বিশ্ব ফার্মেসি দিবস ও ফার্মাসিস্টদের অদেখা দুঃখ
চামড়া শিল্পের দৈন্যদশা, চিনিকল বন্ধের হিড়িক,পাটের সোনালি আঁশ যখন নিজেকে মেলে ধরার বাহন খুঁজে পাচ্ছে না, ঠিক তখন ওষুধ শিল্প যেন এক সোনার হরিণ।
যেখানে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ চাহিদার মাত্র ২০ শতাংশ ওষুধ উৎপাদনে সক্ষম ছিল। বাকি ৮০ শতাংশ ছিল আমদানিনির্ভর। সেখানে বর্তমানে ওষুধের মোট চাহিদার প্রায় ৯৮ শতাংশই স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করে নিজেদের চাহিদা মিটিয়েও পৃথিবীর ১৫৭টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করছে বাংলাদেশ।
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ওষুধ রপ্তানি করা হয় ৬৪৬ কোটি ৯৮ লাখ ৫৩ হাজার টাকার। মাত্র ছয় বছরের ব্যবধানে অর্থাৎ ২০২০-২১ অর্থবছরে এসে ওষুধ রপ্তানির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ছয় হাজার ৫৭৫ কোটি ৮৬ লাখ টাকায়। বিষয়টিকে ‘ওষুধ রপ্তানিতে বাংলাদেশের বাজিমাত’ হিসেবে উল্লেখ করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কিন্তু কেমন আছেন দিন রাত পরিশ্রম করে ওষুধ শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ফার্মাসিস্টরা!
করোনাকালীন দুর্যোগে মৃত্যুর মিছিলকে ভয় না করে দেশের মানুষের জন্য লড়াই করে যাওয়া ফার্মাসিস্টরা পায়নি করোনা যোদ্ধার তকমা, মহামারির সেই সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও এক মুহূর্তও ছুটি ছিল না যে র্মাসিস্টদের,অনেকের প্রণোদনা জুটলেও দেশের দুঃসময়ে শক্ত হাতে বৈঠা ধরা ফার্মাসিস্টদের ভাগ্যে জুটেনি কোনো করোনা প্রণোদনাও।
সব মিলিয়ে দেশের ঔষধ শিল্পের মূল চালিকা শক্তি ফার্মাসিস্টদের যেন দেখার কেউ নেই, অনেকটা অসহায়ভাবেই দিন যাপন করতে হচ্ছে তাদের।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশ যখন ফার্মাসিস্টদের কাজের জায়গা সমাদৃত করে নিজেদের স্বাস্থ্য খাত কে সমৃদ্ধ করছে ঠিক তখনো বাংলাদেশে ওষুধ শিল্পের মূল চালিকাশক্তি এ ফার্মাসিস্টদের দৌড়ের দুয়ার যেন সংকোচিতই হয়ে আসছে।
যার ভয়াবহ প্রভাবের একটি চিত্র উঠে এসেছে বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদন, বিবিসির সেই প্রতিবেদনে বাংলাদেশে ফার্মেসিগুলোতে ৯৩ শতাংশ মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি ও নকল ওষুধ তৈরির কারখানার খোঁজ পাওয়া যায়ল ,এই ভয়াবহ তথ্য সামনে আসার পর হাইকোর্ট এক মাসের মধ্যে মেয়াদ উত্তীর্ণ সমস্ত ওষুধ ধ্বংস করার নির্দেশনা দিলেন। সাম্প্রতিক জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযানে একের পর এক প্রসিদ্ধ ফার্মেসিতেও মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি ধরা পড়ায়, হতাশা প্রকাশ করেছেন সমাজ বিশ্লেষকরা।
এখনো ওষুধ সম্পর্কে মানুষের এই অসচেতনতার পেছনে,সরকারি হাসপাতালগুলোতে ফার্মাসিস্ট নিয়োগের অনুপস্থিতি, মডেল ফার্মেসিগুলোতে সাধারণ মানুষকে ওষুধ সম্পর্কে সম্মক ধারণা দিতে ফার্মাসিস্ট নিয়োগ বাধ্যতামূলক না করা, দেশের স্বাস্থ্য খাত নিয়ে কাজ করা প্রসিদ্ধ এনজিওগুলোর ফার্মাসিস্টদের সঙ্গে সমন্বয় না থাকাকে দায়ী করেন সিনিয়র ফার্মাসিস্টরা।
যার ফলে আমাদের দেশে ওষুধ শিল্প এগিয়ে গেলেও, স্বাস্থ্যখাত বিশ্বায়নের দিকে এগিয়ে যেতে পারছে না, এখনো পারছে না এই ভঙ্গুর অবস্থান থেকে বের হতে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশ যেমন করে ডাক্তার, ফার্মাসিস্টসহ অন্যসব স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়ে, নিজেদের স্বাস্থ্য খাতকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, ঠিক তেমনি এই সম্ভাবনার বাংলাদেশেও সকলের সমন্বয়ে, সমন্বিত উদ্যোগেই পারে জনদুর্ভোগ কমিয়ে, স্বাস্থ্য খাতকে বিশ্বায়নের অভিযাত্রায় অভিযাত্রী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতে।
বিশ্ব ফার্মেসি দিবসে ফার্মাসিস্টদের জনসম্পৃক্ত দাবী পূরণ হবে,বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ ওষুধ সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাবে, জনসাধারণের সচেতনতা ও সকলের যৌথ প্রচেষ্টায় ওষুধের অপব্যবহার এবং মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রির মতো জঘন্য অপরাধ প্রবণতাকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনবে সেটিই প্রত্যাশা।
লেখক: সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ ফার্মাসিস্ট ফোরাম, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়