‘পথিক! তুমি পথ হারাইয়াছ’ ও বিএনপির নেতৃত্ব সংকট
বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও অতীত ইতিহাস পর্যালোচনায় বিএনপি সামরিক শাসকের হাত ধরে উঠে আসা রাজনৈতিক দল, আওয়ামী লীগ কিংবা অন্যান্য সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আদর্শগত বা গণআন্দোলনের বিবেচনায় বিএনপি পিছিয়ে থাকলেও ক্ষমতার রাজনীতিতে বিএনপি বাংলাদেশের বৃহৎ একটি স্থান দখল করে নিয়েছে। পঁচাত্তর পরবর্তী ভিন্ন প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বিপরীতে একটি প্ল্যাটফর্ম দাঁড় করানো এবং নিজের সামরিক ক্ষমতাকে বৈধতা দেয়ার জন্য সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান রাজনৈতিক দল গঠন করেন যা অনেকটা ঘুষের টাকায় হালাল মাংস খাওয়ার অবস্থা। ১৮/১৯ দফা, জাগদল ও অন্যান্য প্রক্রিয়ায় যে আওয়ামী বিরোধী রাজনৈতিক পাটাতন দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন তা-ই আজকের বিএনপি। যা ১৯৭৮ সালে আত্মপ্রকাশ করে এবং ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। A Legacy of blood বইতে Anthony Mascarenhas লিখেছেন সে সময় বিএনপির যে ৩০০ জন প্রার্থী ছিল এর মধ্যে ২৫০ জন ছিল দালাল শ্রেণির। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান যখন এক পর্যায়ে চিন্তা করলেন সামরিক শাসকের লেবাস ছেড়ে একটা তথাকথিত গণতান্ত্রিক উর্দি পড়বেন। তার জন্য রাজনৈতিক দল গঠন করা প্রয়োজন তখন তিনি সমগ্র দেশ থেকে দলছুট, সুবিধাবাদী, আমলা, সামরিক অফিসার, মুসলিম লীগার সহ নানান অরাজনৈতিক শ্রেণি নিয়ে বিএনপি গঠন করলেন।
রাজনৈতিক নেতৃত্ব বলতে যা বোঝায় বিএনপিতে তখনো ছিল না এখনকার পরিস্থিতি তো ওহি নির্ভর। বিএনপিতে সময় সময় দলছুট সুবিধাবাদী রাজনীতিক ব্যক্তির সংখ্যা বেশি হওয়ায় নীতি-আদর্শহীন দলে পরিণত হয়েছে বৃহৎ এ দলটি। সাংগঠনিক দুর্বলতা, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, সুবিধাবাদ, সময়োপযোগী সঠিক রাজনৈতিক কৌশল ও সিদ্ধান্তের অভাবে দলের আজ ‘পথিক! তুমি পথ হারাইয়াছ?’ দশা। রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতা, দলের সিনিয়র নেতাদের কাছে জুনিয়র তারেক জিয়াই দল কে আরো বেশামাল করে তুলেছেন।
তারেক জিয়া দলের নেতৃত্বে আসার পর থেকেই বিএনপি পথ হারা, না আছে আন্দোলনে না আছে রাজপথে। ১/১১ পর আর রাজনীতি করবেন না এ মর্মে মুচলেকা দিয়ে লন্ডনে চলে যান। দেশের রাজনীতির রূপ স্কাইপের মাধ্যমে যা জানেন দেশের পুরো চিত্র তা দিয়ে মাপা যায় না। তাই এভাবে দল চালানোও সম্ভব নয়। সম্প্রতি বিএনপি'র স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন ২০১৮ সালের নির্বাচনে গণফোরাম প্রধান ড. কামাল হোসেন কে ইমাম মেনে বিএনপি’র সব চিন্তা ভাবনা ধুলিস্যাৎ হয়ে গেছে। বিএনপি’র রাজনীতি যে চরম নেতৃত্ব সংকটে ভুগছে নেতাদের এমন মন্তব্য থেকে তা সুস্পষ্ট। বিএনপি এখনো জানে না আগামীতে কে দলের হাল ধরবে ক্ষমতায় গেলে কে হবেন প্রধান মন্ত্রী। কারণ এখনো বিএনপি হাওয়া ভবনের গোলক ধাঁধা থেকে বের হতে পারেনি।
২০০১-০৬ মেয়াদে তারেক জিয়ার হাওয়া ভবন বিএনপির জন্য আজও ভয়ংকর অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ২০১৫ সালের লাগাতার ৯২ দিনের অবরোধের নামে জামায়াত-বিএনপির ক্যাডারবাহিনীর জ্বালাও-পোড়াও কর্মকাণ্ড। যা ক্রমাগতভাবে বিএনপিকে নাজুক করে দিয়েছে। ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান মামলা ও জার্মানির সিমেন্স কোম্পানি থেকে ঘুষ নেওয়ার মামলায় যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ডিত হয়ে তারেক রহমান ফেরারি আসামি হয়ে লন্ডনে পলাতক আছেন। এই ফেরারি আসামি দিয়েই দল চালাতে হচ্ছে বিএনপিকে। বিএনপির নেতৃত্বে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাড়ায়, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায়। ২০০৮ সালে রমনা থানায় মামলাটি করে দুর্নীতি দমন কমিশন। মামলার ৬৩২ পৃষ্ঠার রায়ে আদালত খালেদা জিয়াকে ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডাদেশ, তারেক রহমানসহ অন্যান্য আসামীদের ১০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ হয়। তারেক রহমানসহ বাকি ৫ আসামির ২ কোটি ১০ লাখ টাকা করে জরিমানা হয়।
বাংলাদেশে প্রথম কোনো দলের চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান এতিমের অর্থ আত্নসাৎ মামলায় কারাদণ্ড ভোগ করেন। যার ফলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া কারাবাস ও বন্দী জীবন-যাপন করছেন। খালেদা জিয়ার কারাবরণের ফলে বিএনপির শীর্ষ পদে আসীন হয়েছেন তারেক জিয়া যিনি নিজেও দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। বাংলাদেশ সংবিধানের ৬৬ (ঘ) অনুচ্ছেদ অনুসারে কোনো ব্যক্তি নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে দোষী সাব্যস্ত ও অন্যুন দুই বছর দণ্ডিত হওয়া এবং মুক্তিলাভের পর পাঁচ বছর অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। এর মধ্যদিয়ে বিএনপির রাজনীতি ও নেতৃত্ব দুটোই প্রহেলিকায় পরিণত হয়েছে। কোথায় আছে আন্দোলন, আর কোথায় আছে সংগঠন বিএনপির নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক অনিশ্চয়তা তাদেরকে অতীতের নীলনদে বারবার হাবুডুবু খাওয়াচ্ছে। কিন্তু কেন? বিএনপির মত জনপ্রিয় দল আজকে নেতৃত্বের যায়গা শূন্য বা ফেরারি আসামি কেন? মোটাদাগে যে কেউ উত্তর দেবে তারেক জিয়ার অপরাজনীতি আর হাওয়া ভবন। খালেদা জিয়া মঞ্চের পেছনে চলে যাওয়ায় এবং তারেক জিয়ার সামনে আসায় দলটি আরও পিছিয়ে গেছে। সব কিছুতে তারেকের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তের কারণে ঐক্য বিনষ্ট হয়েছে। তারেক জিয়া দুর্নীতিগ্রস্থ এবং সন্ত্রাসী হিসেবে দেশে-বিদেশে যে ইমেজ দাঁড়িয়েছে তাতে তিনি নেতৃত্বে থাকলে দলটি আগামীতে আদৌ ক্ষমতায় আসতে পারবে কি না সেই হতাশাও দেখা দিয়েছে দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে।
বাস্তবে বিএনপিতে রাজনীতি কোথায়! তীব্র প্রতিবাদ, নিন্দা জ্ঞাপন ও কঠোর আন্দোলনের হুমকি ছাড়া আজ তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি ওহীর উপর আটকে আছে। তারেক জিয়ার রাজনৈতিক মৃত্যু ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তিনি গ্রেনেড হামলার যে পাপাচারে লিপ্ত হয়েছিলেন তার মধ্যে নির্ধারিত হয়ে গেছে। সে ঘটনায় মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন হলেও দেশের সিংহভাগ মানুষ মনে করেন ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা তারেকের একক প্রচেষ্টার ফল। অন্যরা সহযোগী মাত্র। বহির্বিশ্বের আদালতও এখন (কানাডা) বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলে ঘোষণা করেছে।
তারেককে সন্ত্রাসী আখ্যায়িত করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো বহু আগেই প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে। পাকিস্তান ও কাশ্মিরের কিছু আন্তর্জাতিক দুনিয়া কর্তৃক স্বীকৃত সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে বিএনপির তখনকার জ্যেষ্ঠ যুগ্ম-মহাসচিব তারেক জিয়ার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বিদ্যমান ছিল। তারাই ২১ আগস্টের জন্য পাকিস্তানে তৈরি আর্জেস গ্রেনেড সরবরাহ করেছিল বলে প্রমাণিত হয়েছে।
দেশের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী সংগঠন হরকাতুল জিহাদ (হুজি), জেএমবি, জামায়াতে ইসলামিসহ বহু ক্ষুদ্র বৃহৎ সংগঠনের সঙ্গেও তারেক জিয়া এবং বিএনপির যোগাযোগ ছিল। তারেক জিয়া ছাত্রশিবির এবং ছাত্রদলকে এক মায়ের সন্তান বলে অবহিত করেছিলেন।
সুতরাং বিএনপির প্রয়োজনে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে তারেক জিয়ার পরিবর্তন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। আগামীর রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার ফিরে আসার যেমন কোনো সুযোগ নেই তেমনি তারেক জিয়া যদি বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বে না থাকেন তার পরিবর্তে নেতা কে? এই প্রশ্নেরও সমাধান নেই পরিবার কেন্দ্রিক রাজনৈতিক দলটিতে। প্রশ্নগুলোর উত্তর যতদিন মিলছে না আওয়ামী লীগকেও মাঠ থেকে সরানো অসম্ভব। কারণ, আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনাকে সরালে জনগণের কাছে তার বিকল্প কী? সেই প্রশ্নের উত্তর জনগণের সামনে বিরোধী দলগুলোর হাজির করতে পারেনি। আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় দলের বয়স হবে ৪৫ বছর। দলের অস্তিত্বের জন্য যেমন, তেমনি বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক অধিকার সমুন্নত রাখার জন্যও আগামী নির্বাচনটি গুরুত্বপূর্ণ। সেদিক থেকে এটি হবে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়ার জন্য বড় পরীক্ষা। এরচেয়ে বেশি বর্তমান সিনিয়র নেতাদের জন্য। আসন্ন নির্বাচনে জ্যেষ্ঠ নেতাদের রাজনৈতিক জীবনের শেষ পরীক্ষা বৈকি।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক (manaser_jnu@yahoo.com)