চিঠি
জনাব,
নমস্কার, আশা করি ভালো আছেন? আমিও ভালো আছি। গত পরশু আপনার পত্র পেয়েছি। আপনি জানতে চেয়েছেন, আমি কোন ফুল পছন্দ করি। আপনি হয়তো আবারো জানতে চাইবেন উত্তর তখন লিখিনি কেন? এবার আমার উত্তর শুনুন। মন চায়নি তাই লিখিনি।
আমার কদম ফুল খুবই পছন্দের। যখন বর্ষা আসে তখন কদম গাছে ডগায় কদম ফোটে। কদম ফুলে আছে দুটি রং। উপরে পবিত্রতার রং সাদা, নিচে হলুদ চাঁদর। মনে হয়, সেদিন কদম গাছের বিয়ে নয়তো গায়ে হলুদ। নানা আয়োজনে চলে সাজ-সজ্জা। বিয়েতে আমন্ত্রণ করা হয়েছে মৌমাছিকে। যাই হোক পছন্দের ফুলকে নিয়ে আজ এপর্যন্তই। ভালো থাকবেন। নিজের শরীরের প্রতি যত্ন নেবেন।
ইতি মৃন্ময়ী
মৃন্ময়ীর বয়স একুশ। স্নাতক বাংলা নিয়ে পড়ছে। এইতো মাস দুই হলো। অত্যন্ত মেধাবী এবং বুদ্ধিমতি। মৃন্ময়ীর মায়াবী চোখে উপর কেউ তাকালে তাকে নির্ঘাত প্রেমে পড়তে হবে। আর প্রেম ভালোবাসায় মৃন্ময়ীর প্রচুর অনীহা। এজন্য কেউ যাতে তার চোখে, চোখ রাখতে না পারে তাই সামনে আরও দুটো চোখ লাগিয়ে রাখে। তবে চশমা ছাড়া সেসব কিছুই দেখতে পায়।
আলোটা নিভিয়ে দাও দিদি, বীণা বলল। বীণা মৃন্ময়ীর ছোট বোন। দশম শ্রেণিতে পড়ে। বীণা তুই এখনো ঘুমাসনি কেন? তোমার মহাকাব্য রচনা শেষ হলে তবেই তো ঘুমাব।
‘নয়নে আমার তোমার আলোয় স্বপ্ন আসে না,
বন্ধুটি আমার ঘুমিয়ে যাবে, আর বিলম্ব সহে না।’
তোর ভ্য ভ্য বন্ধ কর। আর সারা জীবন কালো রঙের কাক নিয়েই স্বপ্ন দেখ।
হ্যাঁ দেখবোই তো, তাতে তোমার কি? তোমার মতো তো ভীরু, হাদারামকে চিঠি লিখছি না।
মৃন্ময়ী তার মনের মানুষকে প্রায় রাতে চিঠি লিখে। তবে মৃন্ময়ীর মনের মানুষ একজন নয় একাধিক। শুনে অবাক লাগছে তাই না। প্রতি রাতে মনের মানুষগুলোই তাকে মুক্তি দেয়। মনের মানুষগুলো বলতে চিঠি। চিঠিগুলো পোস্ট অফিস পর্যন্ত পৌঁছায় না। চিঠিতে মনের কথাগুলো লিখে আর নিজের কাছে রেখে দেয়। এই চিঠিগুলো প্রাপকের ঠিকানায় পৌঁছায় না। শুনে হয়ত একটু আবাকই লাগে। সত্যি চিঠিগুলো লিখা শেষে জায়গা পায় গোপন এক বইয়ের মধ্যে। এ বিষয় বীণাও কিছু জানে না।
চিঠিগুলো লিখে ইচ্ছে অনুযায়ী। যখন খুব একা লাগে। কোনো কিছুই ভালো লাগে না। সেদিন অধিক রাত পর্যন্ত মৃন্ময়ী জেগে থাকে। আর রাত জেগে আগন্তুককে চিঠি লিখে।
একদিন বীণা রুম পরিষ্কার করছিল। যখন সে পড়ার টেবিলের বইগুলো সাজিয়ে রাখছে তখন একটা মোটা বইয়ে বেশ কিছু আঠা লাগানো খামে কাগজ পায়। সেই কাগজগুলো আসলে চিঠি। গতরাতে মৃন্ময়ী ভুলোমনের গোপন বইটি টেবিলে রেখেই ঘুমিয়ে পড়ে। কৌতূহলবশত বীণা বেশ কয়েকটি চিঠি পড়ে।
বীণা কয়েকটি জিনিস খেয়াল করে। এক, মৃন্ময়ী যাকে চিঠি লিখছে তার নাম নেই। প্রাপককে জনাব বলেই সম্বোধন করা। দুই, অনেকগুলো চিঠিতে লেখা ছিল গতকাল, গত পরশু চিঠি পেয়েছি। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো সেরকম কারোই চিঠি সেখানে নেই। পুরো টেবিল খুঁজে দেখা হলো কিন্তু পোস্ট অফিস থেকে কোনো চিঠি আসেনি। তিন, চিঠি খামের উপর কোনো ঠিকানাও লেখা নেই। এক চিঠিতে মৃন্ময়ী লিখেছে,
জনাব,
আমার শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। না, তোমার দেওয়া (H2O) অক্সিজেনর সংকট নয়। সমাজের কালো ধোঁয়ায় আমাদের বেঁচে থাকা অনেক কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। না, কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইডও নয়। সমাজের তৈরি করা কালো ধোঁয়া। সমাজের তৈরি করা শৃঙ্খলে আমাদের গলায় ফাঁস লেগে গেছে। প্রকৃতি আমাদের মুক্তি দাও, নয়তো মৃত্যু দাও।
ইতি মৃন্ময়ী
বীণা এর অর্থ ভালো ভাবেই বুঝতে পেরেছে। এক, দরিদ্র পরিবারে তাদের জন্ম। দুই, মেয়ে হয়ে জন্মেছি। তাই শ্বাস প্রশ্বাসেও হিসেব করতে হয়। আর এই দরিদ্রের জন্যই তৈরি সমাজ শৃঙ্খল। সমাজের কালো ধোঁয়া অর্থাৎ কুসংস্কার, কূট প্রচারণা তাদের করেছে গৃহবন্দি। এখান থেকে মুক্তির চিন্তা ভাবাটাও অনেক দুরূহ ব্যাপার।
এইতো কিছুদিন আগে বীণা এবং মৃন্ময়ী বাড়ির বেলকনিতে বসে মনের সুখে গান গেয়েছিল।
‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা…’
এ ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি গান তারা গেয়েছে। রাতের বেলা খাওয়ার আগে মা কড়া ভাষায় বলেন, তোমরা আর কখনো বেলকনিতে বসে গান গাইবে না। আর বেলকনিতে যাবেও না। তোমাদের চার দেয়ালের মাঝেই থাকতে হবে।
মৃন্ময়ী এবং বীণা জানে কেউ হয়ত মাকে নালিশ দিয়েছে। কে দিতে পারে। সমাজের কেউ হবে। সমাজ সব সময় ভালো কিছু চায়। ভালো ফল চায়। অর্থাৎ সুশীল সমাজ হতে চায়। সুশীল সমাজ মানে কী? ফুল ছাড়া কেউতো ফল হতে পারে না। ফুটন্ত ফুলকে নিজের বলে সবাই দাবি করে। সৌন্দর্য ও সৌরভ হারিয়ে গেলে ফুলগুলো আবর্জনা হয় মাত্র। সে ফুলগুলোর নিজ মনের কাছে চিঠি লেখা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। কারণ বোবা ও কালা মানুষের কথা কেউ বোঝে না।
মৃন্ময়ীর শেষ রাতে লেখা চিঠিতে ছিল,
জনাব,
ঘন কালো মেঘ বা সাদা মেঘকে বলব,
আমাকেও সাথে নাও
আমিও মুক্ত নীল আকাশে উড়তে চাই,
লোহার শৃঙ্খলটাকে দিতে চাই বিদায়।
ইতি মৃন্ময়ী
লেখক: গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
আরএ/