স্মৃতি কথা
হ্যালো, আঙ্কেল শুনছেন?
লোকটি পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখলো একটি মেয়ে তাকে ডাকছে। পেছনে ফিরে বললো, জ্বী বলুন।
মেয়েটি অনেকটা রাগী চেহারায় বললো আপনাকে অনেকক্ষণ ধরে ডাকছি। শোনেন না কেন?
লোকটি বললো আসলে খেয়াল করিনি। নিজ মনে হাটছি তো তাই।
লোকটির পরিচয় তার নাম রাকেশ। বয়স পঞ্চাশের কোটায়। ক'দিন ধরেই শারীরিক দুর্বলতায় ভুগছেন তিনি। কিছু খেতে পারছেন না। খেতে গেলেই অরুচি আসে। অন্যদিকে শ্বাসকষ্ট রোগটাও অযাচিতভাবে বেড়ে গেছে। রাকেশের এই রোগগুলো অনেক আগে থেকেই ছিল। তখন নিয়ন্ত্রণেই ছিল। এখন বয়সটাও বেড়েছে আর রোগগুলো প্রতিকারে রাকেশ খুব বেখেয়ালি হয়ে উঠছে।
রাকেশ: কিছু বলবে?
আগন্তুক: হুম। বলার জন্যই তো ডাকছি। নয়তো এমনি এমনি পেছন থেকে ডাকি। নিজ মনে হাটছেন তাই বলে আশেপাশে দেখবেন না। আমি ডেকে তো মরার দশা।
রাকেশ মনে মনে বলছে, বুঝলো মেয়েটা তারর প্রতি অনেক রেগে আছে। শাসন করছে। বড় যেমন ছোটদের শাসন করে ঠিক তেমন। কিন্তু এখানে বিপরীত কিছু ঘটছে। হঠাৎ রাকেশের মনে হলো শাসন করার ভঙ্গিমাটা তার পরিচিত কোনো মানুষের। এ মুহূর্তে মাথায় আনতে পারলো না। কিছুটা অবাক হয়েই তার কথায় আবার মনোযোগ দিল।
আগন্তুক: আপনার বইটা ওষুধের দোকানে ফেলে এসেছেন। এই ধরুন।
রাকেশ: ওহ তাই তো। ধন্যবাদ তোমাকে।
আগন্তুক: শুধু ধন্যবাদ দিয়ে এতক্ষণের শ্রম দূর হবে? চলুন একটা কফি খাওয়াবেন।
রাকেশ: তাহলে সামনের রেস্টুরেন্টে বসা যাক ।
রেস্টুরেন্টে বসে দুইটা কফি দিতে বললো রাকেশ। কফি খেতে খেতে মেয়েটার সাথে কথা হয় রাকেশের। মেয়েটার নাম মিনু মিত্র। মিনু সপ্তম শ্রেণিতে জেলা গার্লস স্কুলে পড়াশোনা করে। অনেক স্মার্ট, বুদ্ধিমতি, পড়াশোনায় ক্লাসের ১ম। খেলাধুলাতেও পিছিয়ে নেই। ক্রিকেট টিমেও নাকি নাম আছে।
রাকেশ লক্ষ্য করে মিনুর কফি খাওয়ার ধরন পরিচিত এক মানুষের মতো। আলতো করে দুই হাতে কফির কাপটা চেপে ধরে ফুদিয়ে দিয়ে কফিটা ঠান্ডা করে কেমন শব্দ করে যেন কফিতে চুমুক দেয়। এই মুহূর্তে মনে করতে পারলো না রাকেশ। মিনু জানালো তার বাবা গোপাল চন্দ্র বর্মণ সরকারি অফিসে চাকরি করেন। মা শহরের এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা।
রাকেশ: মিনু, তুমি অনেক ভালো মেয়ে। আজকে তাহলে উঠি। সময় হলে তোমার বাবা-মাসহ বাসায় ঘুরতে এসো। এদিকের রহমান গলির ২৭ নং বাড়িতে থাকি। রাস্তা চেনো তো।
অনেকটা চঞ্চলতায় মিনু বলে উঠলো, রাস্তা এবং বাড়ি না জানলেও খুঁজে বের করে নিতে পারবো। শুধু বলুন কোন সময় গেলে আপনাকে পাওয়া যাবে।
মিনু: একটা কথা বলি, আপনার এই বইটি ‘চিতা বহ্নিমান’ আমার মায়ের কাছেও আছে।
মিনু অনেক বকবক করে। রাকেশের তাতে বিরক্ত বোধ হয়নি। সেদিন মিনু চলে যায়। রাকেশও বাসার দিকে চলতে শুরু করে। দশ মিনিট বাদে বাসায় পৌঁছে গেল রাকেশ। তখন দুপুর গরিয়ে গেছে। দুপুরের খাবার খেয়ে বিশ্রামের সময়। ওষুধগুলো টেবিলে রেখে ফ্রেশ হতে যায় রাকেশ। দুপুরের খাবার খাবে না বলে সিদ্ধান্ত নিল রাকেশ। তাই শিবুকে বললো খাবার গুলো তুলে রাখতে।
রাকেশ একা মানুষ। বিয়েও করেনি। পাশে থাকার মতো শুধু মা আনন্দময়ী ছিল। দুই বছর হলো তিনি পরলোক গমন করেছেন। বাসায় এখন রাকেশকে দেখভাল করার জন্য শিবু আছে।
বিকালে বেলকনিতে চেয়ারে হেলান দিয়ে শিবুকে চা দিতে বলে রাকেশ। রাকেশ চেয়ারে বসে বাইরের প্রকৃতিকে দেখছে। দেখতে দেখতে টেবিলে একটা চিঠি দেখতেই মৃন্ময়ীর কথা মনে হলো তার। চিঠিটার উপরটা সুন্দর নকশা করা। তবে এটা হাতের বানানো নয়। একসময় পদ্মরাগ নামে আগে চিঠি আসতো। খামের উপরে ফুলের নকশায় লেখা থাকতো তোমার প্রিয় ‘পদ্মরাগ’।
অনেক বছর কেটে গেছে। তার কথা ভুলে গেছে প্রায়। সে কোথায় আছে? কি করছে? রাকেশ কোনো কিছুতেই খেয়াল রাখেনি। সর্বশেষ চিঠিতে বিয়ের খবরটা শুধু পেয়েছিল। পাত্র একজন সরকারি চাকরিধারী মানুষ। কিন্তু বিয়ের পর আর খোঁজ খবর নেওয়া হয়নি। স্মৃতিগুলো আজ স্মৃতিই হয়ে আছে।
মৃন্ময়ীর সাথে রাকেশের পরিচয়টা ছিল ভিন্ন রকমভাবে। একটা অজানা ফোন কল থেকে পরিচয়। কোনো এক রাতে প্রায় পৌঁনে বারটা। ঘুমাতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। হঠাৎ ফোনটা ভাইব্রেশন হতে থাকে। এতো রাতে রাকেশকে কেউ ফোন দেওয়ার কথা নয়। ফোনটা রিসিভ করি। ওপাশ থেকে একটি ছোট বাচ্চার আওয়াজ পাওয়া গেল।
আঙ্কেল, আঙ্কেল আপনি রাকেশ বলছেন?
রাকেশ: হুম আমি রাকেশ বলছি।
আগন্তুক: আপনার সর্বশেষ যে লেখাটি বেরিয়ছিল সেটি সত্যি অনেক ভালো হয়েছে। রাকেশের শেষ লেখা ছিল ‘সুজাতার কথা’। আমি আপনার লেখা নিয়মিতই পড়ি। আপনার লেখায় জাদু আছে।
গলার আওয়াজ থেকে রাকেশের মনে হলো, যে কথা বলছে তা সে ছয় থেকে সাত বছর বয়সের হবে। পরে বুঝতে পারে ছোট্ট মেয়েটি নিজে থেকে সব বলছে না। পাশে থেকে কেউ একজন বলছে।
আর সে ব্যক্তিটি হলো পদ্মরাগী মৃন্ময়ী....।
লেখক: স্বজন কুমার রায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
আরএ/