলাম না। একদিন স্যারের ক্লাসে (১৯৯৬) উপস্থিত হলে— তিনি খাতা নিয়ে নাম ডাকতেন। রোল ২৩ ডাকতেই আমি উঠে জ্বীর স্যার বলতেই স্যার আমার দিকে তাকিয়ে আবার খাতার দিকে দেখেন, পরপর কয়েকটি পৃষ্ঠা উল্টিয়ে দেখে বললেন, তুমি এক বছর ক্লাসে আস না। সামনেই পরীক্ষা। তুমি পাস করতে পারবে না। যাও বেরিয়ে যাও। রিএডমিশন নিও।
কোনো কথা না বলে আমি ক্লাস থেকে ৬৩ জনের সামনে বের হয়ে আসি। এসে নিজেকে এতো ছোট মনে হলো যে , আর কলেজে পড়া হবে না আমার। একবার মনে হলো দোতলা থেকে লাফ দিয়ে পড়ে যাই। এতো ছেলেদের সামনে কেমন করে বের করে দিলেন!
এদিক-সেদিক পাঁয়চারি করছি। কি করব? বিভাগের পিওন আমাকে বললেন, মামা ঘাবড়াবেন না, স্যার খুব ভাল মানুষ। ক্লাস শেষ হলে স্যার যখন চেম্বারে ফ্রেশ হয়ে বসেন, যখন পাইপ ধরিয়ে টান মারবেন তার কিছুক্ষণ বাদে যেয়ে বলবেন, সার আমি অসুস্থ ছিলাম।
মিথ্যা কথা বলতে হবে ভেবে সাহস করে রিহার্সেল করে নিচ্ছি বারবার। সময় পার হয় না। এক সময় স্যার ক্লাস থেকে বেরিয়ে সোজা নিজের চেম্বারে চলে গেলেন । বাথরুমে যেয়ে হাতমুখ ধুয়ে চেয়ারে বসেন। পানি পান করে পাইপ ধরিয়ে টানছেন। আমি যাব কি যাবো না! পর্দার আড়াল থেকে দেখছি এক পা এগুই তো কয়েক-পা পিছিয়ে যাই। এরকম করতে করতে একসময় ঢুকে গেলাম।
স্যার আমায় দেখে বললেন, কি খবর, কি চাই? আমি বললাম, স্যার আমি তো অসুস্থ ছিলাম অনেকদিন সেকারণে ক্লাস করতে পারিনি।
স্যার বললেন, ক্লাস করোনি সামনেই ফাইনাল! পাস করতে পারবে নাতো! ক্লাসের সারের স্বর আর তখনকার নরম স্বর এক্কেবারে আলাদা।
মুহূর্তেই ভাললাগার বারীন্দ্র ছড়িয়ে যেতে থাকে আমার মনের মধ্যে। চুপচাপ থাকার পর বললেন, বাড়ি কোথায়? আমি বললাম কুষ্টিয়ায়? কুষ্টিয়ায় কোথায়?
বললাম কুমারখালী।
তখন স্যার পাইপের ধোয়া ছেড়ে আবার বললেন, মিলি রহমানকে চেনো?
আমি স্যারের কথার রেশ টেনেই বললাম, চিনি স্যার। উনিও আমাকে চেনেন।
স্যার আবার প্রশ্ন করেন, কীভাবে?
বললাম স্যার, উনি লেখালেখি করেন আমিও করি।
স্যার পাইপের ধোয়ার আড়ালে মুচকি হেসে বললেন, কি লেখো?
বললাম কবিতা।
স্যার বললেন, কাছে আছে?
তখনতো মানিবাগে টাকার বদলে জায়গা করে নিতো বেশ কিছু কবিতা (যা আদৌ কখনো কবিতা হয়নি বোধ হয়। তবু থাকত সযত্নে)। সঙ্গে সঙ্গে পকেটের মানিবাগ থেকে বড় সাইজের একটা কবিতা বের করি।
স্যার বললেন পড়ো।
কাঁপা কাঁপা গলায় স্বর বা সুর বের হয়ে আসতে চায় না। তবুও পড়লাম একটি কবিতা।
ওতোবড়ো মানুষের সামনে কাঁচা লেখার এক পদ্য পড়ে সেদিন পার পেয়েছিলাম সত্যিই!
স্যার এই কবিতা শুনার পর বললেন, যাও ক্লাসে আর কখনো ফাঁকি দেবে না। কবিতা লিখতে হলে তো একাডেমিক যোগ্যতাও থাকা দরকার! না হলে তোমার কথা মানুষ মানবে কেনো?
সেই থেকে স্যারের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আর কোনো ক্লাসে উপস্থিত হই বা না হই আর কেউ আমাকে কিছু বলতো না।
পুরো ক্লাসে শুধুই আমিই যা টুকটাক লেখালেখি করি। সেটা চাউরে গেল বলে সবকিছুতেই পার।
স্যারের অল্পদিনের ভালবাসা আমাকে বিদ্যুৎ বেগে টানতে থাকে। স্যারের সাথে আমার কাঙাল হরিনাথের ‘বিজয় বসন্ত’ উপন্যাস নিয়ে কথা হয়েছিল।
আমি বলেছিলাম,
স্যার, 'আলালের ঘরের দুলাল' নয় ‘বিজয় বসন্ত’ই বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস।
স্যার বলেছিলেন কি প্রমাণ আছে তোমার কাছে?
আমি বললাম আছে স্যার।
স্যার বলেছিলেন, নিয়ে এসো।
এরপর কাঙাল বংশধরদের কাছে কতোবার ধরনা দিয়েও পাইনি বলে স্যারের কাছে উপস্থাপন করতে পারিনি।
সেদিন যদি পারতাম তাহলে স্যার এটা নিশ্চিতভাবে লেখালেখি করে রেকর্ডটা করাতে পারতেন।
তখনো বুঝিনি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস স্যার কত বড় মাপের, কত বড় গুণী লেখক!
মৃত্যুর পর বুঝেছি। স্যার কে নিয়ে লেখা ‘গড়াইপাড়ের কবিতা (২০০১) সংকলিত কাব্যগ্রন্থে— ‘সাদা কফিনে ইলিয়াস স্যার’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলাম। সেই সান্ত্বনা!
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ১৯৪৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি গোটিয়া জেলার গাইবান্ধা গ্রামে মামা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক বাড়ি বগুড়া জেলায়। ম্যাট্রিক পাস করেন বগুড়া জিলা স্কুল থেকে (১৯৫৮) এবং ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন ঢাকা কলেজ থেকে (১৯৬০)।
এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্স ও মাস্টার্স পাস করেন (১৯৬৪)। তার কর্মজীবন শুরু হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক পদে যোগদানের মাধ্যমে। পরবর্তীতে ঢাকা কলেজের বাংলার প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৭ সালের ৪ জানুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পুরস্কার পেয়েছেন অনেকগুলো। উল্লেখযোগ্য হলো— বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৩) এবং একুশে পদক (মরণোত্তর) (১৯৯৯)।
রাজনীতি আমাদের জীবনের একটি প্রধান নিয়ামক হলেও আমাদের সাহিত্যে সরাসরি রাজনৈতিক প্রসঙ্গিক প্রসঙ্গ ব্যাপকভাবে বিবেচিত হয়নি। রাজনীতির সঙ্গে লেখকরা সবসময়ই নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেছেন। ইলিয়াসই প্রথম এতটা সার্থক শিল্পসম্মতভাবে প্রধান দুটি আন্দোলনকে তার দুই উপন্যাসে ধারণ করলেন। চিলেকাঠার সেপাই উপন্যাসে তিনি উপজীব্য করেছেন এ দেশের রাজনীতির পাকিস্তান পর্বের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আন্দোলন ঊনসত্তরের গণআন্দোলনকে। এটি অবলম্বনে পরবর্তীতে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। তার শেষ ও শ্রেষ্ঠ উপন্যাস খোয়াবনামার মূল প্রসঙ্গ বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের একটি জনপদে পাকিস্তান আন্দোলনের প্রভাব। এই উপন্যাসের জন্য তিনি পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার।
মাত্র ২৮ টা গল্প, অল্প কিছু প্রবন্ধ আর ২টি উপন্যাস, সাকুল্যে এই আমাদের সম্পদ। কিন্তু অল্প সংখ্যক লেখা দিয়েই তিনি নিজের স্টাইল দাঁড় করে ফেলেছেন। যে কারণে স্যারের লেখা পড়েই আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না এটা কার লেখা।
সমগ্র বাংলাসাহিত্যেরই একজন অগ্রগণ্য কথাসাহিত্যিক তিনি। তিনি কখনোই লেখার সংখ্যা বৃদ্ধিতে মনোযোগী ছিলেন না। ভিন্ন আঙ্গিক ও প্রকরণে মনোযোগী এ লেখক তাই খুব বেশি লেখেননি জীবনে। কিন্তু যা লিখেছেন শিল্প-বিচারে তা এখনো বিশ্বমানের, এমনটিই মনে করেন সাহিত্যের বিদগ্ধ সমালোচকরা।
প্রখ্যাত সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী বলেছেন, ‘কি পশ্চিম বাংলা, কি বাংলাদেশ সবটা মেলালে তিনি শ্রেষ্ঠ লেখক।’ লিখেছেন, ‘ইলিয়াস-এর পায়ের নখের তুল্য কিছু লিখতে পারলে আমি ধন্য হতাম।’
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বাংলাদেশি কথাসাহিত্যিক। একজন স্বল্পপ্রজ লেখক। দু’টি মাত্র উপন্যাস - চিলেকোঠার সেপাই (১৯৮৭) ও খোয়াবনামা (১৯৯৬) বাংলা সাহিত্যে তার অক্ষয় আসনটি নির্মাণ করে দিয়েছে।
আরএ/