মামলা আর গ্রেপ্তার আতঙ্কে বিএনপি নেতা-কর্মীরা!
সরকারবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচিতে মাঠে নেমেছে বিএনপি। কিন্তু কর্মসূচি বাস্তবায়নের চেয়ে গ্রেপ্তার এড়ানো আর মামলার আতঙ্কে সময় কাটছে বিএনপির নেতা-কর্মীদের। কেন্দ্র থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যায়ে সবার মধ্যেই আতঙ্ক বিরাজ করছে। প্রয়োজন ছাড়া কেউই প্রকাশ্যে বের হচ্ছেন না। নিজেদের আড়াল করে রেখেছেন। বিএনপির অভিযোগ, প্রতিদিনই কোনো না কোনো এলাকায় নেতা-কর্মীদের প্রথমে আটক করা হচ্ছে, পরবর্তীতে পূর্বের মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হচ্ছে। একইসঙ্গে বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে নতুন করে মামলা করায় উদ্বিগ্ন দলের হাইকমান্ড।
বিএনপির অভিযোগ, সাংগঠনিকভাবে নেতা-কর্মীদের সংগঠিত করতে পারেন— এমন নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হচ্ছে। গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে থানা পর্যায়ে সক্রিয় নেতাদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। সেটা ধরেই চলছে অভিযান। মূলত বিএনপির কর্মসূচিতে দলীয় নেতা-কর্মীরা যখন মাঠে নামছেন, তখনই মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছে সরকার। সক্রিয় করা হয় গায়েবি মামলা। প্রতিটি কর্মসূচির আগে অভিযান চালানো হয়। গ্রেপ্তার এড়াতে দলের কেন্দ্রীয় এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের বেশির ভাগ নেতারা ‘আত্মগোপন’ করেছেন।
বিএনপি ও এর সহযোগিত সংগঠনের নেতা-কর্মীরা বলছেন, কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচিতে সক্রিয় অংশ নেওয়ার পর থেকেই জেলা-উপজেলায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের নামে মিথ্যা ও গায়েবি মামলা দেওয়া হয়েছে। এ কারণে নেতা-কর্মীরা গ্রেপ্তার আতঙ্কে সময় পার করছেন। অনেকেই এখন ঘরছাড়া। নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বন্ধু বা আত্মীয়ের বাড়িতে থাকছেন।
বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধে দেশের জনগণ জেগে উঠছে। প্রতিটি কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষের উপস্থিতি বাড়ছে। তখন বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করার মিশন নিয়ে নেমেছে সরকার। যার ধারাবাহিকতায় গ্রেপ্তার অভিযান চলছে। প্রায়ই দলের নেতা-কর্মীদের বাসায় পুলিশি তল্লাশি চালানো হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সারাদেশে বিএনপির সক্রিয় অধিকাংশ নেতা-কর্মীর নামেই মামলা আছে। অনেকে আদালত থেকে জামিনে আছেন। তবে অধিকাংশ মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি থাকায় সংশ্লিষ্ট এলাকার সাধারণ নেতা-কর্মীরাও গ্রেপ্তার আতঙ্কে আছেন। তাদের বিরুদ্ধে পূর্বের মামলাসহ বর্তমান বানোয়াট মামলা ও অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলা করা হচ্ছে বলে নেতা-কর্মীরা অভিযোগ করছেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, সরকার বিএনপিসহ সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মীদের একের পর এক গ্রেপ্তার করছে। দমন-পীড়ন চালিয়ে আবারও একতরফা নির্বাচনের পাঁয়তারা করছে। কিন্তু আমরা ঐক্যবদ্ধ। যে কোনো মূল্যে একতরফা নির্বাচনের চেষ্টা প্রতিহত করা হবে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত দপ্তর সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, সোমবার (১৬ জানুয়ারি) দেশব্যাপী মহানগর ও উপজেলা পর্যায়ে ১০ দফা বাস্তবায়ন ও বিদ্যুতের দাম কমানোর দাবিতে সমাবেশ ও মিছিলের পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি ছিল। এই কর্মসূচি সামনে রেখে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকার দমন পীড়ন চালায়, প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং কর্মসূচি চলাকালে হামলা চালায়। অধিকাংশ জায়গায় কর্মসূচি পালন না করতে প্রশাসনকে দিয়ে চাপ সৃষ্টি করা হয়। গ্রেপ্তার করা হয়েছে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের শতাধিক নেতা-কর্মীকে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, বিএনপির নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার দুঃশাসনকে দীর্ঘায়িত করার অপচেষ্টা মাত্র। নেতা-কর্মীদের পরিকল্পিতভাবে গ্রেপ্তার-নির্যাতনের মধ্য দিয়ে অবৈধ সরকার বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করতে চায়। কিন্তু গ্রেপ্তার করেও এই সরকারের শেষ রক্ষা হবে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মতোই বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারাও এখন পুরনো মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার আশঙ্কা করছেন। সরকারবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে যে সব মামলা হয়েছে তাতে অনেককে আসামি করা হয়েছে, সবাই জানেনও না যে তারা আসামি। আর প্রতি মামলায়ই অজ্ঞাতপরিচয় সন্ত্রাসীদের কথা বলা আছে। তাই সেই সব মামলায় গ্রেপ্তার হতে পারেন কেউ কেউ ৷ আশঙ্কা করছেন, অনেক মামলা আছে যার খবর তাদের জানা নেই ৷ পুলিশ গোপনে করে রেখেছে৷ সেই সব মামলা এখন কাজে লাগানো হতে পারে, এমন আশঙ্কা বিএনপি নেতা-কর্মীদের।
মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের ভাষ্য, মামলার এজাহারভুক্ত আসামি হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি গ্রেপ্তার এড়াতে আগে থেকে সতর্ক থাকতে পারেন। আদালত থেকে জামিন নেওয়ারও সুযোগ থাকে। তবে অজ্ঞাত আসামিদের মামলার চার্জশিট দেওয়ার এবং গ্রেপ্তারের আগে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। তাই মামলার আসামি না হয়েও সংশ্লিষ্ট থানা এলাকার সক্রিয় নেতা-কর্মীদের আত্মগোপনে থাকতে হয়। গ্রেপ্তার এড়াতে দলীয় আন্দোলন কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার সুযোগও কমে যায়। তাদের অভিযোগ, অজ্ঞাত আসামি ধরপাকড়ের অজুহাতে থানা পুলিশের ‘চাঁদাবাজির’ সুযোগ তৈরি হয়। আর্থিকভাবে সচ্ছল যে কোনো নেতা-কর্মীকে আটক করে অজ্ঞাত আসামি হিসেবে গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের ‘ঘুষ’ দাবি করেন পুলিশ সদস্যদের কেউ কেউ। অস্বীকার করলে অজ্ঞাত আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে চালান দেওয়া হয়। শুধু মামলার বাদী নন, পুলিশ এবং একশ্রেণির আইনজীবীও জড়িত থাকেন। থানায় দায়ের করা মামলায় পুলিশের হাত থাকে। আর আদালতের মামলায় হাত থাকে কিছু আইনজীবীর। আর যেসব মামলা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য দায়ের করা হয় তার পেছনে থাকেন স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, নির্বাচনের আগে বিএনপিকে চাপে রাখতে মামলার ফাঁদে ফেলা সরকারের পুরনো কৌশল। অবৈধ সরকার ক্ষমতা ধরে রাখতে শেষ সময়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের দমাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। তারপরও গণতন্ত্রকামী বিএনপির নেতা-কর্মীরা মামলা ও গ্রেপ্তারে ভীত নন; সব বাধা উপেক্ষা করে সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত মাঠে থাকবে।
বিএনপির কয়েজন বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের সঙ্গে কথা হলে ঢাকাপ্রকাশ-কে তারা বলেন, রাজপথের আন্দোলনে চূড়ান্ত উত্তাপ ছড়ানোর আগেই মামলার ফাঁদে জড়নো হচ্ছে বিএনপি নেতাদের। পুরনো মামলায় ‘অজ্ঞাতনামা’ আসামির স্থানে নাম ঢুকিয়ে গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে। পুরনো মামলায় চার্জশিটও দেওয়া হচ্ছে দ্রুতগতিতে। বিচারকাজও চলছে একই গতিতে। একইসঙ্গে পুরনো মামলা সচল ও নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থাটির আবেদনে উচ্চ আদালতের আদেশে একের পর এক বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে করা মামলা সচল হচ্ছে। এরই মধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান, জয়নাল আবদীন ফারুক, সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুল হাবিব দুলুর মামলা সচলের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এনএইচবি/আরএ/