গণতন্ত্র মঞ্চের নেপথ্যে রাজনৈতিক দরকষাকষি!
দীর্ঘদিন ধরে নির্দলীয় সরকারের দাবি করে আসছে রাজপথের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি। সেই দাবি আদায়ে রাজপথ আন্দোলন আরও জোড়ালো করতে এবার সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে সংলাপের সিদ্ধান্ত নেয় দলটির হাইকমান্ড। সেক্ষেত্রে বিএনপির সেই সংলাপের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোও ইতিবাচক মনোভাব দেখাচ্ছে। যদিও আগামী দিনে রাজপথে বিএনপির আন্দোলন-সংগ্রামের ধরণ, কৌশলের কথা মাথায় রেখে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে ভিন্নভাবে একটি ঐক্য গড়ে তুলতে ঐক্যমতে পৌঁছেছে।
এ ব্যাপারে শুরুতে ৭টি রাজনৈতিক দল মিলে ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম দাঁড় করাতে খসড়া তৈরি করেছে। ধারাবাহিক বৈঠক করে যাচ্ছে দলগুলোর শীর্ষ নেতারা। উদ্দেশ্য-ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বরং কীভাবে সরকার পতনে রাজপথের আন্দোলনে বিএনপির সঙ্গে অথবা ভিন্ন প্ল্যাটফর্ম থেকে সরকারবিরোধী যুগপৎ অংশ নেওয়া যায়। গণতন্ত্র মঞ্চ তৈরির সঙ্গে জড়িত একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপকালে এমন তথ্যই উঠে এসেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার বিষয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ৭টি রাজনৈতিক দল। সেই সিদ্ধান্তের সঙ্গে সরকারবিরোধী অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলার উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে। পাশাপাশি বর্তমান সরকারের পদত্যাগ এবং একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে সুষ্ঠু অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে একমত হয়েছে দলগুলোর শীর্ষ নেতারা। লিখিতভাবে রূপরেখা চূড়ান্ত করতে কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। আসছে ১২ জুন বৈঠকে পরবর্তী দিকদর্শন ও কর্মসূচি নিয়েও সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলেও জানা গেছে।
একদিকে বিএনপি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ-আলোচনা শুরু করেছেন অন্যদিকে ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’ গঠনে ঐক্যমত হয়েছে ৭টি রাজনৈতিক দল। দলগুলো হচ্ছে: জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), নাগরিক ঐক্য, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণ অধিকার পরিষদ, ভাসানী অনুসারী পরিষদ, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন ও গণসংহতি আন্দোলন।
জানতে চাইলে গণঅধিকার পরিষদের সদস্য সচিব নূরুল হক নূর ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘দেশের বর্তমান যে সংকট, এই সংকট থেকে, আমরা মনে করি যে, একটা নির্বাচন হলেই চলমান সংকটের উত্তরণ হবে না। প্রয়োজন ৭০ সালের মতো একটা নির্বাচন, যেখানে শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিবর্তন হবে। অর্থ্যাৎ বতর্মান সংবিধান ব্যবস্থা আছে তার সংস্কার, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোকে স্বতন্ত্র-সক্রিয়ভাবে কাজ করতে যে নানা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তা দূর করা। সে কারণে রাজনৈতিক দল-সংগঠনগুলোর মোর্চা বা জোটের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো-ক্ষমতার পরিবর্তনের পাশাপাশি রাষ্ট্রের কিছু মৌলিক পরিবর্তন, রাষ্ট্রের কাঠামোতে কিছু পরিবর্তন।’
তিনি আরও বলেন, ‘এটার সঙ্গে নিশ্চয়ই বিএনপি-আওয়ামী লীগের রাজনীতির চিন্তা ধারার একটা পার্থক্য আছে। কারণ তারা মনে করে-এক দল ক্ষমতা থেকে গেলেই আরেক দল ক্ষমতায় চলে আসতে পারবে। অথচ আমরা তো শুধু মাত্র ক্ষমতার পরিবর্তন নয়, সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ একটি সভ্য ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। সেজন্য আমরা সংগঠনগুলো মিলে এই ফ্রন্ট বা জোট গঠন করেছি। আমাদের একটি লিখিত বক্তব্যে থাকবে এটা নিয়ে কাজ চলছে। আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশের দিন এটি উন্মুক্ত করা হবে। সেই ক্ষেত্রে আমাদের লিখিত বক্তব্যের সঙ্গে যারা একমত হয়ে কাজ করতে চাইবে তাদের কে নিয়ে আমরা এই মঞ্চ বা প্ল্যাটফর্মকে বৃহত্তর পরিসরে অগ্রসর হবো। শুধু মাত্র দল বা মঞ্চের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখব না।’
তিনি বলেন, ‘বিএনপির বিষয়টি বলা যাচ্ছে না। বিএনপি তো চায় শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে সরে যাক, নির্বাচন হলেই তারা যেন ক্ষমতায় চলে আসবে। আমরা ক্ষমতার পরিবর্তন নয়, রাষ্ট্র পরিবর্তন ও রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনার পরিবর্তনের কথা বলছি। এখন ওই দাবিগুলো যদি বিএনপিও ঐক্যমত পোষণ করে তাহলে বিএনপির সঙ্গে আমাদের একটা একসঙ্গে কর্মসূচি বা আলাপ আলোচনা হতে পারে।’
ক্ষমতার পরিবর্তন বা রাষ্ট্রের কাঠানো পরিবর্তনে যদি আসতে হয় তাহলে তো নির্বাচনের মাধ্যমেই ক্ষমতা পরিবর্তনে আসতে হবে-এমন প্রশ্নে ডাকসুর সাবেক ভিপি বলেন, ‘এইসব ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মতো বুঝাপড়া থাকতে হবে। সেটায় যদি বিএনপি একমত পোসন করে তাদের পক্ষ থেকে বক্তব্যেগুলো জোটের কাছে জানাতে হবে। দেশের মানুষকে জানাতে হবে, তারপরে হয়তো একটা বিবেচনা করা যাবে। কিন্তু আপাতত বিএনপির বিষয়ে কোনো আলোচনা হয় নাই। আপাতত আলোচনা করা হয়েছে জনগণ কে কীভাবে এই দাবিগুলোর পক্ষে সম্পৃক্ত করা যাবে। একটা গণআন্দোলন কীভাবে গড়ে তোলা যায় সে ব্যাপারে কাজ করতে হবে। বিএনপি যে আসবে সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয় নাই। আমরা আপাতত তো বিএনপিকে নিয়ে ভাবছি না। আমরা তো চাই যে-এই ফ্রন্ট বা জোট আগামী দিনে সরকার গঠন করবে, তারপর এই পরিবর্তনগুলো হবে। সেক্ষেত্রে আমরা তো কারও সঙ্গে যাব না। আমাদের সঙ্গে যারা যাবে তাদের বিষয়ে আমরা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিব।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ৭ রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গড়ে উঠতে যাওয়া গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম একজন নেতা ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন,- ‘নিঃসন্দেহে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে-রাজপথের আন্দোলনে বড় একটি রাজনৈতিক দল বিএনপি। দলটির জনসমর্থন ও ভোটের সংখ্যাও অনেক। বেশ কয়েকবার রাষ্ট্রপরিচালনায় দায়িত্ব পালন করেছে। ফলে এবার বিএনপি ছাড়াও আমরা যারা সরকারবিরোধী অবস্থান থেকে নিজেদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে যাচ্ছি-তাদের মধ্যেও ঐক্যমতের ভিত্তিতে একটি ‘প্ল্যাটফর্ম’ থাকা জরুরি বলে মনে করছি। অনেক আগেই সেটা গড়ে তোলা উচিত ছিল। আশার কথা হলো-বিলম্বে হলেও রাজনৈতিক দলগুলো যে একটি নিদিষ্ট ইস্যুতে একত্রে বসতে পেরেছি সেটাই বা কম কিসে? এই প্ল্যাটফর্মে সংখ্যার চেয়ে ঐক্যমতকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ফলে যৌক্তিক দাবিতে ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারলে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর যে কেউ গণতন্ত্র মঞ্চে যুক্ত হওয়ার সুযোগ থাকছে।’
এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্র মঞ্চকে একদিকে চলমান রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের পথপ্রদর্শক কিংবা আলোকবর্তিকাও বলা যেতে পারে। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের গুরুত্ব তুলে ধরার বা ক্ষমতার স্বাদ পেতে দরকষাকষির প্ল্যাটফর্ম হিসেবেও বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। কারণ এই বিবেচনা নেওয়াটা প্রত্যেকের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অভিমত। বলতে গেলে-ভিন্ন মতাদর্শন ও ভিন্ন জনের মধ্যে একটি নিদিষ্ট ইস্যুতে গড়ে উঠা গণতন্ত্র মঞ্চ কারও একক সিদ্ধান্তে গড়ে উঠা প্ল্যাটফর্ম কিংবা রাজনৈতিক জোট হবে না। ঐক্যমতের ভিত্তিতে পরিচালিত হবে। দাবি আদায়ে রাজপথের আন্দোলনে পরবর্তী সময়ে এটা নির্বাচনী জোট হবে কি না, সেটাও সময়ের ওপর ছেড়ে দেওয়া ভালো।’
বাংলাদেশ বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘একটি বৃহত্তর আন্দোলনে ঐক্য গড়ে তুলতে বিএনপির সঙ্গেও আলোচনা চলমান, আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনার দিনক্ষণ নির্ধারিত করা হয়েছে। তবে আমরা প্রাথমিকভাবে ৭টি রাজনৈতিক দল গণতন্ত্র মঞ্চ তৈরিতে কাজ করছি। ওই মঞ্চের ভিত্তি ও দাবিসমূহ নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। পরবর্তী বৈঠক ১১ কিংবা ১২ জুন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, সেই বৈঠকে এই সবকিছু নিয়ে আলোচনা করা হবে। ঐক্যমতের ভিত্তিতে গণতন্ত্র মঞ্চে যে কোনো দল আসতে পারবে। এই মুহূর্তে ইসলামী দলগুলো নিয়ে কোনো প্রকার আলোচনা করার সিদ্ধান্ত নেই।’
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির সংলাপ-আলোচনা এবং গণতন্ত্র মঞ্চ কোনো প্রকার ভিন্নতা কিংবা দলগুলোর মধ্যে সমন্বয় প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই বর্তমান সরকার পতনে একটি বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তুলতে কাজ করছি। বিএনপিও চেষ্টা করছে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে। শুরুতে যার যার অবস্থান থেকে নিজেদের মধ্যে ঐক্যে গড়ে সেই ঐক্যকে পরবর্তী সময়ে বৃহত্তর যুগপৎ আন্দোলনে ধাবিত করার নীতিগত সিদ্ধান্ত থাকছে।’
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘আমরা কতগুলো বিষয় চিহ্নিত করে একমত হয়েছি। এই সরকারের অধীনে নির্বাচন নয়, তাদের ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হবে। তারপর একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করবে। কীভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হবে, কতদিন মেয়াদ হবে-এসব বিষয়ে আমরা সাংবিধানিক দিকগুলোও খতিয়ে দেখছি। পরবর্তী বৈঠকগুলোতে এ নিয়ে আরও আলোচনা হবে।’
এমএইচ/এমএমএ/