বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শন ও আজকের বাস্তবতা
অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় সাম্প্রতিক সময়ে দেশ ভরে গেছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিকে। টানা তৃতীয় মেয়াদে দেশ শাসন করছে আওয়ামী লীগ। সব ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রদর্শন, চিন্তা, স্বপ্ন বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে। তবে হচ্ছে কতটুকু সেটা বিচার্য বটে। সে বিচার সময় করবে। তবে ক্ষমতাসীন দল দীর্ঘদিন ধরে সে চেষ্টা যে প্রাণপণ করে আসছেন— তা কারও অজানা নয়।
রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, বাস্তবায়নের পাশাপাশি শিক্ষাক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রদর্শন-চিন্তা-চেতনার বাস্তবায়ন কতটা করতে পেরেছে সরকারে থাকা তার প্রিয় রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ? এর আগে আমরা জানব সমগ্র রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বঙ্গবন্ধু কি ভেবেছিলেন। আমরা কি ভাবছি, তিনি কি করার চেষ্টা করেছিলেন, আর আমরা কি করছি?
বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শনের মূল বৈশিষ্ট্য ছিল একমুখী, সার্বজনীন ও অবৈতনিক। ১৯৭১-১৯৭৫ সালে শিক্ষা নিয়ে এই স্বপ্নের কথা তিনি বহুবার বলেছেন। বাস্তবায়নও শুরু করেছিলেন কিন্তু ১৫ আগস্টের পর সেই প্রক্রিয়া মাঝপথে থমকে যায়। আপাত দৃষ্টিতে বলা যায় খুব সরল এই নীতি। একমুখী, সার্বজনীন, ও অবৈতনিক ধারার কিছুটা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া একসময় চলমান থাকলেও এখন একদমই নেই। গত ৩ নভেম্বর ইউনিসেফের এক বাৎসরিক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে— দেশে সব ধরনের শিক্ষায় শতকরা ৭১ ভাগ ব্যয় বহন করছে শিক্ষার্থীর পরিবার। ইউনিসেফ আরও বলছে বিশ্বশিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বহুমাত্রিক বৈষম্য রয়েছে বাংলাদেশে। বলা হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে এই বৈষম্য আকাশচুম্বী। এমপিও ক্ষেত্রে অসম বণ্টন, অব্যবস্থাপনা মিলিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলায় এগিয়ে বাংলাদেশ। শিক্ষা এদেশে একমুখীর বদলে বহুমুখী। নেই সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। সবার জন্য শিক্ষার প্রশ্নটা এখন বিতর্কিত। সবাই সমতাভিত্তিক সুযোগ পায় না। সুযোগের অসম বণ্টন ব্যবস্থা বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য। ইউনির্ভাসিটি গ্রান্ড কমিশনের বরাত দিয়ে প্রথম আলো দেশে শিক্ষার্থীপ্রতি খরচের একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরে সেখানে দেখানো হয় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জনপ্রতি খরচের সর্বশেষ তথ্য।
দেখানো হয় জনপ্রতি সবচেয়ে বেশি অর্থব্যয় করে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনির্ভাসিটি’— যেখানে ছাত্রপ্রতি ব্যয় ৭,৫২,৬৯৭ টাকা, দ্বিতীয় অবস্থানে আছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সেখানে ছাত্রপ্রতি ব্যয় ৩,৯৪,৬৬৩ টাকা, তৃতীয় অবস্থানে আছে এককালের প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্বদ্যালয় যেখানে ছাত্রপ্রতি ব্যয় ২,১২,০০০ টাকা, ৪র্থ অবস্থানে আছে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সেখানে তাদের ব্যয় ১,৯২,৭৫৪ টাকা, পঞ্চম স্থানে থাকা বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ব্যয় করে ৩৫,৩,৯৪ টাকা। এই পরিসংখ্যান পড়ে আপনি অবাক না হলেও এর পরের তথ্যে আপনি অবাক না হয়ে পারবেন না আর সেই অবাক করা তথ্যটি হলো— উচ্চ শিক্ষায় অবদান রাখে এমন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শিক্ষার্থী তুলনায় দেশের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য মাথাপিছু খরচ হলো এক হাজার একশো একান্ন টাকা, যা কিনা উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ১৭৮৬ টাকা থেকেও কম। এই যে জনগণের টাকা রাষ্ট্রযন্ত্র ইচ্ছামাফিক খরচ করে শিক্ষাক্ষেত্রে পাহাড়সম বৈষম্য তৈরি করে এর কি আদৌ কোনো উদ্দেশ্য আছে নাকি পরিকল্পনাহীন স্বেচ্ছাচারিতার দৃষ্টান্ন। অথচ স্বাধীন বাংলাদেশে প্রণীত সব শিক্ষানীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল বৈষম্যহীন সর্বজনীন কিন্তু হয়েছে উল্টো। রমরমা বাণিজ্যের উর্বর বেসাতি চলে এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
আপনি দেখাবেন মাছ, খাওয়াবেন ডাল, এমন প্রবণতা পরিকল্পনায় যতদিন থাকবে ততদিন এই বৈষম্য টিকে থাকবে বাংলাদেশে। সামগ্রিকভাবে শিক্ষাব্যবস্থাপনার নামে নতুন প্রকল্প অনুমোদন, লুটপাট, আর বায়তুলমাল তসরুফের মহোৎসব চলে। অবৈতনিক প্রশ্নে রয়েছে নানা মত। নারী শিক্ষা প্রসারে এই তত্ত্ব নারীদের জন্য অনুকূল থাকলেও পুরুষ শিক্ষার্থীর জন্য হলো শাপেবর। সংক্ষেপে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের বয়স ৫০ পেরিয়ে গেলেও সেই স্বপ্ন থেকে ক্ষমতাসীনরা আছে কয়েক আলোকবর্ষ দূরে।
বঙ্গবন্ধু শিক্ষাকে সবসময় রাজনীতিমুক্ত করার কথা ভাবতেন। ১৯৭২ সালের ২৫ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবীদের এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেন, দেশে যাতে অশিক্ষা দূর হয় সাধারণ মানুষ যাতে শিক্ষা পেতে পারে এবং সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষায় সুযোগ-সুবিধা হয় সেদিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। শিক্ষা গণমুখী হওয়া প্রয়োজন। সেটাই আমি বিশ্বাস করি। গণমুখী শিক্ষা করতে গেলে প্লান প্রোগ্রাম অনুযায়ী হওয়া প্রয়োজন। এজন্যই কমিশন করা হয়েছে। আপনারা কমিশনের মধ্যে দেখতে পাইতেছেন যে এখানে কোনো দলমত নেই। যারা উপযুক্ত তাদের আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর নিযুক্ত করিতেছি। কে আমার বন্ধু, কে আমার ভাই, যার সম্পর্কে কোনো কোয়েশ্চন নাই তাদেরকে আমরা যোগ্যস্থানে বসাবার চেষ্টা করিতেছি, যাতে তারা পরিবর্তন আনতে পারেন। সব জায়গাতেই রাজনীতি আছে, অন্তত শিক্ষার মধ্যে আমি রাজনীতি আনতে চাই না। এই সেক্টরে রাজনীতি না হওয়া বাঞ্ছনীয়’।
কুদরত এ খোদা শিক্ষা কমিশনেও এ কথা ছিল। তিনি শিক্ষাঙ্গনকে রাজনীতি মুক্ত করার পক্ষপাতি ছিলেন। আমরা আছি যুক্ত রাখার পক্ষে। প্রায় ২০০০ বছর আগে গ্রীক দার্শনিকরা রাজনীতি ধর্ম ও শিক্ষাকে আলাদা করার জোর দাবি করেছিলেন এজন্য যে এই তিনটি বিষয় একসঙ্গে থাকলে কোনোটাই ভালো না থাকার সম্ভাবনা থেকে যায়। এই তিনটি স্বতন্ত্র বিষয়কে আলাদা রাখাটার চেষ্টাই করেছিলেন বঙ্গবন্ধু, যেখানে তার রাজনৈতিক দূরদর্শীতার পরিচয় পাওয়া যায়। গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে রাজনৈতিক বিবেচনায় যেভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অদক্ষ, অযোগ্য, ভূইফোঁড় আর জাল শিক্ষকদের তুলে এনে জাতিকে টেনে তোলার স্বপ্ন দেখেছেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিকেরা, তাতে জাতির মেরুদণ্ড অনেকটাই ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। এটা ভাবার বিষয় যে এমনটা চলতে থাকলে এ জাতির গন্তব্য আগামীতে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে।
স্থানীয় রাজনীতিতে যে যেখানে সঠিক মাত্রায় প্রয়োজন অনুপাতে তৈল মর্দন করতে পেরেছেন তিনি সেখানেই টিকে গেছেন মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে। যাদের নিজেদের গড়ে তোলার দায়িত্বটা প্রশ্নবিদ্ধ তারা কীভাবে জাতিকে গড়ে তুলবেন সেটা ভাবার অবকাশ রাখে বৈকি। দেশ, জাতি গড়ার অযোগ্য কারিগরদের দিয়ে এই প্রবণতার কারণে দেশের সেটাই হয়েছে— ছাগল দিয়ে হালচাষ করলে গৃহস্থোর যেটা হয়। এ প্রসঙ্গে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর একটা কথা বেশ প্রণিধানযোগ্য। বড় আক্ষেপের সুরে তিনি বলেছিলেন, ‘আপনি সময়মত তৈল মর্দন করতে জানলে আপনার যোগ্যতা না থাকলেও আপনি প্রফেসর হইতে পারবেন’। বিগত ২ দশকে শিক্ষাকে রাজনীতিকরণ করে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেটাই হয়েছে। দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এক বিরাট অংশে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিকরা এমন প্রফেসর বানাইছেন হাজারে হাজার। বঙ্গবন্ধু যা নিজে চাননি তার অনুসারীরা সেটা কীভাবে চায় সেটা বোধগম্য নয়। কীভাবে তারা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনকে খাটো করার ধৃষ্টতা দেখায়। রাজনৈতিক বিবেচনায় এমন শিক্ষকদের নিয়োগের ফলে শিক্ষাখাতে পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। সীমাহীন রাজনীতিকরণ ও দলীয়করণের প্রভাবের দরুণ মেধাবীরা আগ্রহ হারিয়েছে এই পেশার প্রতি। ক্রমান্বয়ে সেটা দখল করেছে একশ্রেণির চাটুকর, পদলেহী, ভূইফোঁড় রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা।
শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেতা-কর্মীদের নিয়োগ দিয়েই সরকার বসে থাকেনি, পরিচালনা পরিষদেও রেখেছেন অপেক্ষাকৃত অশিক্ষিত দলীয় অনুগতদের। ফলে স্থানীয় শিক্ষা প্রশাসনে শিক্ষায় পরিবর্তনের বদলে তারা নিজেরাই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। পরিচালনা পরিষদের সভাপতির যোগ্যতা নিয়ে সরকার সংস্কারের নামে কালক্ষেপণ করে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। উল্টো আগের সিদ্ধান্তই বহাল রেখেছে। সব মিলিয়ে স্থানীয় চেয়াম্যান, মেম্বার, ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা ঢুকে গেছে স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। সভাপতির যোগ্যতা শিথিল করার প্রত্যক্ষ মানে হলো স্থানীয় প্রতিষ্ঠানে ক্ষমতাসীনদের রাজনীতি ও মাতবরীকে প্রতিষ্ঠা করা।
শিক্ষাব্যবস্থার কোথাও বঙ্গবন্ধু রাজনীতি চাননি। আজ বঙ্গবন্ধুর শিক্ষানীতির মূল বক্তব্যের কোনোটাই বাস্তবায়িত হয়নি, উল্টো সকলক্ষেত্রে উপেক্ষা করা হয়েছে। এটা আওয়ামী লীগের আদর্শের রাজনীতির স্ববিরোধীতা নাকি চরম রাজনৈতিক মূর্খতার বহিঃপ্রকাশ সে বিচার সময়ই করবে।
২০২৩ সালের নতুন কারিকুলামের শিক্ষা সংস্কার প্রস্তাবেও নেই এর ছিটেফোঁটা। সেটা কি আদৌ হবে, নাকি জাতির পিতার অকাল প্রয়াণের সঙ্গে সঙ্গে আমরাও সরে আসব তার আদর্শ থেকে। লেখক পাঠক হিসেবে আমাদের বাড়বে শুধু অপেক্ষা।
লেখক: গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষা গবেষক, অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার—সেকেন্ডারি এডুকেশন ডেভলপমেন্ট প্রোগ্রাম, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র বাংলামোটর, ঢাকা।
আরএ/