মাঘের শীত বাঘের শীত
শীত থেকে বাঁচতে কাজী নজরুল ইসলাম নিজেকে হাঁড়িতে চড়িয়ে চুলার উপর রাখার কথা বলেছিলেন। তার রসবোধ ছিল প্রবল। যে কোনো কিছুকেই সহজে তিনি ব্যঙ্গাত্মক করে তুলতে পারতেন।
তিনি বলছেন, হাঁড়িতে চড়িয়ে আমায়/উনুনে রাখ গো ত্বরায়। কবির এই ইচ্ছা বাস্তবে বাস্তবায়নের চেয়ে বড় সত্য হলো শীত যখন জেকে বসে তখন প্রায় সবার মানসিকতা এমনটাই হয়। চোখ বাদে সমস্ত শরীর ঢেকেও ‘যেন শীতকে মোকাবিলা করা যায় না। যদিও এরকম শীত শহর এলাকায় বলা যায় বেশ দুর্লভ।
পৌষের শীত গেলে, মাঘের শীত শুরু। শুরু হয়েছে আরও প্রবল বেগে ধেয়ে আসা শীতের দাপট। কে তা গ্রহণ করল না করল তাতে মাঘের কিছু আসে যায় না। শীতের হাওয়াকে গ্রহণ করা না করার কোনো ধার সে ধারে না। শীতের কনকনে হাওয়া উপেক্ষা করা যায় না কোনোভাবেই। এ হাওয়া কাউকে কষ্ট দেয় আবার কাউকে দেয় আনন্দ। আসলে কারোর কোনো কিছু ভালো লাগা না লাগাকে বিবেচনায় রেখে মাঘ আসে না। সে আসে প্রাকৃতিক নিয়মেই। সে আসে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে তার নিয়ম রক্ষার্থে। তাকে যে আসতেই হবে। পৌষের পরেই যে মাঘ মাস। এ মাসও তো শীতের কিছু বৈশিষ্ট্যের তারতম্যের মধ্যে দিয়েই মৌসুমী হাওয়া বদল করে থাকে। বর্তমান বৈরী আবহাওয়া অনেক কিছু পরিবর্তন করলেও প্রকৃতির খেয়ালকে কি সহজে পরিবর্তন করা যায়। মাঘ শীতকে ভরপুর করে তোলে।
শীতঋতু উমউম ঋতু। আলসেমিতে পেয়ে বসে সহজেই। কোনো কাজ শুরু করাটাই যেন কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। তবে কোনো কাজ একবার শুরু করলে সহজেই ঠাণ্ডার সঙ্গে মানিয়ে যাওয়া যায়। পারত পক্ষে না পারলে কোনো কাজে হাতই দিতে মন চায় না। আড়মোড়া ভেঙে আলস্যকে দূর করা সত্যি কষ্টকর মনে হয়। নেহায়েত নিরূপায় হয়েও অনেক কাজ করতে হয়। কখনো এমন হয় যে বিছানা গড়াগড়ি দিয়েই বেলা কেটে যায়। নাওয়া খাওয়া নেহায়েত অসহায়। অথচ শীত নাচাল। তাকে তার নিয়ম রক্ষা করতে হয়। পুরো বৈশিষ্ট্যকে অক্ষুণ্ন রাখতে হয়। পাছে কেউ আবার অভিযোগ করে শীত এলো অথচ টেরই পেলাম না।
শীতকে নিয়ে অনেকেই অনেক ভাবে চিন্তা করে থাকে। একেকজনের দেখা একেক রকম। প্রত্যেকেই যার যার মনের মাধুরী মিশিয়ে শীতকে দেখে থাকে। ভালো খারাপ উভয় রকম, এমনকি মিশ্র অনুভূতিও থাকে। কেউ যদি রাত জেগে জেগে ভোর দেখে সেই বুঝবে রাতের শীতের ধরন কেমন। এটাও একটি অভিজ্ঞতা। এ অভিজ্ঞতা কি সবাই পায়। ‘সিলেট স্টেশনে একটি শীতের প্রভাত’ নামে এক কবিতায় ফররুখ আহমদ একটি শীতের প্রভাতের চমৎকার একটি বর্ণনা দিয়েছেন। ইরানি ছুরির মত তীধার হাওয়াকে তিনি উপমা শীতের কনকনে হাওয়ার উপমা হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
‘অন্ধকার আজদাহার বেষ্টনীতে প্রাণীও প্রাণের
সাড়া নেই। এখানে জালালাবাদে দেখি এসে
হিম-সিক্ত কম্বলের মত রাত্রি ঢেকেছে নিঃশেষে
সমস্ত আলোকরশ্মি পৃথিবীর সকল পথের।
ইরানী ছুরির মত তীধার হাওয়ার উত্তরের
বিদ্ধ হয় অনাবৃত তরু শীর্ষে, নিমেষে নিমেষে
তারি স্পর্শ পাই শূন্য প্লাটফর্মে; মাঘ রাত্রি শেষে
সুপ্তিমগ্ন জনপ্রাণী এখন সিলেট শহরের।’
মাঘের শীতের সময় হাওয়ার যেন আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এসময় শৈত্যপ্রবাহ দেখা যায়। প্রচণ্ডভাবে শীত তখন জেকে বসে। মানুষের অনেক কষ্ট হয়। দুর্যোগের মধ্যেই ফেলে দেয় বলা যায়। সারারাত আরও কষ্ট। অবর্ণনীয় কষ্ট হয় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে। আর সব জায়গায় গরিব মানুষের। এই শৈত্য প্রবাহ এমনকি গৃহপালিত পশুদের নিরুাদরুণ কষ্টভোগে বাধ্য করে থাকে। তবু মানুষ প্রকৃতির প্রয়োজনেই শীতের আগমন আশা করে থাকে। কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী শীতের একটি বর্ণনা দিয়েছেন -
‘তুষারি শিশির রিতু হিম চারি মাস
খুলনার শীত খণ্ডে রবির প্রকাশ।’
শীতের দিনে শীতের পিঠা খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। নানারকম পিঠা। তেলে পিঠা, তেল ছাড়া পিঠা আরও রসের পিঠা। সামর্থ্যে না কুলালেও প্রত্যেকেই চায় একটু পিঠার আয়োজন করতে। সবাই তার সাধ্যের মধ্যে কমবেশি খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করে থাকে। ভাপা, পুলি, চিতই যেন রসনার বাড়তি আয়োজন হয়। এই পিঠা খাওয়ার আনন্দটুকু সবাই যেন একটু হলে পরখ করে তৃপ্ত হতে চায়। এ সময় রসের আয়োজন সত্যি সব কিছুকে আরও উন্মুখ করে তোলে। শহর অঞ্চলে বিভিন্ন জায়গাতেই এসময় পিঠা পাওয়া যায়। ইদানীং পিঠার উৎসবও হয়। চারিদিকে রসের মৌ মৌ গন্ধ। বাহারী ফুলের সৌরভে যুক্ত হয় হরেক রকম ফুল। শীতের সবজি তো রুচির মধ্যে বৈচিত্র্য এনে থাকে। দৈনন্দিন খাওয়া দাওয়াতেও যথেষ্ট রুচি পাওয়া যায়। সব কিছু মিলে শীত নিজেকে পুরোপুরি মেলে ধরার চেষ্টা করে। শিশির সিক্ত ভোর আর কুয়াশা ঢাকা প্রকৃতি তো আছেই। কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় হিমের এমন বিষয়টি সুন্দর ভাবে ব্যক্ত করেন।
‘শিশিরের কোলে হিমঋতু আসে,
নিশি-অশ্রুজলে তরুদল ভাসে;’
শীত সত্যি দরিদ্র মানুষের জন্য কষ্ট এনে থাকে। তারা সারারাত অপেক্ষায় থাকে একটু রোদের জন্য। সকালের সূর্যের প্রতিক্ষায় কাটে তাদের প্রহর। শীতের মৌসুমে বৃষ্টিপাত হয় না বললেও চলে। তবু হঠাৎ বৃষ্টি হয়ে যায় কখনো কখনো। সে কষ্ট আরও নিষ্ঠুর হয়ে আসে গরিবের জন্য। প্রকৃতি যেন এক নিষ্ঠুর খেয়ালে মেতে আনন্দ পায়। অথচ শীতের রোদকে বিলাসী করে উপভোগ্য করে তোলে অভিজাত মানুষেরা। ভ্রমণ আর ঘুরে ঘুরে আনন্দ মেতে থাকে তারা এসময় অন্যান্য সময়ের চেয়ে একটু বেশি। ধনী-গরীব ভেদে একই বিষয় একেক জনের কাছে একেক রকম। মাঘের রাত্রিগুলো বড় কষ্টকর। মাঘের শীত বাঘের শীতের মতোই। তখন মনে হয় এক মাঘে আসলেই শীত যায় না। এই ব্যবধান কবে ঘুচবে কে জানে? এরকম একটি অনুভূতিকে এভাবে ব্যক্ত করেছিলাম একটি কবিতায়-
‘বিকিনির শরীরের রোদ পুড়ে সানবাথ
তেঁজগাঁও রেললাইনের বস্তিগুলো
সুশৃক্সখল সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকে
রোদের অপেক্ষায়।
শিশিরের উপর খালি গায়
কাঁপে কুয়াশা
রোদ আসবে রোদ।’
শীত মৌসুমে সারা দেশ জুড়ে বিভিন্ন রকম মেলা বসে। এসব মেলায় সবাই জড়ো হয় আনন্দের সাথে। নানা রকম সাজে সেজে মেতে থাকে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। ছেলে-বুড়ো সবাই এ সব উৎসবকে নিজের মতো করে গ্রহণ করতে চায়। উৎসব আমেজ বিরাজ করে দেশের বিভিন্ন জায়গায়। কোনো কোনো মেলা মাসব্যাপীও চলে। এসময় আরও একটি বিষয় বেশ দেখা যায়, যদিও তা ইদানীংকালে যথেষ্ট কম হচ্ছে তা হলো ওয়াজ মাহফিল। শহরে, গ্রামে-গঞ্জে সারারাত ধরে ওয়াজ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। কোনো কোনো মাহফিল তিন থেকে পাঁচদিন পর্যন্তও চলে। অদ্ভুত ব্যাপার এ সব মাহফিলে অসীম ধৈর্যের সাথেই মানুষ সারারাত ওয়াজ শুনে থাকে। মাহফিলের সাথে নিজেকে গভীরভাবে নিবিষ্ট করে নেয় নিজেকে। ওরশ মাহফিলের অনুষ্ঠান এসময় বেড়ে যায় সারা দেশে। ওরশের প্রস্তুতিও চলে বেশ ঘটা করে।
মাঘ মাস আসবে আর ৩০ দিন পরই পত্রিকার হিসাব মতো বিদায় নেবে। মাঘের শীত বাঘের গায়ে লাগা থেকে বাঘও বেঁচে যাবে। আসবে রোমাঞ্চের ঋতু যাকে ঋতুরাজ বসন্ত বলা হয়। গাছে গাছে পাখি কূজন আর কোকিলের ডাকে শিহরতি হবে প্রকৃতি। রঙের শোভায় অপরূপ হয়ে উৎসবে প্রকৃতি। তবু শীত রেখে যাবে তার স্মৃতি চিহ্ন। শীতের অবদানকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখা সুযোগ নেয়। শীতের উদারতাও নিষ্ঠুরতার সময়েই পরবর্তী সময়ের জন্য প্রকৃতি নিজেকে তৈরি করে নেবে। বলা যায় শীত তুলনাহীন। তাকে বারবার আসতেই হবে। শীতকে আমাদের যে বড় প্রয়োজন। ধনী-গরীবের মাঝে শীতই বড়মাপের পার্থক্যটা জানান দিয়ে যায় প্রকাশ্যে।
আরএ/