কেন্দ্রীয় নেতাদের ঘরে বিদ্রোহীদের জয়জয়কার
তৃণমূল আওয়ামী লীগে হ য ব র ল অবস্থা। তৃণমূল থেকে ঘাম ঝরিয়ে জেলার নেতা; আর জেলা থেকে কেন্দ্রীয় নেতা হওয়ার চর্চা দলটির পুরোনো ঐতিহ্য। তবে বর্তমানে নিজ এলাকায় কেন্দ্রীয় নেতাদের কদর কমছে। নিজের এলাকায় জেলা ও থানা কমিটির নেতারা শুনছেন না কেন্দ্রীয় নেতাদের কথা। এর জলন্ত উদাহরণ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনগুলো। আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার কড়া নির্দেশনা দিলেও নৌকার হয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে নামেননি কেন্দ্রীয় নেতাসহ জেলার নেতারা। এতে কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী নেতাদের এলাকাতেও জয় তুলতে পারেনি দলীয় প্রার্থীরা।
এই নির্বাচনেও বিভিন্ন স্থানে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রাণহানীর ঘটনাও ঘটেছে। এসব সহিংসতার বেশির ভাগই দলীয় প্রার্থী বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে। ফলে ্দলীয় কোন্দলও প্রকাশ্যে চলে এসেছে স্থানীয় সরকার নির্বাচন ঘিরে।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পঞ্চম ধাপ শেষে ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের জয়জয়কার। অনেক স্থানে কেন্দ্রীয় সিনিয়র নেতাদের সংসদীয় আসনগুলোতে বিদ্রোহী প্রার্থীরা জয় পেয়েছে। চতুর্থ ধাপে ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে ৯টিতেই আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছেন। পরাজিত ৯ প্রার্থীর মধ্যে জামানত হারিয়েছেন আওয়ামী লীগের ৩ প্রার্থী। এই এলাকার সাবেক সংসদ সদস্য মো. আব্দুর রহমান। তিনি বর্তমান আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য।
এরআগে গত ১১ নভেম্বর ও ২৮ নভেম্বর দ্বিতীয়, তৃতীয় ধাপে ইউনিয়ণ পরিষদ নির্বাচনেও ফরিদপুরে নৌকার ভরাডুবি হয়েছে। তখন ফরিদপুরের ভাঙ্গা ও চরভদ্রাসন উপজেলার ১৫টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকা প্রার্থীদের ভরাডুবি হয়েছে। ১৫টি ইউপির মধ্যে ১৪টিতেই স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়লাভ করেছেন। মাত্র ১টিতে নৌকা বিজয়ী হয়েছে। এই সংসদীয় আসনেও নৌকার প্রার্থী হিসেবে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন কাজী জাফর উল্লাহ। তিনিও বর্তমানে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য। ফরিদপুরে আরও একজন সভাপতিমন্ডলীর সদস্য রয়েছেন। সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচত ফরিদপুর যেন এখন নৌকার জন্য অথৈ সমুদ্র।
একই অবস্থা মাদারিপুর। সেখানে সভাপতিমন্ডলীর সদস্য শাজাহান খান, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহাবুদ্দীন মোল্লা। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম এবং প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আব্দুস সোবহান গোলাপ, সাবেক মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসন। এছাড়া সংসদের প্রধান হুইপ নূর ই আলম চৌধুরী। কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে স্থানীয় নেতাদের মতানৈক্য না হওয়া সেখানে নৌকা প্রতীক বরাদ্দ দিতে পারেনি কাউকে। তাই মাদারিপুরকে সকলের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। তাতেও দেখা গেছে নিজেদের গ্রুপিং এর কারণে সেখানে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।
সিলেট-৬ আসনের সংসদ সদস্য সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য নুরুল ইসলাম নাহিদের সংসদীয় আসনেও নৌকার ভরাডুবি। সেখানে ১০টি ইউনিয়নের মধ্যে মাত্র ৩টিতে বিজয়ী হয়েছে নৌকার প্রার্থী। বাকি ৭টির দুটিতে জামায়াত ইসলাম এবং ৫টিতে নৌকার বিদ্রোহী প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন।
পঞ্চম ধাপে কুষ্টিয়ার ১১ ইউনিয়নের ১০টিতেই বিদ্রোহী প্রার্থীর জয়। একটিতে জয় পেয়েছে নৌকা।
এর আগে কুষ্টিয়ার কুমারখালী ও খোকসায় চতুর্থ ধাপের ২০টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৭টি ইউনিয়নে বিজয়ী। এছাড়া বিএনপি ১টিতে এবং স্বতন্ত্র ৮ প্রার্থী বিজয়ী হয়েছে। এখানেও বিদ্রোহী প্রার্থীদের জয়জয়কার।
এর আগে কিশোরগঞ্জে তিন উপজেলা জেলা ভৈরব, কটিয়াদী ও হোসেনপুরের ২২টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত ৯ জন ও স্বতন্ত্র ১৩জন প্রার্থী বিজয়ী হন। এছাড়া ভৈরব উপজেলার ৭টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত ৪জন ও স্বতন্ত্র প্রার্থী ৩জন বিজয়ী হয়েছেন।
বিদ্রোহী প্রার্থীদের জয়জয়কার সবখানেই। বিষয়টি নিয়ে উৎকণ্ঠায় আওয়ামী লীগ। বার বার বলার পরেও কেন বিদ্রোহী দমানো যাচ্ছে না; এসব বিষয়ে পর্যালোচনা করতে স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সভায় আলোচনা হতে পারে বলে দলীয় সূত্রে জানাগেছে।
এবিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘দলের শৃঙ্খলা ধরে রাখার জন্য কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যারা বিদ্রোহী হয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে বিদ্রোহী প্রার্থীদের বেশিরভাগ আমাদের দলের। এখানে হয়তো আমাদের প্রার্থী মূল্যায়নে কিছুটা ভুল আছে।’
বিদ্রোহী প্রার্থী নিয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘নির্বাচনে সবগুলো রাজনৈতিক দল যদি অংশ গ্রহণ করতো সেক্ষেত্রে হয়তো বিষয়টি একটু ভিন্ন রকম হতো। সেখানে একটি প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ নির্বাচন হতো, তীব্র প্রতিযোগীতামূলক নির্বাচন হতো সেই ক্ষেত্রে কিন্তু আমাদের দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা হয়তো কমে আসতো। এখানে প্রতিযোগীতামূলক বিরোধী দল মাঠে না থাকার কারণে অনেকে নির্বাচন করার উৎসাহ পাচ্ছে। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন এবং প্রতিযোগীতামূলক নির্বাচন করার জন্য দরকার হলো সকলের অংশগ্রহণ’।
বিদ্রোহী প্রার্থী দলের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ বলে মন্তব্য করে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলের মধ্যে বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা বাড়ছে, যেহেতু প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলো অফিসিয়ালি অংশগ্রহণ করছে না, আন-অফিসিয়ালি অংশ গ্রহণ করছে ফলে একটু বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। আবার যদি পুরোপুরি দমন করি তাহলেও বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বীতায় নির্বাচিত হয়ে যাচ্ছে। আমরা এখন পড়ে গেছি শাখের কড়াতের মধ্যে আছি এদিকও কাটে ওদিকেও কাটে। বিদ্রোহী হওয়াও খারাপ। তাই নির্বাচন শেষ হলে দল থেকে স্ট্যাডি হওয়া উচিত।
এসএম/