পুনর্মিলনীতে শিক্ষকদের সান্নিধ্য
সকাল সোয়া ৮টায় শামসুল আলম স্যারের ইংরেজির ক্লাসের কথা মনে পড়ে গেল। স্যার পড়াচ্ছেন ‘দি লাঞ্চন’; সঙ্গে থাকত প্রচুর রেফারেন্স। আবার, জিম-ডেলার গল্প; কখনো মনে পড়ে মহাবীর ইউলিসিস কবিতার কথা। এ স্মৃতি সব আজ অতীত! তবুও ভোলার নয়, এখনও জ্বল জ্বল করে।
আমি নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার বিলচলন শহীদ শামসুজ্জোহা সরকারি কলেজের প্রাক্তন ছাত্র, ২০০১ সালে বাণিজ্য বিভাগ থেকে এইচএসসি পাস করি। দীর্ঘ একুশ বছর পরে ১১ জুলাই বন্ধুদের সঙ্গে মিলনমেলায় মিলিত হয়েছি। করোনার বাস্তবতায় জুমে বন্ধুদের সঙ্গে মিটিং করে অনুষ্ঠানের দিনে সবার সঙ্গে দেখা হলো। এ এক অজানা প্রশান্তি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহা ছাত্রদের জীবন বাঁচাতে গিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে শহীদ হন। তাঁর স্মৃতির স্মরণে তৎকালীন নাটোরের গুরুদাসপুর থানা সদরে অবস্থিত কলেজটির নামকরণ করা হয়। কলেজের ২০০১ সালের এইচএসসি ব্যাচ 'সংশপ্তক জোহা-২০০১' নামে পরিচিতি লাভ করেছে।
সকালে কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকতেই দেখলাম বন্ধুরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তারা বিভিন্ন চায়ের দোকানে চা-চক্রে মেতেছে। আমিও তাদের সঙ্গে যুক্ত হলাম। কিন্তু, বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না আমার আড্ডা! উঠতেই হলো।
অবশ্য আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরা আমাদের আগেই কলেজ ক্যাম্পাসে এসে শুকুর আলীর চায়ের দোকানে চা পান করছেন। স্যারদের চা খাওয়ার পরে তাদের নিয়ে হল রুমে প্রবেশ করলাম। শিক্ষকমল্ডলীরাও আমাদের সঙ্গে আমাদের গেঞ্জি পরে নিলেন। যেন
আমরা সবাই এক মন, এক প্রাণ।
অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ছাত্র ও শিক্ষকমণ্ডলীর স্মৃতিচারণের পালা। শিক্ষকমণ্ডলী মঞ্চে আসন গ্রহণের পরে প্রথমেই আমাদের বন্ধুরা তাদের ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। তারপর তাদের ক্রেস্ট দিয়ে সম্মাননা জানানো হয়। পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করে বন্ধু রিপন আর গীতা থেকে পাঠ করে তাপস কুমার। আমাদের পক্ষে স্বাগত বক্তব্য দেন বন্ধু রাজীব ও ফজলুল হক। আর, সমাপনী বক্তব্য রাখে সজল মাহমুদ।
বন্ধুদের স্মৃতিচারণের পরে শুরু হয় শিক্ষকদের স্মৃতিচারণ পর্ব। প্রথমেই স্মৃতিচারণ করেন ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক মো. শামসুল আলম স্যার। তার নাতিদীর্ঘ বক্তব্য থেকে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের বেশ কিছু বাস্তবতা ফুটে উঠেছে। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অধ্যাপক মো. শামসুল আলম স্যার তার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির কথা তুলে ধরেন। মুক্তিযোদ্ধা এ শিক্ষক তরুণ প্রজন্মের প্রতি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পাঠের আহ্বান জানান।
আমি ও আমার বন্ধু ফেরদৌসি আক্তার কনার সঞ্চালনায় সংবর্ধনা ও সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে স্মৃতিচারণমূলক আরও বক্তব্য রাখেন অবসরে যাওয়া শিক্ষক অধ্যাপক মো. শহীদুল ইসলাম, অধ্যাপক মো. নজরুল ইসলাম, অধ্যাপক মো. আবুল কাশেম, অধ্যাপক মো. শাহাদাৎ হোসেন, অধ্যাপক আব্দুস সালাম মণ্ডল, অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক, অধ্যাপক আবু ইউনুস, অধ্যাপক মামুনুর রহমান, অধ্যাপক মো. আব্দুর রশীদ প্রমুখ। আরও কয়েকজন প্রিয় শিক্ষক আমাদের আয়োজনে আসতে পারেননি।
অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকমণ্ডলীর সংবর্ধনার এ উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয় ও প্রেরণাদায়ক। পাশাপাশি আগামী নতুন প্রজন্মের জন্য এটি একটি মহতি ও শিক্ষণীয় বার্তা বলে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকরা মনে করেন। গুরুদাসপুরের মতো চলনবিলের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ শিক্ষার মানোন্নয়নে তথা শিক্ষকের মান রক্ষায় যে কার্যক্রম নিয়েছে তা অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের জন্য সত্যিই অনুকরণীয় একটা বিষয় বলে বক্তারা মনে করেন।
তারা আরও বলেন যে, সংশপ্তক জোহা-২০০১ এর ভূমিকা দেখে আমাদের অবাক লেগেছে। কারণ, তারা দীর্ঘ সময় পার করলে শিক্ষা গুরুদের মনে রেখেছেন এবং তাদের মনেপ্রাণে সম্মান দেখিয়েছেন। আগামীতেও এ ধরনের কার্যক্রম নিয়ে এগিয়ে এসে এ অঞ্চলের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও শিক্ষার মানোন্নয়নে ঘটিয়ে উপযোগী মানবসম্পদ তৈরিতে ভূমিকা রাখবে এটাই প্রত্যাশা করি।
শিক্ষকরা মনে করেন, বিগত কয়েক বছর ধরে দেশে শিক্ষকদের নিগ্রহের হার বেড়েই চলছে। কয়েক মাসের ঘটনা পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায়। প্রতিকূল সময়ে সংশপ্তক জোহা-২০০১ কতৃর্ক শিক্ষকদের সম্মানিত করা অবশ্যই ইতিবাচক।
শিক্ষকমণ্ডলীর সঙ্গে স্মৃতিচারণে অংশ নিয়ে ছাত্ররাও নস্টালজিক হয়ে ওঠে। সে এক অনিন্দ্য অনুভূতি। স্মৃতিচারণের পরে ছোট পরিসরে কেক কেটে, কলেজ কর্তৃপক্ষকে ব্যাচের পক্ষে ঘড়ি উপহার দিয়ে, শোভাযাত্রা শেষ করে মধ্যাহ্ন ভোজ হয়। বন্ধুদের অংশগ্রহণে র্যাফেল ড্র অনুষ্ঠিত হয়। অতপর, চলনবিলের হরদমা, বিলসা, কুন্দইল, ধামাইচ গ্রামগুলোতে নৌকাভ্রমণ দিয়ে আমাদের পুনর্মিলনীর যাত্রা শেষ হয়।
একুশ বছর পরে বন্ধুদের সঙ্গে মিলিত হবার পরে যে অভিব্যক্তি, যে অনুভূতি তা প্রকাশ করা যাবে না। বার বার শুধু মনে হলো আরও সময় যদি পেতাম বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করার! কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হয়েছিলাম। আর, বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে এখন কর্মজীবী হয়েছি। সেই সময়গুলো শিক্ষকদের প্রকৃত শিক্ষা, দোয়া আর বন্ধুদের ভালোবাসা ছিল। তা আজও ভোলার নয়।
লেখক: ব্যাংকার ও কবি।
fattahtanvir@gmail.com