ফিরে দেখা ২০২১
অনুপস্থিত তবু আলোচনার কেন্দ্রে খালেদা জিয়া
খালেদা জিয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন। দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত আসামি। মানবিক কারণে প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়ার দণ্ডাদেশ স্থগিত রেখে মুক্তি দেওয়া হয়। চলতি বছরের ১৩ নভেম্বর থেকে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন তিনি।
দণ্ডিতাদেশ স্থগিত শর্তের বেড়াজালে খালেদা জিয়া রাজনীতি থেকে এক ধরনের ‘নির্বাসিত’। অথচ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলন, জাতীয় সংসদ, সচিবালয়, জাতীয় প্রেসক্লাব, কূটনৈতিকপাড়া, রাজনৈতিক অঙ্গনে এমনকি চা আড্ডায় ঘুরেফিরে আলোচনা-সমালোচনায় খালেদা জিয়ার কথাই উঠে আসছে। এক কথায় রাজনীতিতে দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থেকেও অদৃশ্যভাবে যেন তিনিই রাজনীতির মধ্যমণি। বিশেষ করে অসুস্থতায় বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা প্রসঙ্গে ফের সরব হয়ে ওঠে খালেদা জিয়া প্রসঙ্গ। চিকিৎসা সেবা বিষয়ে দলটির পক্ষ থেকে যেমন সরব তেমনি আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা ও মন্ত্রিপরিষদের অন্যরাও এই বিষয়ে মন্তব্য করেছেন।
সোমবার (২৭ ডিসেম্বর) সচিবালয়ে খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য বিদেশ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেওয়ার বিষয়ে তার ভাই শামীম ইস্কান্দারের করা আবেদনে আইনি মতামত দিয়ে সেটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তবে একদিন পর সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান- খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য পাঠানোর বিষয়ে আইনমন্ত্রী মতামত দিয়েছেন। আমরা এই বিষয়ে আরও স্ট্যাডি করবো, প্রয়োজন পড়লে আরও পরামর্শ নিবো। তবে তিনি (আইনমন্ত্রী) যেভাবে মত দিয়েছেন সেখানে খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার ব্যাপারে আইনগত কোনো সুযোগ নেই।’
এদিকে, চিকিৎসার চেয়ে রাজনীতি, আইনগত দিক ও মানবিকতা নিয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে। শুধু বিএনপি-খালেদা জিয়ার পরিবারের পক্ষ থেকে নয় নানা শ্রেণিমহল বিদেশে উন্নত চিকিৎসার দাবি করে আসছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে আইনি বাধা বলে এখনও ইতিবাচক আলোচনা হচ্ছে না।
হাসপাতালে ভর্তি
কারাবন্দি থাকা অবস্থায় একাধিকবার অসুস্থ হয়ে চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে খালেদা জিয়াকে। দণ্ডিতাদেশ স্থগিত হওয়ার পর কারামুক্ত হয়ে বাসায় গিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন খালেদা জিয়া। যে কারণে চিকিৎসা সেবা নিতে হাসপাতালে যান তিনি। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় জানা যায় খালেদা জিয়া করোনা আক্রান্ত। এরপর দুই মাস চিকিৎসাধীন থেকে বাসায় ফেরেন। এর কিছুদিন পর আবার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যান এবং ২৬ দিন চিকিৎসাধীন থেকে বাসায় ফেরেন। কিন্তু ৫ দিনের মধ্যে তিনি আবার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যান। এরপর থেকে তিনি রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে রয়েছেন।
কী হয়েছে খালেদা জিয়ার
পরিবার ও দলের পক্ষ থেকে খালেদা জিয়া হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি। ফলে দলের নেতা-কর্মীদের মাঝে বিভ্রান্তি দেখা দেয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও নানা ধরনের বিভ্রান্তি ও ভুল তথ্য ছড়িয়ে যেতে দেখা যায়। পরে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়- খালেদা জিয়া ডায়াবেটিস সমস্যা, আর্থ্রাইটিস সমস্যা, ফুসফুস সমস্যা, কিডনি সমস্যা. চোখের সমস্যা, হিমোগ্লোবিনের সমস্যা, হার্টের সমস্যা, লিভার সিরোসিসসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত।
চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের প্রধান এভারকেয়ার হাসপাতালের চিকিৎসক শাহাবুদ্দিন তালুকদার জানিয়েছিলেন- খালেদা জিয়া মৃত্যুঝুঁকিতে রয়েছেন এবং এই চিকিৎসা উপমহাদেশে নেই। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জার্মানির কিছু হাসপাতালে এর চিকিৎসা রয়েছে।
খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে খালেদা জিয়া। উন্নত চিকিৎসায় বিদেশে নেওয়া প্রয়োজন। অন্যথায় খালেদা জিয়ার কিছু হলে এর দায়ভার সরকারকেই নিতে হবে।’
এদিকে, ২৯ ডিসেম্বর বুধবার বেলা ১১টার দিকে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা বোর্ডের সদস্য চিকিৎসক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেনের সঙ্গে কথা হলে তিনি ঢাকাপ্রকাশকে জানান- ‘খালেদা জিয়ার সর্বশেষ শারীরিক অবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ। তাই এখনও সিসিইউতে থেকে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। তাকে দ্রুত উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়া প্রয়োজন।’
বিদেশে চিকিৎসা কিংবা বিদেশ থেকে কোনো চিকিৎসা সরঞ্জাম নিয়ে আসা হয়েছে কী-না জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন- ‘বিদেশে চিকিৎসায় মানবিকতা ও আইনগত বিষয় দেখা যাচ্ছে। তবে বিদেশ থেকে কি হাসপাতাল নিয়ে আসা সম্ভব?’
খালেদা জিয়ার পাশে কে
খালেদা জিয়াকে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রায় নিয়মিত একবারের জন্য হলেও হাসপাতালে দেখতে যান এবং তার চিকিৎসার শারীরিক বিষয় খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। খোঁজ নিতে প্রতিদিন আসা-যাওয়া করছেন তার ভাই-বোন এবং পুত্রবধূ শর্মিলা রহমান সিঁথি। সিঁথি খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী। তিনি অক্টোবরের শেষ দিকে বাংলাদেশে আসেন।
খালেদা জিয়ার কারাভোগ
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেয় আদালত। যদিও পরে আপিলে কারাদণ্ডের মেয়াদ বেড়ে ১০ বছর হয়। রায় ঘোষণার পরপরই খালেদা জিয়াকে আদালত থেকে পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগারে নেওয়া হয়। ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির আরেক মামলায় খালেদা জিয়াসহ চার জনকে ৭ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
২০২০ সালে সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও অদৃশ্য করোনা ভাইরাস মহামারি আকার ধারণ করে। তখন পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদনের প্রেক্ষিতে ২৫ মার্চ সরকার নির্বাহী আদেশে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর দণ্ডিতাদেশ স্থগিত করা হয়। কারামুক্ত হয়ে গুলশানের বাসভবন ফিরোজা’য় ফেরেন তিনি। শর্ত দেওয়া হয় তাকে (খালেদা) দেশে অবস্থান করতে হবে। রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে হবে।
খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার দাবিতে বিএনপির কর্মসূচি
চলতি বছরের ১৩ নভেম্বর হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর বিদেশে চিকিৎসা ও কারামুক্তির দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করে বিএনপি। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- গণ অনশন, মানববন্ধন, মৌন মিছিল, প্রতিবাদ সভা, বিভাগীয় সমাবেশ।
যদিও জনমনে জিজ্ঞাসা- বিএনপি খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসায় রাজপথে কর্মসূচি পালন করে গেলেও তাদের সক্ষমতা জানা। তাই বারবার সরকারের কাছে মানবিকতার বিষয়টি তুলে ধরছে।
চিকিৎসা ইস্যুতে স্বরাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক
২১ নভেম্বর রবিবার খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার দাবিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দেয় বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে থাকা ৫ রাজনৈতিক দল। ২৩ নভেম্বর মঙ্গলবার খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসার দাবি নিয়ে আইনমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের একটি প্রতিনিধি দল।
করোনা টেস্ট পরীক্ষায় খালেদা জিয়ার জন্মদিন
১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকীর দিন ও জাতীয় শিশু দিবস। অথচ প্রায় এক যুগ ধরে খালেদা জিয়া ১৫ আগস্ট তার জন্মদিন পালন করেন। এ নিয়ে আওয়ামী লীগসহ নানামহলে খালেদা জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে এবার জন্মদিন নতুন করে খালেদা জিয়াকে সমালোচনায় ফেলে তার করোনা টেস্ট রিপোর্ট। যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। যেখানে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিন উল্লেখ করা আছে ৮ মে ১৯৪৬ সাল।
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা
দুই দুর্নীতি মামলা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় দণ্ডিত আসামি খালেদা জিয়া। তার বিরুদ্ধে মোট ৩৭টি মামলা। যার ৩৫টি মামলায় জামিনে রয়েছেন তিনি। উল্লেখ্যযোগ্য মামলা হচ্ছে, গ্যাটকো মামলা, নাইকো দুর্নীতি মামলা, বড় পুকুরিয়া খয়লা খনি দুর্নীতি মামলা, মিথ্যা জন্মদিন পালনের অভিযোগে মামলা, বাংলাদেশের মানচিত্র-জাতীয় পতাকা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির মামলা।
মামলা চলাকালে খালেদা জিয়া আদালতের প্রতি অনাস্থা জানান। কিন্তু উচ্চ আদালত না মঞ্জুর করেন। অবশ্য বিএনপির পক্ষ থেকে বরাবর বলা হয়েছে- খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে মামলা দেওয়া এবং সাজা দেওয়া হয়েছে। অপরদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাদের বক্তব্য, দুর্নীতি করেছেন বলে সেনা সমর্থিত সরকার শাসনামলে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
এমএইচ/এএন