‘চরমোনাই মাদরাসা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি ও সংখ্যালঘুদের আশ্রয়স্থল’
১৯৭১ এ মহান মুক্তিযুদ্ধে চরমোনাই মরহুম পীর সাহেব মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মাদ এছহাক রহ. ও মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মাদ ফজলুল করীম রহ. চরমোনাইতে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাটি করতে যেমন সহযোগিতা করেছেন তেমনি চরমোনাইর হিন্দু ধর্মাবলম্বীসহ সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিজেদের বাড়ি ও চরমোনাই মাদরাসায় আশ্রয় দিয়ে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিলেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন চরমোনাই মরহুম পীর মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মাদ এছহাক রহ. ও মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মাদ ফজলুল করীম রহ. দ্বয়ের ভুমিকা সম্পর্কে চরমোনাই ইউনিয়নের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের বক্তব্য জানতে চেষ্টা করেছেন-ইসলামী মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম পরিষদ সভাপতি শহিদুল ইসলাম কবির।
পাঠকদের জন্য বিস্তারিত তুলে ধরা হলো চরমোনাই ইউনিয়নের বীর মুক্তিযোদ্ধারা বলেছেন, চরমোনাই মাদরাসা ছিল বরিশাল বিভাগের মুক্তিযুদ্ধের ঘাঁটি। রাজাকার,আল বদর,আল শামস বা স্বাধীনতা বিরোধীদের সঙ্গে চরমোনাই পীর বা তা পরিবার পরিজনের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। চরমোনাই পীর মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে নয়,মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সহযোগিতা করেছেন। চরমোনাইতে রাজাকারের ক্যাম্প থাকলে এ এলাকার কোনো হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টানের জীবিত থাকার কথা ছিল না। সৈয়দ মুহাম্মাদ এছহাক রহ. পাকিস্তান সরকারের বশ্যতা স্বীকার করেননি বলে তৎকালীন সময়ে চরমোনাই মাদরাসা কামিল মাদরাসা হিসেবে উন্নীত করা হয়নি। সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা বলেন, চরমোনাই মরহুম পীর হিন্দুদেরকে চরমোনাই মাদরাসায় আশ্রয় দিয়ে খাইয়েছেন। হিন্দুদের পক্ষ থেকে ধর্মান্তরিত হওয়ার আবেদন প্রসঙ্গে পীর হুজুর বলেছেন দেশে এখন একটি অরাজক পরিস্থিতি চলছে, এই পরিস্থিতিতে কারও ধর্মান্তরিত হওয়া সঠিক নয়। মরহুম পীর পরশ পাথরতুল্য মানুষ ছিলেন, ধর্মবর্ণ, দল-মত নির্বিশেষে সকলকে তিনি সহায়তা করেছেন।
মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চরমোনাই ইউনিয়নের কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মির্জা আবুয়াল হোসেন কাজী বলেন, চরমোনাই পীর সাহেব ও তাদের পরিচালিত প্রতিষ্ঠানসমূহ আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। এই প্রতিষ্ঠনকে বিতর্কিত করতে একটি চক্র চরমোনাই পীর সাহেবের বিরুদ্ধে সময়ে সময়ে মিথ্যা কুৎসা রটানোর অপচেষ্টা চালিয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করতে চায়। ১৯৭১ এ মহান মুক্তিযুদ্ধে চরমোনাই পীর সাহেব ও চরমোনাই মাদরাসা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভুমিকা রেখেছেন। সৈয়দ মুহাম্মাদ এছহাক রহঃ পাকিস্তান সরকারের বশ্যতা স্বীকার করেন নি বলে তৎকালীন সময়ে চরমোনাই আলিয়া মাদরাসাকে কামিল মাদরাসা হিসেবে উন্নীত করা হয়নি। পাকিস্তানের ক্ষমতাসীনরা চরমোনাই পীর সাহেব ও চরমোনাই মাদরাসাকে তাদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতে ব্যবহার করতে পারেনি। মরহুম এছহাক রহ. মুক্তিযোদ্ধা,স্বাধীনতাকামী মানুষ ও হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপদ আশ্রয়স্থল ছিলেন।
সাবেক সেনা অফিসার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল আজিজ হাওলাদার (৮৩) বলেন, চরমোনাই মরহুম পীর সৈয়দ মুহাম্মাদ এছহাক রহ, এর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আমরা ২৬ জন মুক্তিযোদ্ধা সাক্ষাৎকরে আমি তার দোয়া ও সহযোগিতা চাই। তখন হুজুর বলেন, তোমরা কামিয়াবী হবা ইনশাআল্লাহ, তবে একটু সময় লাগবে। আমাদের ১২৮ জন মুক্তিযোদ্ধার খাবারের জন্য হুজুরের কাছে সহযোগিতা চাইলে তিনি বলেন আমাদের অবস্থানকৃত জায়গায় খাবার পৌঁছে দেন। হযরত এছহাক রহ. প্রতিনিধির মাধ্যমে একাধিক ছাগল, চাল-ডাল-তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী পাঠিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন।
চরমানাই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হালিম খান (৭২) বলেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমি বিএ ক্লাসে পড়তাম। বুখাইনগরে আমাদের ঘাঁটি ছিল। আমরা চরমোনাই দরবারের সামনে থেকে চলাচল করেছি, কোনো সময়ে কোনো বাঁধার সম্মুখীন হইনি। রাজাকার, আল বদর, আল শামস বা স্বাধীনতা বিরোধীদের সঙ্গে চরমোনাই পীর বা তার পরিবার পরিজনের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মকিম আলী খান বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধকে উপলক্ষ করে চরমানাই পীর ভুমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে কেউ যদি কোনো বক্তব্য দেয় তবে বুঝতে হবে ঐ লোক মিথ্যুক, মানুষ না,অমানুষ। চরমোনাই ইউনিয়নের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষ জানেন চরমোনাই পীর দ্বয় কেমন ছিলেন। চরমোনাই মাদরাসা ছিল বরিশাল বিভাগের মুক্তিযদ্ধের ঘাঁটি। চরমোনাই পীর সাহেবদ্বয় মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে থাকলে স্বয়ং আমরাও বাঁচতাম না।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাহার আলী খাঁন (৭৮) বলেন, ১৯৭১ এর ১২ মে আমি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসি। পথে ৪ যায়গায় পাক বাহিনী আমাকে আটক করে। পাক বাহিনী চরমোনাই সংলগ্ন এলাকায় বোর্ড রেখে এসে হুজুরের কাছে জানতে চান-এখানে কি কোনো হিন্দু আছে? জবাবে এছহাক রহ. বলেন, এই এলাকায় ৩৬০ জন হিন্দু আছে। তারা কেউ কারও ক্ষতি করে না। তাদের ধর্ম তারা পালন করে। আমাদের ধর্ম আমরা পালন করি। এখানে (চরমোনাইতে) বছরে ২টি সভা (ওয়াজ মাহফিল) হয়। হিন্দুরা এসে লাইন দিয়ে আমাদের আলোচনা শুনে। তারা (হিন্দুরা) কারও কোনো ক্ষতি করে না, একথা শুনে পাক বাহিনী হুজুরকে সালাম দিয়ে চলে যায়।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ফরিদ হোসেন শিকদার বলেন, চরমোনাই পীর সাহেব হুজুর ও তার পরিবার মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে নয়, সব সময়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সহযোগিতা করেছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল ইসলাম গাজী (৭২) বলেন, ১৯৭১ এ দেশ স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধ হয়েছে। স্বাধীনের পরে দেশে যত রাজনৈতিক সংকট হয়েছে চরমোনাইতে তার কিছুই হয়নি। চরমোনাই পীর সাহেব হুজুর মুক্তিযোদ্ধাদেও অবস্থানের জন্য মাদরাসার একটি টিনের ঘরে আমাদেরকে আশ্রয় দিয়েছেন। আমাদের ২৭০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে টিনের ঘরে আশ্রয় দিয়ে খাবার খাইয়েছেন এবং আমাদের বাড়ির ৩৫০ এর অধিক মানুষের জন্য খাবার পাঠিয়েছেন। চরমোনাইতে রাজাকারের ক্যাম্প থাকলে এ এলাকার কোন হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টানের জীবিত থাকার কথা ছিল না।
শিক্ষক বাবু জীবন চন্দ্র মণ্ডল (৭০) বলেন, চরমোনাই পীরেরে সঙ্গে আমাদের আলাপ-আলোচনা ছিল। ছোট সময় থেকে আমরা পীরের দরবারে যাতায়াত করতাম। চরমোনাই হুজুর আমাদেরকে আদর করতেন এবং ভালো জানতেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন আনুমানিক সেপ্টেম্বর মাসে নীলকান্ত ঘোষ এবং মাখম লাল ঘোষ আমার বাবার কাছে আমাদের বাড়িতে যান। বাবাকে ওরা বললো-ওপার থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েকজন লোক আসছে। তারা চরমোনাই পীর সাহেবের বাড়িতে গিয়ে মুসলমান হবে। (রায়পুরের সালাম খাঁ নামের লোকটি হিন্দুদেরকে উত্তক্ত করতো।) এরা যাবার কিছু সময় পরেই ওপার থেকে মাখন লাল হালদার, অবিনাশ তালুকদার, ডা. গনেশ চন্দ্র, মতি ঘোষ, মলি ঘোষ এই লোকগুলো গোপনে আমাদের বাড়িতে প্রবেশ করে। তারা আমার বাবাকে বলেছে আমরা মুসলমান হবার জন্য পীরের বাড়িতে যাচ্ছি। আপনারাও আসেন।
তখন আমার বাবা তাদেরকে বলেছেন, প্রয়োজন হলে পীর আমাদেরকে ডাকবেন। তারা পীরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কথা বলে যাবার সময়ে আবার আমাদের বাড়িতে আসেন। তখন আমার বাবা হিন্দু সম্প্রদায়ের ঐ লোকদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন পীর তাদেরকে কী বলেছেন? জবাবে তারা বাবাকে জানান, চরমোনাই পীর বলেছেন, দেশে এখন একটি অরাজক পরিস্থিতি চলছে। এই পরিস্থিতিতে কারও ধর্মান্তরিত হওয়া সঠিক নয়। দেশ একটি শান্ত পরিস্থিতিতে আসুক। তখন ভালোবেসে আপনারা ইসলাম গ্রহণ করতে চাইলে আপনাদেরকে ইসলাম ধর্মে দিক্ষিত করা হবে। কিন্তু পরবর্তীকালে তারা কেউই মুসলমান ধর্মে দিক্ষিত হননি। মাখন লাল বিশ্বাস (৬৬) বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমি এলাকা চষে বেড়াতাম। চরমোনাই পীর পরশ পাথরতুল্য মানুষ ছিলেন। চরমোনাই পীর ও তার পরিবার ধর্ম-বর্ণ, দল-মত নির্বিশেষে সকলকে সহায়তা করে যাচ্ছেন। চরমোনাই পীর ও তার পরিবার বটবৃক্ষের ন্যায় সকল মানুষকে ছায়া দিয়ে আসছেন।
চরমোনাই ইউনিয়ন ৫নং রাজার চর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি বাবু অমল সরকার (৬৬) বলেন, আমার বাবা-কাকারা লোকমুখে শুনেছেন যে, চরমোনাই পীর হুজুরের কাছে গিয়ে মুসলমান হলে তাদেরকে মারবে না। বাবা-কাকারা অনেকে পীর হুজুরের কাছে গিয়ে বলেছেন যে, আমরা শুনেছি আপনার কাছে এসে মুসলমান হলে নাকি পাকিস্তানিরা মারবে না। জবাবে পীর সাহেব হুজুর বলেছেন, এ কথা সম্পূর্ণ মিথ্যা। হুজুর বলেছেন, যদি আপনারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতেই চান তবে স্বাধীনতার পরে আসবেন, এখন না।
বাবু নিমাই চন্দ্র ঘোষ বলেন, ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমি ৮ম শ্রেণির ছাত্র। তখন আমার বয়স ১৪ কি ১৫ বছর। পীর আমাদেরকে অনেক সহযোগিতা করেছেন। আমাদের কিছু লোককে রাজাকাররা নৌকায় তুলে নিয়ে গেছিল। তখন পীরের জোরালো ভূমিকার কারণে ঐ লোকদেরকে অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেক লোক পীরের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। চরমোনাইতে আমরা হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ খোলামেলা চলাফেরা করেছি। আমাদের লোকদের উপর কোনো অত্যাচার হয়নি। রায়পুরা থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেক মানুষ চরমোনাই মাদরাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। আমাদের সম্প্রদায়ের মেয়ে-ছেলেরাও পীরের বাড়িতে নিয়ম মেনে নিয়মিত যাতায়াত করতেন।
কালু মালাকার বলেন, চরমোনাই পীর হিন্দুদেরকে চরমোনাই মাদরাসায় রেখে খাইয়েছেন। কেউ যাতে হিন্দু সম্প্রদায়ের কারও কোনো ক্ষতি না করে সে বিষয়ে সকলকে বলেছেন। হিন্দুরা মাদরাসায় আশ্রয় নিয়েছেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের কেউ মুসলমান হতে চাইলে পীর বলেছেন, বিপদের সময়ে কাউকে মুসলমান বানানো যাবে না। ইচ্ছা করে যদি কেউ মুসলমান হয়, তবে হোক।
এমএমএ/