তেত্রিশ নম্বর
আমার এক জুনিয়র হলমেট ছিল, নাম খোকন। সে একদিন আমাকে বলছিল, রঞ্জন দা একটা অনুরোধ করব আপনাকে, রাখবেন?
বললাম, কী অনুরোধ? রাখার মতো হলে রাখব। তুমি বলতে পারো।
নাহ্! আমার একটু বলতে ভয়ই লাগছে। আপনি তো এই কাজটি করেন না! তাই বলতে দ্বিধা করছি।
আরে, তুমি বলে ফেলো তো।
ছেলেটি খুব বিনয় করে বলছিল, আমার এক খালাম্মা আমাকে খুব করে ধরেছে, তার মেয়ের জন্য একজন বাংলার শিক্ষক ঠিক করে দেওয়ার জন্য। মেয়েটা ভারতের মানালীতে এক নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। পরে আর ওখানে কন্টিনিউ করেনি। ঢাকায় এনে ক্লাস নাইনে ওকে ভর্তি করা হয়। এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে। ও বাংলায় ভীষণ কাঁচা। খালাম্মার আশা, একজন টিচার রেখে দিলে বাংলায় পাস করতে ওর কোনো অসুবিধা হবে না।
আমি খোকনকে বললাম, আমি তো টিচার নই। কোনোদিন কখনো কাউকে পাঠদান করিনি। তাছাড়া, আমাকে টিউশনি করতে হবে, একথা ভাবিনিও আমি।
আমি জানি, তাইতো আপনাকে বলতে খুব ভয় লাগছিল। এই ছোট ভাইটার অনুরোধ একটু রাখেন রঞ্জন দা। মাত্র ছয়মাস আপনাকে পড়াতে হবে। আমি আপনার কথা অলরেডি খালাম্মাকে বলে ফেলেছি। ওনারা খুব আশায় আছেন। আপনি রাজি হোন। আপনাকে ওনারা খুব সম্মান করবেন।
কী আর করব! শেষপর্যন্ত আমার সেই জুনিয়র হলমেটের অনুরোধ আমাকে রক্ষা করতে হলো। আমি ওর কাজিনকে কয়েক মাস বাংলা পড়ানোর জন্য রাজি হয়ে যাই।
আমার এই ছাত্রীটির নাম নায়না। একদিন সন্ধ্যায়
হল থেকে হেঁটে হেঁটে চলে যাই এলিফ্যান্ট রোডের অ্যারোপ্লেন মার্কা মসজিদের পাশে ওদের বাসায়। মেয়েটি একদম বালিকা বয়স। চৌদ্দ পনের বছর হবে। ছিপছিপে গড়ন। গায়ের রং উজ্জ্বল গৌরীয়। চোখ দুটো টানা টানা। মায়াভরা চাহনি। আমি গিয়েছি ছাত্রী পড়াতে। ছাত্রীর রূপ দেখা আমার কাজ নয়। তবুও ওর মায়াবী রূপের কথা বলতে হলো।
আমি নায়নাকে বললাম, তুমি কী বাংলায় ৩৩ নম্বর পেয়ে পাশ করতে চাও, নাকি ৪৫, অথবা ৬০। কারণ, তুমি এই তিনটি থেকে যেটি চাও, সেই অনুযায়ী তোমার উপর শর্ত ও বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে।
নায়না বললো, ৩৩ নম্বর।
আমি বললাম, ঠিক আছে তাই হবে।
শর্ত ও বিধিনিষেধগুলো কী?
পরে আস্তে আস্তে জানতে পারবে। যেহেতু তুমি ৩৩ নম্বর চুজ করেছ। সেইক্ষেত্রে বিধিনিষেধ একটু কমই আরোপ হবে।
নায়না বলছিল, আপনাকে কী বলে সম্বোধন করব? রঞ্জন দা, নাকি স্যার বলে।
স্যার বলে সম্বোধন করবে।
আমি নায়নাকে বললাম, কাল থেকে তোমাদের বাসায় ইংরেজি পত্রিকার পাশাপাশি বাংলা পত্রিকাও রাখবে। সাথে সাপ্তাহিক বিচিত্রা ও চিত্রালীও রাখবে এবং এগুলো পড়বে তুমি নিয়মিত।
জ্বি স্যার, পড়ব।
আর একটি কথা। যেহেতু তুমি ৩৩ নম্বর বেছে নিয়েছ, তাই তোমাকে সিলেবাস থেকেও পড়াব এবং সিলেবাসের বাইরে থেকেও পড়াব।
জ্বি, আচ্ছা।
আমি নায়নার বাংলা বইটি ওর হাতে দিয়ে বললাম, মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘কপোতক্ষ নদ’ কবিতাটি পড়। নায়না পড়ল ঠিকই কিন্তু অনেক ভুল উচ্চারণে। আমি ওকে আবৃত্তির মতো করে কবিতাটি পড়ে শোনালাম। এবং বললাম, এরপর এই কবিতার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও কবির জীবনী পড়াব।
তুমি কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনী পড়বে। এইটাই তোমার হোমটাস্ক।
আমি সপ্তাহে তিনদিন করে যেয়ে নায়নাকে পাঠদান করতে থাকি। মোটামুটি ভালোই অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। কিন্তু ওর মধ্যে কিছু মানসিক সমস্যা দেখছিলাম। নায়নার এই মানসিক সমস্যাটি আমার জুনিয়র বন্ধু খোকন আমাকে বলেছিল না।
মেয়েটি মানালীতে পড়তে যেয়ে একটি দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিল। রাজকুমার নামে এক রাজস্থানী তরুণের সাথে ওর গভীর বন্ধুত্ব হয়েছিল। এক তুষারপড়া দিনে ওরা দুজনেই তুষারের উপর স্কিইং করেছিল। ছেলেটা হঠাৎ পা ফসকে আচমকা দ্রুতবেগে গিরিখাতে পড়ে যায়। ওকে আর খাত থেকে উদ্ধার করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। অতল গিরিখাতেই ছেলেটির সমাধি হয়। সেই থেকে নায়না মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। তারপর ওকে আর মানালীতে রাখা সম্ভব হয়নি। ঢাকায় ফিরিয়ে আনা হয়।
মেয়েটির মা একদিন অবশ্য আমার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলছিল, তুমি ওকে পড়ানোর পর থেকে ওর পাগলামি অনেক কমে গেছে। পড়াশোনায়ও বেশ মনোযোগী হয়েছে। আমাকে তুমি কী যে উপকার করেছ বাবা!
একদিন নায়নাকে বললাম, তুমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'হৈমন্তী' গল্পটি পড়বে কমপক্ষে তিনবার। যদিও তোমার সিলেবাসে এটি নেই। সিলেবাসে আছে 'দেনাপাওনা'। এই হৈমন্তী গল্পটি পড়ে তোমার যে অংশটি বেশি ভালো লাগবে, তা আমাকে জানাবে। ওর হাতে একটি পিনআপ কাগজ দিয়ে বললাম, এখানে গল্পটির আমারও ভালোলাগার কথাগুলো লেখা আছে। এখন খুলে দেখবে না। পরে দেখবে। দেখি তোমার সাথে আমার ভালোলাগা মিলে যায় কি না?
দুইদিন পর যেয়ে দেখলাম, হৈমন্তী গল্পের ওর ভালোলাগার কথাগুলো একটি কাগজে লিখে রেখেছে। আমার পিনআপ করা কাগজটাও খুললাম, দুজনেরই একই কথা লেখা। ‘…যাহা দিলাম তাহা উজাড় করিয়াই দিলাম। এখন ফিরিয়া তাকাইতে গেলে দুঃখ পাইতে হইবে। অধিকার ছাড়িয়া দিয়া অধিকার রাখিতে যাইবার মতো এমন বিড়ম্বনা আর নাই...।’
তখন একুশে ফেব্রুয়ারি সামনে। আমি একদিন নায়নাকে পড়াতে যেয়ে বললাম, ২০ ও ২১ তারিখ আসব না। আর্ট কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে ২০ তারিখে আমি রাজপথে আলপনা আঁকব। আর একুশ তারিখ সকালবেলা যাব, প্রভাতফেরিতে। গাইব নগ্নপায়ে গান, ‘আমার ভাইয়ের রক্ত রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কী ভুলিতে পারি?’
নায়না বায়না ধরেছিল সেও আমার সাথে রাজপথে আলপনা আঁকবে। ওর মাকে বলে গিয়েছিল আলপনা আঁকতে। সারারাত রাজপথে আলপনা এঁকে সকালবেলা প্রভাতফেরি করে সেদিন নায়না বাড়ি ফিরে গিয়েছিল।
একসময় নায়নার পরীক্ষার তারিখ খুব কাছাকাছি চলে আসে। এই কয়মাসে নায়নাকে বাংলা বিষয়ে বেশ প্রস্তুতি করে তুলি। ওর ভেতর আমি একটি আস্থাও দেখলাম। আর এক-দুই দিন পড়িয়েই শেষ করে দেব ভাবছি।
সেদিন ছিল ওকে পড়ানোর শেষ দিন। নায়নাকে বললাম, কাল থেকে আর আসব না। তুমি ভালোভাবে পরীক্ষা দিও। পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করলে তোমাকে অভিনন্দন জানাতে আর একদিন আসব।
নায়না মুখ নিচু করে আছে। আমার কাছে মনে হলো, ওর চোখ ছলছল করছে। হ্যাঁ, মানুষের জন্য মানুষের মায়া হয়, আমার প্রতি ওরও হয়ত মায়া হয়েছিল। যেমন ওর জন্য আমারও খারাপ লাগছে। কটা মাস কী এক দায়িত্ববোধ যেন ছিল আমার। সেই দায়িত্ব পালন শেষ হয়ে গেল।
নায়না বলছিল, স্যার, একটা অনুরোধ করব, রাখবেন?
বললাম, বলো রাখব।
আপনি কোনোদিন কোনো পর্বতমালায় যাবেন না। ওখানে কোনো তুষারপড়া দিনে তুষারের উপর দিয়ে হাঁটবেন না। বলেন— রাজি আপনি!
বললাম, আচ্ছা যাব না। রাজি।
স্যার, আমার এমন লাগছে কেন? কেমন যেন কান্না পাচ্ছে। দেখলাম নায়না কাঁদছে।
আমি নায়নাকে বললাম, সামনে আমাদের ইউনিভার্সিটি সামারের বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বাড়ি চলে যাব। তিন মাস ওখানে থাকব। ভালোই লাগবে ওখানে। নিঝুম সন্ধ্যায় যমুনার কূল ধরে হাঁটব। আকাশ জুড়ে দেখব ঘন নীল! অপূর্ব শীতল বাতাস জল ছুয়ে এসে লাগবে আমার গায়ে।
আমি নায়নার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসি। তখন সন্ধ্যা রাত্রি। এলিফ্যান্ট রোডের ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসি নীলক্ষেত মোড়ে। একটি টং চায়ের দোকানে বসে চা খাই। একটা সিগারেট ধরাই। সিগারেট টানতে টানতে চলে আসি ভিসি স্যারের বাসার সামনে।
সেখানে রাস্তার উপর একধরনের অদ্ভুত আলো আঁধার বিরাজ করছিল। রেইনট্রির বড়ো বড়ো ডাল আর পাতার ফাঁক দিয়ে অসম্ভব সুন্দর চাঁদের আলো বিচ্ছুরিত হয়ে পড়ছিল রাস্তার উপর। তার কিছু আলো এসে লাগছিল আমার শরীরে। কী যে ভালো লাগছিল তখন! মনে মনে আওড়াচ্ছিলাম পূর্ণেন্দু পত্রীর কবিতার এই কয়টি পংক্তি—
‘...সবাই মানুষ থাকবে না।
কেউ কেউ ধুলো হবে, কেউ কেউ কাঁকর ও বালি
খোলামকুচির জোড়াতালি।
কেউ ঘাস, অযত্নের অপ্রীতির অমনোযোগের
বংশানুক্রমিক দুর্বাদল।
আঁধারে প্রদীপ কেউ নিরিবিলি একাকী উজ্জল।
সন্ধ্যায় কুসুমগন্ধ,
কেউ বা সন্ধ্যার শঙ্খনাদ।
অনেকেই বর্ণমালা
অল্প কেউ প্রবল সংবাদ...।’
বাড়ি থেকে তিনমাস পর ফিরে আসি। ততদিনে নায়নার পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে। আমি খোকনকে জিজ্ঞাসা করি, নায়নার রেজাল্ট কী? খোকন বললো, প্রথম বিভাগ পেয়েছে। বাংলায় ওর নম্বর ৬০+।
একবার ভাবলাম একটি ফুলের তোড়া নিয়ে নায়নাকে একদিন অভিনন্দন জানিয়ে আসব। কিন্তু যাওয়া আর হয়নি। মানুষের কিছু আবেগ ও মায়া নিষ্ঠুরতায় আটকে রাখতে হয়। প্রকাশিত করতে হয় না।
মেয়েটা হয়ত অপেক্ষা করেছে অনেক বিকেল। ললাটগামী হয়েছে অশ্রুবিন্দু। মানুষের এমন কত চোখের জল অগোচরে কালের কপোল তলে ঝরে পড়ে যায়, কে তা দেখে!
আরএ/