মানসিক-পারিবারিক ভারসাম্যহীনতার মূলে মাদকাসক্তি
মাদকাসক্তি নামক ভয়ংকর শব্দটি বর্তমানে আমাদের যুবসমাজ ধ্বংসের অন্যতম প্রধান কারণ। জীবনের হতাশা, ব্যর্থতা, বিষাদ, কৌতূহল এসব থেকেই নেশা গ্রহণের সূত্রপাত ঘটে এবং জীবনের অস্থিরতা, নৈতিক মূল্যবোধের অভাব, সঙ্গদোষ, কালো টাকার উত্তাপ ও ব্যয়ের অপরিচ্ছন্ন পন্থা যুবসমাজের বিভ্রান্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। মাদকদ্রব্য গ্রহণের আসক্তি সুপ্রাচীন কাল থেকে প্রচলিত থেকে যুগে যুগে সমস্যার সৃষ্টি করছে।
এক সময় চীন দেশের লোকজন আফিম খেয়ে নেশাগ্রস্ত হতো। সম্প্রতিককালে মাসদকের প্রভাব বহুলোকের জীবনে ধ্বংস নেমে এসেছে, শুরু হয়েছে এক ভয়াবহ অবক্ষয়ের। মাদকে বিভিন্ন রকম দৈহিক প্রতিক্রিয়া শুরু হয় এবং দেহের অক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। মাদকাসক্তির ফলে মানসিক ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন চেতনানাশক মাদকদ্রব্য ব্যবহারের ফলে মানসিক আচ্ছন্নতা দেহের মাংসপেশির কম্পন ও মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
মানুষ অনেক সময় আনন্দ লাভের সহজ উপায় হিসেবে মাদকের প্রতি ঝুঁকে পড়ে এবং ধীরে ধীরে মাদকাসক্ত হয়ে যায়। আমাদের দেশে মাদকাসক্তি সমস্যা ক্রমাগতভাবে মানুষের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি করছে। নেশা গ্রহণের ফলে ব্যাক্তির মধ্যে অস্বাভাবিকতা, বিচারবুদ্ধিহীনতা ও পাশবিকতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আসক্ত ব্যাক্তির মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির ফলে সমাজে অপরাধ ও অনাচার বেড়ে যাচ্ছে।
মাদকের প্রভাবে ব্যাক্তিজীবনে নানা ব্যর্থতার সম্মুখীন হতে হয়। সারা বিশ্ব জুড়ে মাদকাসক্তি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক উন্নত দেশে মাদকাসক্তির ব্যাপকতা জাতির জন্য আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠেছে। এই সর্বনাশা নেশা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। মাদকদ্রব্যের প্রসারের ফলে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। নেশাগ্রস্তদের নৈতিক মূল্যবোধের অভাবের কারণেই তারা অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হচ্ছে। মাদকদ্রব্যের দাম বেশি হওয়ায় নেশাগ্রস্তরা অবৈধ ভাবে অর্থ উপার্জনে বেশি আগ্রহী হচ্ছে।
উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর ন্যায় বাংলাদেশেও মাদকদ্রব্যের ব্যবহার আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। বাংলাদেশে কি পরিমাণ মাদকদ্রব্যের ব্যবহার করা হয় এবং কত লোক মাদকাসক্ত তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে এদেশে মোট জনসংখ্যার ১৭ ভাগ মাদকদ্রব্য ব্যবহার করে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। দেশে ৩৫০ টির ও বেশি বৈধ গাজার দোকান আছে।
বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১৫ লক্ষের মতো মাদক সেবনকারী রয়েছে এবং দিন দিন এর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন পেশাজীবী, শ্রমজীবী থেকে শুরু করে স্কুল -কলেজের ছাত্র -ছাত্রীরাও নেশায় আক্রান্ত হচ্ছে। সাময়িক জীবনের প্রতি বিমুখতা ও নেতিবাচক মনোভাব থেকেই মাদকাসক্তির জন্ম। অভ্যাস থেকে আসক্তি। হেরোইন আসক্তিতে ধনতান্ত্রিক সমাজে ও অর্থনীতিতে ব্যাক্তির ভোগের উপকরণ অবাধ ও প্রচুর। বর্তমানে সিনেমা ও টেলিভিশনে যেসব অশ্লীল নৃত্য, ছবি, কাহিনী ইত্যাদি দেখানো হচ্ছে সেসব অনুকরণ করতে গিয়ে তরুণ সমাজ তাদের নৈতিক অধঃপতন ডেকে আনছে।
এছাড়া অনেকসময় অস্থিরতা, কুচিন্তা, অভাব অনটন, পারবারিক কলহের কারণে তরুণ সমাজ এই মোহের জালে আচ্ছন্ন হয়। মাদকাসক্তির ব্যাক্তিগত দিক ছাড়াও এর আরও একটি ব্যবসায়িক দিক আছে যা বিশাল অপরাধ জগতের সঙ্গে জড়িত। মাদকদ্রব্য সাধারণত পাকিস্তান ও ভারত থেকে পাচার হয়ে যায় পশ্চিম ইউরোপে। মাদকের ভয়াবহ বিস্তার গোটাবিশ্বের জন্য আজ উদ্বেগজনক।
মাদক যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ জীবনে এক নম্বর সমস্যা। প্রায় ৪ কোটি আমেরিকান নর-নারী কোকেন সেবন করে, কমপক্ষে ২ কোটি মারিজুয়ানা সেবন করে। গোটা বিশ্বে দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে মাদক। মাদকের খপ্পরে পড়ে নেশাগ্রস্ত দিকভ্রান্ত আমাদের সমাজ। একজন তরুণের স্বপ্নভরা কৈশোরের ইতিবাচক বিশ্বাসগুলো ভাঙছে দিনরাত তার পাশে অরাজকতা বৈষম্য -শোষণ।
বর্তমানে তরুণরা আস্থা হারাচ্ছে জীবনে, প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় বিশ্বাস থাকছে না, আর্থিক কাঠামো এমনকি ধর্মীয় বিশ্বাসের ও শ্রদ্ধা নেই। ব্যবসায়িক স্বার্থে হেরোইন আসছে নানা পথে এবং নানা মাধ্যমে ব্যবহার করে স্বপ্নভাঙা মেরুদণ্ডহীন যুব সমাজ। মধ্যবিত্ত ও সচেতন সমাজই নেশার শিকার, এদের স্বপ্ন ও প্রাপ্তির মধ্যে আসমান জমিন তফাত। পরিণতি, উর্বরা মেধার অপমৃত্যু, উজ্জ্বল পরমায়ুর অবক্ষয়। প্রায় ক্ষেত্রে হতাশা ও দুঃখবোধ থেকে সাময়িক শান্তিলাভের আশা থেকেই এই মারাত্মক নেশা ক্রমবিস্তার লাভ করছে।
পাশাপাশি এ কথা ও সত্য যে, অনেক দেশে বিপথগামী মানুষ ও বহুজাতিক সংস্থা অর্থলালসায় বেছে নিয়েছে মাদক ব্যবসায়ের পথ। এর সঙ্গে সম্পৃক্ত আছে বিভিন্ন দেশের মাফিয়া চক্র। মাদকের ঐ কারবারিরা সারা বিশ্বে তাদের ব্যবসায়িক ও হীনস্বার্থ রক্ষায় এই নেশা পরিকল্পিতভাবে ছড়িয়ে দিচ্ছে। বিশ্বজুড়ে যে মাদকবিষ ছড়িয়ে পড়েছে তার থাবা থেকে মানুষকে বাঁচাতে হবে। বেতার, টিভি, সংবাদপত্রে মাদকের কুফল নিয়ে আরও বেশি সর্তকতাস্বরূপ প্রচারণা চালানো প্রয়োজন।
মাদকের থাবা থেকে মানুষকে রক্ষা করতে হলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগকারী সংস্থা তথা সরকার। কেননা দেশে আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করা, অপরাধ প্রবণতা দমন ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠাই সরকারের প্রধান দায়িত্ব। মাদকাসক্তির ভয়াবহ পরিণাম থেকে বর্তমান সময় ও মানুষকে বাচাতে হলে এই ভয়াল ব্যাধির বিরুদ্ধে সমন্বিত প্রচেষ্টা চালাতে হবে। বেকারত্বের অভিশাপ মানুষকে মাদকাসক্ত করে। তরুণদের কর্মসংস্থান করলে তারা কর্মময় জীবনযাপন করবে। সবচেয়ে বড় কথা, মাদকাসক্তদের যেমন নিরাময়ের জন্য চিকিৎসা জরুরি তার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি মাদকব্যবসায়ীদের আইনানুকভাবে শাস্তি দেওয়া।
বাংলাদেশে কোনো মাদক ব্যবসায়ী বা চোরাকারবারীর উপযুক্ত শাস্তি হয়েছে এমন তথ্য আজ পর্যন্ত পাওয়া যায় নি। মাদকের ব্যবহার এখন জাতীয় সমস্যারুপেই বিবেচিত হচ্ছে। মুনাফালোভী ব্যবসায়ী, ক্ষমতালোভী, রাজনীতিবিদ, দুর্নীতিবাজ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা এরা প্রত্যেকেই এই ভয়াবহ অবস্থার জন্য দায়ী। সবাই মিলে সংগঠিতভাবে এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। শক্ত হাতে মাসকাসক্তির মতো অন্যতম অপরাধ দমন করতে সরকারকে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে এবং কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে তবেই বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে আরও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হবে।
লেখক: আবু সাঈদ
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
এএজেড