চাষবাসের 'চাষা'
চিরাচরিতভাবে ‘চাষা’ শব্দটি আমরা অনেকে কাউকে ভর্ৎসনা বা খাটো দেখানোর অর্থে প্রকাশ্যে বা নিন্দের সূচকে ব্যবহার করে এসেছি। যদি মিথ্যে বলে প্রতীত হয় বা কারো মর্মে আঘাত লাগে তাহলে আমি সবার কাছে ক্ষমা-প্রার্থী।
চাষাও মানুষ সমষ্টির অঙ্গ। যারা নিত্য মাটি উজিয়ে চাষবাস করে। রক্ত ঘামে বেঁচে থাকার ঐতিহ্যগত জীবিকা মনে করে। দু’হাত নিংড়ে অন্ন-যোগানের আপ্রাণ চেষ্টা ধরে। তাদের আমার সশ্রদ্ধ সালাম।
এই শব্দটির আক্ষরিক অর্থ আমরা বুঝিয়ে এসেছি— চাষা মানে গেঁয়ো, গাঁইয়া, দেহাতি, মূর্খ, বোকা অসভ্য, বর্বর, ভাঁড়, ইত্যাদি ইত্যাদি…অর্থাৎ একপ্রকারের অন্তহীন চাষাড়ে গালাগালির জুগুপ্সা, বা তথাগত সংস্কৃতিবান ভাষার ইঙ্গিতে চাষা মানে ‘অমার্জিত ব্যক্তি’। ‘গ্রাম্য মজুর’।
নানা অভিধান ঘেটেঘুঁটে নিংড়ে যতটুকু আমার সীমিত জ্ঞানবুদ্ধির সাথে যুদ্ধ বাধিয়ে বুঝলাম বা উপলব্ধি উদ্ধার করলাম— চাষা শব্দের উৎপত্তি চাষ থেকে যার প্রকৃত অর্থ ‘যে চাষ করে’ বা ‘কৃষক’। তাহলে চাষা শব্দের আভিধানিক অর্থ দাঁড়ালো— কৃষি; কৃষিজীবী উৎপাদন।
চাষা শব্দটির বিবৃতি অনেক কবি সাহিত্যিকের কলমে লক্ষণীয় ভাবে ফুটে উঠেছে। কাজী নজরুলের কবিতায় – ‘সব সাধকের বড় সাধক, আমার দেশের চাষা’।’ চাষী ওরা নয়কো চাষা, নয়কো ছোটলোক’ । অনেকের গানে গল্পে উপন্যাসে তদাদিনসময়ের প্রতিবেদন কীর্তনে স্পষ্টভাবে আধৃত চাষা-কৃষকের অবমাননা, মানসিক, শারীরিক নির্যাতন আবার কৃষি মঙ্গল ও প্রগতির প্রচেষ্টার প্রতিকার বিধান।
কৃষি চাষা-কৃষকদের চিন্তা ভাবনার নান্দনিকতা। যেমন—ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘মুচিরাম গুড়ের জীবনচরিত’। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘শীর্ষেন্দু বিন্দু থেকে সিন্ধু’। শরৎ চন্দ্রের ‘পণ্ডিতমশাই’। রবীন্দ্রনাথ ‘দুই বিঘা জমি’তে উপেন চরিত্র চিত্রায়নে মহাজনী শোষনের নিষ্ঠুরতার বর্ণনা পেয়েছি। এছাড়া আরও অনেক বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সমাজ উপচিকীর্ষা ব্যক্তির ‘চাষা’ শব্দ তাদের লেখনীর বয়ানে উল্লেখযোগ্য এজাহার স্মরণীয় মনোভাব।
রবীন্দ্রনাথ জমিদার বংশের সন্তান হয়েও তার চেতনার গভীর গহীনে সাহিত্যের লালন পালনে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন ‘কৃষিই বাংলার কৃষ্টি। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বব্যাপী সাহিত্যিক হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন বিজ্ঞানের বরপুত্র। কৃষিতে নতুন প্রযুক্তির উৎসাহী। উৎকৃষ্ট কৃষির আধুনিকায়ন মানে বিজ্ঞানভিত্তিক চাষাবাদ। শক্তি ও কৃষি যান্ত্রিকীকরণ। আধুনিক প্রযুক্তির নির্বাচন এবং শস্য উৎপাদনে প্রযুক্তির ব্যবহারে উদ্যমী। চাষার চাষবাস বিজ্ঞানের তালিমের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়ার আগ্রহ। বলেছেন সামান্য লাঙ্গলের ফলার সাথে মাটির সংযোগ যথেষ্ট ভূমিকর্ষণ নয়।
রবীন্দ্রনাথ নিরক্ষর চাষাদের জন্য কৃষি ব্যাংক পরিষেবা স্থাপন করেন। সর্বোপরি নিজের নোবেল পুরস্কারের অর্থের অধিকাংশ ভাগ মূলধন হিসাবে প্রদানও করেন।
রবীন্দ্রনাথ এমন কি চাষ বাসের ভবিষ্যৎ উন্নতির দূরদৃষ্টি নিয়ে স্বেচ্ছায় তার পুত্র রথীন্দ্রনাথকে পাঠিয়েছিলেন আমেরিকায় ইলিয়ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ কৃষি শিক্ষার জন্য। রবীন্দ্রনাথ নিজে কৃষি বিজ্ঞানে জ্ঞানার্জন না করেও একজন পরিপক্ক কৃষিবিদের দৃষ্টান্ত।
‘চাষা’ শব্দের সর্বপ্রথম ব্যবহার কবে বা কোথা থেকে আবির্ভাব আর কীভাবে জনসমাজের ঘরে বাইরে ছোঁয়াচে রোগের মতো ছড়িয়ে পড়লো সে তথ্য আমার জানা নেই বা জানারও প্রয়োজনবোধ আছে বলে আমি অন্তত মনে করছি না।
ভাষাবিদ বিশারদগণ ভালোভাবে বিশদ ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ করতে পারবেন। আমি নিশ্চিত ‘চাষা’ শব্দটি সমগ্র চাষা-কৃষক বর্গসমুদয়কে নিম্নতর দর্শানোর জন্য ব্যবহার বা প্রয়োগ করা হতো বলে আমার নিজস্ব ধারণা।
দেশ যখন ব্রিটিশ শাসনের অধিকারে তখন বেশ কিছু জমিদার বা ধনী সম্প্রদায় নিজেদের অস্তিত্ব ঠাটবাট রক্ষা বা মজবুত রাখার জন্য গোরা সাহেবদের খোশামোদে তটস্থ থাকত। নিজেদের ব্যক্তিগত সুবিধার স্বার্থে খেয়াল খুশী মতো চাষা-কৃষক-মজুরদের নির্যাতন করত যাতে নিজেদের ক্ষমতা অক্ষুণ্ন থাকে।
উঁচু জাতের মানুষ খেটে খাওয়া চাষা কৃষকদের নিম্নজাত বলে প্রকাশ্যে বলতে লজ্জাবোধও করত না। কথায় কথায় পান থেকে চুন খসলে ‘চাষা’ বলে নিত্য তিরস্কার বা দূরে সরিয়ে রাখার প্রবণতা এবং তাদের সমান্য মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখার প্রবঞ্চনা কৌশলে চালিয়ে যেতে দ্বিধাবোধও করত না। যার বহু জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত ইতিহাসের পাতায় বন্দী।
অসংখ্য মানুষ যারা নির্ভয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে নিজেদের ঘর-সংসার উপেক্ষা করে প্রাণ বলিদান দিয়ে আমাদের জন্মভূমি মাতৃভূমি দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খলা থেকে মুক্ত করে গেছেন যাদের তখন আমরা বিপ্লবী বা স্বদেশী বলতাম। তাদের মৃত্যূ-ফাঁসি, যন্ত্রণা কষ্ট নিষ্ঠার সৌজন্যের অবদানে স্বাধীনতা ফিরে পেলাম। তাই আমরা স্বাধীন হওয়ার সুযোগ সুবিধে কুড়িয়ে আধুনিক মস্তিষ্ক সম্পন্ন মানুষ হলাম। তবু সেই চাষা শব্দটির ব্যবহার, সম্বোধন রীতিনীতির আচারে বিচারে বর্তমান দিনেও বিদ্যমান যার উদ্দেশ্য অম্লান ও দ্রুত চলমান।
যাতে ‘চাষা’ শব্দের উত্তরসূরি মর্যাদা ক্ষুণ্ন না হয় বলে আমাদের কিছু স্বজাতির অলীক সভ্যতার জিভের ডগায় রয়ে গেছে ও যতদিন মানুষ অর্থগুণে গুণবান পরিচিতি প্রতিপত্তির আখ্যার লেবেল সেঁটে জীবিত থাকবে ততদিন চাষা শব্দের ব্যবহারে অনর্থ ঘটবেই।
বেদ বাক্যের মতো সত্য যে চাষার দৌলতে আমরা আজ দৌলতমন্দ। চাষার শ্রমের পুণ্যিতে সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা মাটি আবাদ হরিৎ কোজাগরী কমলা।
আজও চাষা-কৃষক নিজেদের ব্যক্তিগত প্রয়োজন, মর্যাদা প্রতিষ্ঠার স্বার্থ নির্বিশেষে নিঃশব্দে জলাঞ্জলি দিয়ে স্বছন্দে আঙুল খুলে আনন্দের ঘোরে লাঙ্গল তুলে বাঁজা মাটি খুঁড়ে বুঝিয়ে দিয়ে আসছে…
চাষার চাষবাস দেশের জীবিকা। মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাস। স্বাস্থ্য নিরাময় করার আশ্বাস। কৃষি দেশের সম্পদ।
চাষা-কৃষকদের সবল স্বাবলম্বী না করতে পারলে কোনো দেশ সমৃদ্ধশীল, উন্নতিশীল হতে পারে না— এ কথা অবশ্যই আমাদের স্বীকার করতে হবে। আমাদের মানুষের জন্মগত বা শিক্ষাগত পেশা যাই হোক তবু স্বভাবগত কৃষি উৎপাদন ভাবনা নেশার প্রবৃত্তি রক্ত-মাংস-মজ্জায় বহন করতে হবে ও তার প্রতিপালনে সোচ্চার হতে হবে।
চাষা-কৃষকদের ভূমির অধিকার, খাজনা মওকুফের অধিকার, সময়মত স্বল্পসুদে ঋণ প্রাপ্তির ব্যবস্থা, সমবায় কৃষি বিজ্ঞানের প্রশিক্ষণ, কৃষিপণ্য উৎপাদিত জিনিষের ন্যায্যমূল্য আদান প্রদানের অধিকার। কৃষির সার্বিক উন্নয়ন চেয়ে কৃষির পূর্ণব্যাদিত বৃহত্তর প্রবর্তন আমাদের সত্ত্বর প্রয়োজন।
বর্তমান কৃষি শিক্ষা সংস্থার সমস্ত কৃষি-শিক্ষানিবিশদের প্রত্যন্ত গ্রামে গঞ্জে গিয়ে কৃষকের চাষবাসে হাতে হাত মিলিয়ে একসাথে কাজ করার জন্য উৎসাহ দিয়ে সরাসরি আবশ্যিক করার প্রয়োজন যা অদূর ভবিষ্যতে সমস্ত মানুষের মনে-প্রাণে কৃষি বিবেক জাগিয়ে তুলবে।
অন্যান্য শিল্প-পরিকল্পনার সংকল্পের পাশাপাশি এক উন্নত মানের কৃষিসাধন দেশ গড়ে তোলার জন্য বেশি করে প্রাধান্য স্থাপন করে আরও তৎপর হতে হবে তাহলে আর অন্ন-রসদের জন্য পরের মুখ চেয়ে থাকতে হবে না।
চাষার চাষবাস দেশের শ্বাস-প্রশ্বাস পরিশীলিত উচ্ছ্বাস উপেক্ষা বা অস্বীকার করলে বলতে হবে আমাদের মানুষ জন্ম এক নিছক পরিহাস।
আরএ/